কামরূপ কামাখ্যার আসল ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
ঘন বনের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাওয়া নির্জন পথ পেরিয়ে একটা অগ্নিকুন্ড, থরে থরে সাজিয়ে রাখা মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণির খুলি, বিচিত্র সব আঁকিবুকি নিয়ে প্রায় উদোম শরীরে দাঁড়িয়ে উদ্যাম নৃত্যে লিপ্ত তান্ত্রিক আর অন্ধভক্ত অগণন দর্শনার্থী– এমন বর্ণনা শোনার পর যদি নাম না বলা হয়, তবুও যে কেউ ধরে নেবেন গল্পটা জাদুবিদ্যা আর তন্ত্রমন্ত্রের পীঠস্থান ‘কামরূপ কামাখ্যা’ নিয়েই বলা হচ্ছে।
ইতিহাসের গল্পের শ্রোতা-দর্শকরা দীর্ঘদিন থেকেই এই ব্যাপারে প্রশ্ন করছিলেন। আপনাদের দীর্ঘ অনুরোধ আর আগ্রহের প্রেক্ষিতে এবারের নিবেদন ‘কামরুপ কামাখ্যা’। নানাজনের কাছে শোনা গল্পের কতটুকু সত্য, ইতিহাস এই তন্ত্রমন্ত্রকে কতটা আপন করে নিয়েছিল, আর বাস্তবতার নিরীখে এর ঐতিহাসিক মূল কতটুকু তা আসুন যাচাই করে দেখা যাক।
শুরুটা সেই বারাণসীর বৈদিক ঋষি বাৎস্যায়নের গল্প থেকে। তিনি খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে নেপালের রাজার দ্বারস্থ হন। সেখানে আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করার অনুরোধ ছিল। পাশাপাশি নরবলির গ্রহণযোগ্য বিকল্প চালুর চেষ্টা চালান তিনি।
বাৎস্যায়ন লিখে গেছেন, “পূর্ব হিমালয়ের গারো পাহাড়ে তারা দেবীর তান্ত্রিক পূজা প্রচলিত ছিল। সেখানে আদিবাসীরা দেবীর যোনিকে ‘কামাকি’ নামে পূজা করত। ব্রাহ্মণ্যযুগে কালিকাপুরাণে সব দেবীকেই মহাশক্তির অংশ বলা হয়েছে। সেই হিসেবে, কামাখ্যাও মহাশক্তির অংশ হিসেবে পূজিত হন।”
প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের বর্মণ রাজবংশের শাসনকালে (৩৫০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ) এই কামাখ্যা মন্দিরের গল্পের শুরু। সপ্তম শতকের দিকে চৈনিক পর্যটক জুয়ান জ্যাং তথা হিউয়েন সাং কামাখ্যা নিয়ে তেমন কিছুই বলেননি। তখন কামাখ্যাকে অব্রাহ্মণ এবং কিরাত জাতীয় উপাস্য দেবী মনে করা হয়েছিল।
নবম শতকের দিকে ম্লেচ্ছ রাজবংশের বানমল বর্মদেবের তেজপুর লিপিতে প্রথম কামাখ্যার কথা জানা গিয়েছে। তেজপুর শিলালিপির ভাষ্যে, অষ্টম-নবম শতকের দিকে এখানে একটি বিশালাকৃতির মন্দির নির্মাণ করা হয়। কিন্ত কে এবং কীভাবে এই মন্দির নির্মাণ করেন না নিয়ে বিস্তৃত কিছু বলা হয়নি।
কামাখ্যা মন্দিরের নির্মাতা হিসেবে নাম পাওয়া গিয়েছে কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহের। ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার পাশাপাশি এই মন্দিরে পূজার পুনর্প্রবর্তন করা হয় তার সময়েই। তারই ছেলে নরনারায়ণের রাজত্বকালে ১৫৬৫ সালে নতুনভাবে মন্দিরের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এসময় নির্মাণকাজে পুরনো মন্দিরের উপাদান ব্যবহার করা হয়। এরপর অহোম রাজ্যের রাজারা মন্দিরটি আরও বড় করে তোলার পাশাপাশি অন্যান্য মন্দির পরে নির্মাণ করা হয়।
কামাখ্যার গল্প কিংবা ইতিহাসের শুরু অনেকাংশে এখান থেকেই। আর কালিকা পুরাণের সূত্র দিয়ে সেখানে বলা হয়, কামাখ্যা মন্দিরে সতী শিবের সঙ্গে বাস করেন। গবেষক বানীকান্ত কাকতি (Banikanta Kakati) ১৯৮৯ সালের দিকে ‘The Mother Goddess Kamakhya’ শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি গোহাটী থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থে লিখেছেন, “দেবী সতীর মৃতদেহ থেকে যোনির অংশটি বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।” আর তারপর থেকেই এই এলাকার মন্দিরে যোনিপূজার প্রচলন শুরু হয়ে থাকতে পারে।
