ডলারের বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের আদ্যোপান্ত নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
যদি আপনাদের প্রশ্ন করা হয় যে, বিশ্ব টিকে আছে কীসের উপর? এই প্রশ্নের উত্তরে যে কেউ ভড়কে যেতে পারে। কিন্ত একটু বুদ্ধিমান মানুষ ঠিকই উত্তর দেবেন, “বিশ্ব চলছে অর্থনীতির উপর নির্ভর করে।” ঠিক তারপর তাকে আরেকটি প্রশ্ন করতে পারেন- অর্থনীতি কীসের উপর নির্ভর করে চলছে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তরটা কম-বেশি আমার-আপনার সবার জানা। সেই উত্তরটি অবশ্যই ‘মার্কিন ডলার’।
আসুন জেনে নেওয়া যাক মার্কিন ডলার কীভাবে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে সেই বিষয়েই। এর সহজ উত্তর হলো- বিশ্বজুড়ে ডলারের থেকে সহজ এবং সর্বজনগ্রাহ্য কোনো বিনিময়মাধ্যম নেই, আর সেজন্যই বিশ্ব অর্থনীতি, মতান্তরে এই বিশ্বই বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করছে মার্কিন ডলার।
ধরা যাক, আপনি মরিশাস কিংবা হনলুলু বেড়াতে গেছেন, কিংবা মনে চেয়েছে আপনি হারিয়ে যাবেন! তাই হারিয়ে গেছেন আন্দামান নিকোবর কিংবা নীল জলরাশির মালদ্বীপে। শুধু সেখানে হারিয়ে গেলেই চলবে? যে ক’দিনই থাকেন না কেন, আপনাকে খেয়ে-পরে তো বাঁচতে হবে! আর এজন্য আপনার লাগবে মুদ্রা।
কিন্তু আপনি কীভাবে সেই দেশের মুদ্রা পাবেন? আর যদি সেই দেশের মুদ্রা না পান, তবে নিজের দেশের মুদ্রাও কাজে লাগাতে পারবেন না। সেই ক্ষেত্রেই আপনার জন্য ত্রাণকর্তার ভূমিকায় হাজির হয় মার্কিন ডলার। পুরো বিশ্বের জল-স্থল-অন্তরীক্ষ যেখানেই কোনো মানুষ আছে, তাদের জন্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সক্রিয় আছে ডলার। আর এভাবেই বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে ডলার।
ধরা যাক, আপনি বাইরের কোনো দেশ থেকে পন্য আমদানি করবেন! কিন্তু… কীভাবে করবেন সেটা? কীভাবে তার মূল্য পরিশোধ করবেন? উত্তরটা অবশ্যই টাকা হবে না, হবে ডলার। এর কারণ- আপনাকে লেটার অব ক্রেডিট তথা এলসি খুলতে হবে। আর এজন্য উপযুক্ত মূল্যমান পরিশোধের একমাত্র মাধ্যম এই ডলার।
আবার মনে করেন, বাংলাদেশ বাইরের কোথাও পণ্য রপ্তানি করছে। এক্ষেত্রেও কি টাকার মূল্যমানে অর্থ পাবে? কোনোভাবেই নয়। কারণ, বিশ্বের যে দেশেই পণ্য রপ্তানি করা হোক না কেন, তারা মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের বিকল্প কোনো গ্রহণযোগ্য মুদ্রাব্যবস্থা খুঁজে নিতে পারে না। এমনিভাবে প্রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক লেনদেনের একমাত্র গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে মার্কিন ডলার।
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, যে কাজ ডলার পারছে, সেটা আমাদের টাকা, ভারতের রুপি, রাশিয়ার রুবল, চীনের ইউয়ান, ব্রিটেনের পাউন্ড, এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ইউরো কেন পারছে না?
ইউক্রেন যুদ্ধের পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ডলারের বিপরীতে রুবল কিংবা ইউয়ান কি সার্বজনীন মুদ্রা হতে পারে? কিন্তু, এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর মেলেনি। আর, ডলারের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো মুদ্রা সার্বজনীন হয়ে ওঠার কাজটি একসময় কঠিন থাকলেও তা বর্তমানে হয়ে গিয়েছে অসম্ভব।
‘কাউ টু ক্রিপ্টোকারেন্সি’ অর্থাৎ টাকার ইতিহাস শীর্ষক বইটি পড়তে গেলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি বিশ্ব অর্থনীতিতে বিনিময়ের মাধ্যমের ক্ষেত্রে কী কী গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো ঘটেছে। বিশ্ব অর্থনীতির একেবারে গোড়ার দিকে যেমন গরুর মাধ্যমে বিনিময় প্রথা চালু হয়েছিল, তেমনি মহাস্থানগড় থেকে প্রাপ্ত শিলালিপি জানান দিচ্ছে- বাংলাদেশের প্রাচীনতম মুদ্রা হিসেবে গণ্ডক নামক বিশেষ বিনিময় মাধ্যমের নাম। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র আর নানাবিধ ধাতব মুদ্রার যুগ পার করে বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নেয় কাগজে তৈরি নোট।
ধীরে ধীরে বিশ্ব অর্থনীতির আরও রূপান্তর ঘটে। আমরা আবির্ভাব ঘটতে দেখি ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’ ও ‘ব্লক চেইনের’ মতো নানা পদ্ধতির।
আপনাদের জানিয়ে রাখা ভাল যে ‘ব্লকচেইন (Blockchain) একটি ইংরেজি শব্দ যার বাংলা আভিধানিক অর্থ ‘ব্লকের তৈরি শিকল’। এটি প্রধানত একটি লেনদেনের প্রযুক্তি যেখানে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে অর্থের সরাসরি স্থানান্তর করা সম্ভব। এবং এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি সবচেয়ে গতিশীল এবং সুরক্ষিত একটি প্রযুক্তি, যেখানে কেউ চাইলে লেনদেনে কোনো গড়মিল তৈরি করতে পারবে না।’
কীভাবে এই প্রযুক্তির উদ্ভব? আর এখানেও কীভাবে ডলার প্রভাব বিস্তার করতে পারে? আমরা জানি, ২০০৮ সালের দিকে একটা অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় বিশ্বব্যাপী। তখন বিশ্বের সমৃদ্ধ ব্যাঙ্কগুলোরও দেউলিয়া হওয়ার দশা হয়। তখন সরকার কিংবা থার্ড পার্টির নিরাপত্তাও তেমন কাজে দেয়নি। সরকারের উপর তখন বিশ্বাস হারিয়ে জনমনে দেখা দেয় চরম হতাশা।
আর সেই সমস্যার সমাধানেই সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামে এক বা একাধিক ব্যক্তি ২০০৮ সালের অক্টোবারে ৯ পৃষ্ঠার “Bitcoin: A Peer-to-Peer Electronic Cash System” নামক এক গবেষণা প্রস্তাবনা অনলাইনে প্রকাশ করেন। সেখানে প্রথম বিটকয়েন সম্পর্কে ধারণা দিয়ে একটি পিয়ার-টু-পিয়ার (peer-to-peer) ইলেক্ট্রনিক মুদ্রা পরিশোধের ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা হয়। এর মাধ্যমে একজন অন্যজনকে কোনো তৃতীয় পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের কাছে না গিয়েই লেনদেন সম্পন্ন করতে পারার কথা জানান দেয় এই পদ্ধতি।
অনেকে দাবি করেন, পদ্ধতি যদি এমন হয় তবে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় একটা বদল আসতে পারে। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন- যদি বদল আসে, তখন কি বিশ্বের মানুষ ডলারের থেকে সরে গিয়েও লেনদেন করতে পারবে? কিন্ত তাদের এতসব প্রশ্নের সহজ কিংবা ভয়ানক উত্তর হিসেবে “না” শব্দকেই বেছে নিতে হয়। এর মূল কারণ ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য আর ঐতিহাসিক ভিত্তি।
মূলত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন কোনো মুদ্রা ছিল না। কিন্তু, যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার পর বিশ্বব্যাপী প্রচুর অস্ত্র কেনাবেচা হয়। আর এসময় মুদ্রার বিকল্প লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণ ব্যবহৃত হয়। এতে বিশ্বজুড়ে স্বর্ণের রিজার্ভের সত্তর শতাংশের বেশি চলে যায় আমেরিকার কব্জায়।
যুদ্ধের পর বিশ্বের নানা দেশে শুধু সারি সারি লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল এমনটা নয়। এ সময় পুরো বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতিতেই একরকম লালবাতি জ্বলে যায়। ফলে বিশ্বের ৪৪টি দেশ একত্রিত হয় ১৯৪৪ সালে। তারা নিজেদের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ‘Bretton Woods System’ নামে বিশেষ এক চুক্তি করে।
মূলত এই চুক্তির পর থেকেই বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে যায় যুক্তরাষ্ট্র। আর ডলার তাদের মুদ্রা হওয়ায় সহজেই বিশ্বের প্রতিটি দেশের মুদ্রার ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করে। কারণ, এই চুক্তির আলোকে সিদ্ধান্ত হয় যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুদ্রামান নির্ভারিত হবে মার্কিন ডলারকে আদর্শ ধরে। অন্যদিকে, প্রাথমিক পর্যায়ে মার্কিন ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা হয় বিশ্বের নানা দেশে অস্ত্র বিক্রি করে পাওয়া অস্বাভাবিক পরিমাণ রিজার্ভের স্বর্ণের উপর নির্ভর করে।
বিশ্বের প্রতিটি দেশের নিজস্ব মুদ্রা থাকলেও তা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয় না। সেজন্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে প্রয়োজন হয় ডলারের। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পাদনের জন্য প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে হলেও পুরোপুরি ডলারের উপর নির্ভরশীল। সহজভাবে বললে- তারা কোনো পণ্য আমদানি করতে গেলেও যেমন বিল পরিশোধ করে ডলারে, তেমনি পণ্য রপ্তানি করে তার মূল্যমাণ হিসেবে যা পায় তা-ও আসলে ডলার!
আপনারা সবাই কম-বেশি জানেন যে Federal Reserve Act ১৯১৩ সালে পাস হওয়ার পর Federal Reserve Bank-ও তৈরি করা হয়। অন্যদিকে, ডলার প্রথম ছাপা শুরু হয় ১৯১৪ সাল থেকে। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় পৃথিবীতে যে আর্থিক অস্থিরতা তৈরি হয়, সেই সুযোগে আমেরিকান অর্থনীতি ব্রিটিশ অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যায়। তবে তখনও গোটা বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্র ইংল্যান্ড থাকায় তাদের হাত ধরে বাণিজ্যের বেশিরভাগই ব্রিটিশ পাউন্ডে হতো। আর এখানেই পাউন্ডের স্থলে ডলারকে বসানোর সব সুযোগ সৃষ্টি করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণের বিনিময়ে আমেরিকার থেকে অস্ত্র কেনা দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মূলত বিশ্ব অর্থনীতির চাবি তুলে দেয় তাদের হাতে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ জার্মানির কাছে রামধোলাই খেয়ে তখন ধুঁকছে। তারা বিশ্বযুদ্ধ জয়ে আনন্দের বদলে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে মাতম করতে থাকে।
ঠিক তার বিপরীতে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বেশ নিরাপদে থাকতে পেরেছে। পাশাপাশি, অস্ত্র বিক্রি করে পাওয়া বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের রিজার্ভ তাদের অর্থনীতিকে সফল ও সচল রাখতে সাহায্য করে। মূলত এর মাধ্যমেই মার্কিন কংগ্রেসে ১৭৮৫ সালে প্রবর্তিত ডলার প্রায় দু’শো বছরের ব্যবধানে হঠাৎ করে প্রবল শক্তিশালী ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘হার্ড কারেন্সি হিসেবে পরিগণিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও কিছু দেশ ডলারকে সরকারি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করায় সেটাও বিশ্বের নানা স্থানে সর্বাধিক প্রচলিত মুদ্রা হওয়ার মূল কারণ। আন্তর্জাতিক ব্যবহারের জন্য একাধারে ‘দেনা-পাওনা মেটানো’ আর ‘রিজার্ভ কারেন্সি’- দু’ভাবেই ডলার তার আধিপত্য বিস্তার করেছে। ইউরো প্রচলনের পর মার্কিন ডলারের প্রভাব সাময়িকভাবে কমে গেলেও তার অবস্থান আবার তুঙ্গে।
বিশ্বজুড়ে ডলারের দাপটের মূল কারণ ‘রিজার্ভ মুদ্রা’ তথা ‘বৈশ্বিক মুদ্রা’ হিসেবে এর ব্যবহার। এটি এমন একটি মুদ্রাব্যবস্থা যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত। এই মুদ্রা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সঞ্চয় করে রাখার মাধ্যমেই তাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। কারণ, পুরো বিশ্বে যত লেনদেন হয় তার শতকরা ৮৫ ভাগ এই রিজার্ভ তথা ডলারের উপরেই নির্ভরশীল।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অর্থাৎ আইএমএফ-এর তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভের প্রায় ৫৯ শতাংশই মজুত রাখা হয় ডলারে। প্রায় ২০ শতাংশ রিজার্ভ রয়েছে ইউরোতে। জাপানের ইয়েন এবং ব্রিটিশ পাউন্ডের সম্মিলিত সংরক্ষণও কোনোভাবে ১০ শতাংশের কোটা পার করতে পেরেছে রিজার্ভ হিসেবে। আর এজন্যই ডলারের আগে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তারকারী ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডকে ১৯২০ সালের দিকে হটিয়ে দিতে পেরেছে ডলার।
ঔপনিবেশিক যুগে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের মুদ্রা বিশ্বের নানা প্রান্তের উপনিবেশের দাপট দেখিয়েছিল। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনসহ বেশিরভাগ দেশ বাধ্য হয়ে ‘স্বর্ণমান’ থেকে সরে গিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির কবর রচনা করে। আর সেক্ষেত্রে ‘গোড়খুঁড়ে’ হিসেবে যদি আবির্ভাব হয় যুক্তরাষ্ট্রের, নিঃসন্দেহে ডলার হয়ে ওঠে তাদের হাতে ‘কোদাল কিংবা খন্তা’।
সোনার মানের ওপর নির্ভরশীলতা না থাকায় তখন মুদ্রার মানকে বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে সোনার মান নির্দিষ্ট থাকেনি। চাহিদা আর জোগানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে তার অনবরত উত্থান-পতন ঘটতে থাকে। বিকল্প উপায় হিসেবে ‘ফিয়াট মানি’ বিকাশলাভ করে। এতে একসময়ের প্রচণ্ড শক্তিশালী ব্রিটিশ মুদ্রা ‘পাউন্ড স্টার্লিং’-এর কোমর ভেঙে যায়। একইসঙ্গে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
ডলার ধীরে ধীরে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার মূল গল্পটা লেখা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই। জার্মানির উত্থান ঠেকাতে গিয়ে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ তখন দুনিয়া থেকেই উৎখাত হওয়ার পথে। ইউরোপীয় দেশগুলোর মরণখেলা আর ধ্বংসাত্মক সংগ্রাম বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় যুদ্ধের ব্যয়। এই ব্যয়ভার বহনের সক্ষমতা তাদের ছিল না। তারা বাধ্য হয়ে স্বর্ণ মজুতের বিপরীতে যে পরিমাণ মুদ্রা ছাপানো যেত, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কাগুজে নোট ছাপাতে শুরু করে। এই নোট বাজারে গিয়ে ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তোলে মূল্যস্ফীতি, আর পঙ্গু করে দেয় তাদের অর্থনীতি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা একটু আগেই আঁচ করতে পারা যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বছরতিনেক নিজেকে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখে। উপরন্তু, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেয় প্রায় আড়াই বছর পর। তারা এই সময়ে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে সামরিক সরঞ্জাম ও রসদপত্র রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়। এর মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। তখনও যুক্তরাষ্ট্র তার রপ্তানিকৃত দ্রব্য সোনা ছাড়া অন্য কিছুর বিনিময়ে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
যুদ্ধ সরঞ্জাম ও অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে সোনাকে মানদণ্ড মনে করার নীতির ফলে আরেকদফা ফুলেফেঁপে উঠেছিল মার্কিনীদের স্বর্ণের মজুদ। ১৯৪৭ সালের দিকে তাই বিশ্বের মোট মজুতকৃত সোনার ৭০ শতাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেফাজতে চলে যায়। বিপরীতে যুদ্ধবিধ্বস্তে ইউরোপে একদিকে খাদ্য সংকট, অন্যদিকে মানুষের হাতে কাজ নেই। এমন অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভয়ানক ঋণী হয়ে তাদের রিজার্ভ থেকে প্রচুর স্বর্ণ হারিয়ে ফেলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলো তাদের মুদ্রার বিপরীতে সোনা মজুত করে রাখার কাজে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। আর সেজন্যই ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডসে ৪৪টি ধনী দেশের সমন্বয়ে একটি সভায় মিলিত হয়। মজুতকৃত স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে ডলার স্থিতিশীল থাকায় তখন ৪৪টি দেশই ডলারকে তাদের রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে মেনে নেয়। ফলে ঐসব দেশের মুদ্রার বিনিময়মূল্য নির্ধারিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের ওপর ভিত্তি করে। বিপরীতে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের মজুদ থাকায় ডলারের মূল্য নির্ধারিত হয় তখন সোনার ওপর ভিত্তি করে।
আপনারা বুঝতেই পারছেন যে, ১৯৪৭ সালের দিকে বিশ্বের মজুত করা সোনার ৭০ শতাংশ যখন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে গিয়েছিল, আসলে তখন থেকেই বিশ্ব অর্থনীতির লাগামটাও পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে। একদিকে বিপুল সোনার মজুত, অন্যদিকে ডলারের স্থিতিশীল মূল্যমান। তাই বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ডলার সংরক্ষণের কোনো বিকল্প ছিল না। আর তখন থেকেই ডলারের যে আধিপত্য শুরু হয়, তার থেকে মুক্তি মেলেনি বিশ্ববাসীর।
বিশ্বের উপর ডলারের নিয়ন্ত্রণ আরও নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে ১৯৭৩ সালের দিকে সৃষ্ট মধ্যপ্রাচ্যের তীব্র উত্তেজনার পথ ধরে। ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন এক ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন। তাদের চুক্তি অনুযায়ী, “সৌদি আরব থেকে বিশ্বের যেসব দেশ জ্বালানি তেল আমদানি করবে, তাদের মূল্য পরিশোধ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারে। বিনিময়ে সৌদি আরবকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র।” মাত্র দুই বছর যেতে না যেতেই ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেকও সবাইকে অবাক করে দিয়ে সৌদি আরবের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেল বিক্রির সব অর্থ পরিশোধের জন্য সবাইকে ডলারের দিকেই ঝুঁকতে হয়েছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে তেলের মূল্য পরিশোধে ডলারের ব্যবহার তাদের অর্থনীতিকেও স্থিতিশীল ও ধারাবাহিক করে। সৌদি মুদ্রা হিসেবে তখন রিয়ালের বিপরীতে ১ ডলার = ৩ দশমিক ৭৫ সৌদি রিয়াল বেধে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে সৌদি অর্থনীতির উত্থান-পতন অনুভব করা যায়নি আমেরিকার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের কারণেই।
ডলার ও রিয়ালের এই হার ওঠানামা না করায় সৌদি আরব একক সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একইভাবে সৌদি আরবের চুক্তির কারণে অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশকেও এই চুক্তি মেনে নিতে হয়। আর সেজন্যই ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেকও অভিন্ন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সৌদি আরবের মতোই আচরণ করে। ফলে তেলের মতো সবার কাছে প্রয়োজনীয় উপাদান আমদানির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যখন মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তাদের সামনে ত্রাণকর্তা হয়ে তখন দেখা দেয় মার্কিন ডলার।
ধীরে ধীরে সময় পেরিয়ে গেছে। একটা পর্যায়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ বলতে বাধ্য হয়েছে, ‘ডলার ছাড়া আমার চলেই না’! বিপরীতে এই বিশেষ অবস্থাকে আরও পাকাপোক্ত করতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, আর হয়েছেও তা-ই। অন্তত ১৯৭১ সালে সবাইকে অবাক করে নতুন ঘোষণা আসে।
তখন যুক্তরাষ্ট্র ব্রেটন উডস সিস্টেমকে কাঁচকলা দেখিয়ে সোনার ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি বাতিল করে দেয়। ‘নিক্সন শক’ নামে পরিচিত ভয়াবহ এই অর্থনৈতিক অঘটন স্বর্ণের দামকে অনির্দিষ্ট করে দেয়। পাশাপাশি সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ডলার হয়ে যায় ‘ফিয়াট’ তথা ভাসমান মুদ্রা। আর এই ভাসমান মুদ্রায় সোনার রিজার্ভের তথা গোল্ডের ওপর নির্ভরতা না থাকায় তা ডলারকে স্বর্ণ থেকে স্বাধীনতা পাইয়ে দেয়। অন্তত এভাবেই ডলার বিশ্বজুড়ে হয়ে উঠেছে একক ও অভিন্ন মুদ্রা, আর এক অর্থে বর্তমান বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে এই ডলারই।