প্রখ্যাত দেবীভাগবত পুরাণের ১০৮ পীঠের তালিকায় এই তীর্থের নাম না থাকলেও বানীকান্ত কাকতি তার লেখায় উল্লেখ করেছেন যে অপর একটি তালিকায় কামাখ্যা নাম পাওয়া যায়। ওদিকে, যোগিনী তন্ত্রে অবশ্য কালিকা পুরাণের মতকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সেখানে ‘কামাখ্যা কালী’ কথাটি সরাসরি বলা হয়েছে। পাশাপাশি, যোনির প্রতীকী আরাধনার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
কামাখ্যা মন্দিরে স্থানীয় গায়কদের ধর্মীয় সংগীতের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আরও নানা কর্মযজ্ঞ অনেকের দৃষ্টিগোচর হতে পারে। সেখানে তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র হওয়ায় বার্ষিক অম্বুবাচী মেলার আয়োজন বেশ জনপ্রিয়। এই অনুষ্ঠানে প্রচুর জনসমাগম ঘটে। ওদিকে, বার্ষিক মনসা পূজাও মহাসমারোহে আয়োজিত হয় এই এলাকায়। দুর্গাপূজাও কামাখ্যা মন্দিরের একটি অন্যতম প্রধান উৎসব হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
স্থানীয় অনেক গবেষক দাবি করেছেন, প্রাচীনকালে কামাখ্যা ছিল খাসি এবং খাড়িয়া আদিবাসীদের বলিদানের জায়গা। তাদের সেই উৎসবের ধারাবাহিকতায় এখনও বলিদান চালু আছে। তারা এখানে পূজার অংশ হিসেবে বলিদান চালু রেখেছে। অনেক দেবীভক্ত এখানে উপাস্যকে খুশি করার উদ্দেশ্যে পাঁঠা বলির আয়োজন করেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, এই বলিদান চলে আসছে শত-সহস্র বছর ধরে। সাধারণত ফুল দিয়ে এই মন্দিরের পূজা সম্পন্ন হলেও মাঝে মাঝে পশুবলি হয়।
আসামের নানা দেব-দেবীর মতো দেবী কামাখ্যার পূজাতেও আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ দৃষ্টিগোচর হয়। কারণ, এখানে কামাখ্যা দেবীকে যে নামে পূজা করা হয়, তার মধ্যে অনেক স্থানীয় আর্য ও অনার্য দেব-দেবীর নাম চলে আসে। যোগিনী তন্ত্র অনুযায়ী, তাদের এই যোগিনী পীঠের ধর্মের উৎস অনেকটাই কিরাতদের ধর্ম থেকে এসেছে।
বাণীকান্ত কাকতি মনে করেন, গারো সম্প্রদায়ের মানুষ একসময়ে কামাখ্যায় শূকরও বলি দিয়েছিল। পরে এই প্রথা নরনারায়ণ-কর্তৃক নিযুক্ত পুরোহিতদের মধ্যেও দেখা গিয়ে থাকতে পারে। কারণ, কামাখ্যার মন্দিরে পূজা-অর্চনার ক্ষেত্রে বামাচার ও দক্ষিণাচার উভয় মতই অনুসৃত হয়। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, দক্ষিণাচার একটি তান্ত্রিক আচারানুষ্ঠানের ধাঁচ। দক্ষিণাচারে নাস্তিক্যবাদী আচার-অনুষ্ঠানগুলোকে অস্বীকার করে বিশ্বাসীদের গুরুত্ব প্রদান করে হয়। অন্যদিকে এই আচারের বিপরীতে হিন্দুধর্মের সাধারণ রীতিনীতি ও সামাজিক রীতিবিরুদ্ধ তান্ত্রিক আচারকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘বামাচার’ নামে।
ভক্তদের সব আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে কালিকা পুরাণ। এই পুরাণের ভাষ্যমতে, “কামাখ্যায় পূজা করলে সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয়।” কারণ, তাদের হিসেবে শিবের তরুণী স্ত্রী ও মোক্ষদাত্রী শক্তিকেই কামাখ্যা নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, এই কালিকা পুরাণ খ্রিস্টীয় দশম শতকের দিকে রচিত একটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। অষ্টাদশ উপপুরাণের অন্যতম এই পুরাণের প্রাপ্ত পাঠে ৯৮টি অধ্যায় ও ৯,০০০ শ্লোক রয়েছে।
কালিকা পুরাণে কালী ও তার কয়েকটি বিশেষ রূপের বর্ণনা রয়েছে। সেখানে গিরিজা, ভদ্রকালী ও মহামায়ার উদ্দেশ্যে অনেকগুলো শ্লোক ঠাঁই পেয়েছে। তৎকালীন একমাত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে জনপ্রিয় এই পুরাণে কামরূপ তীর্থের আশেপাশের পরিবেশ, ভূ-প্রকৃতি, পাহাড়-পর্বত ও নদনদীর কথা তুলে ধরা হয়েছে। পরিবেশের বিস্তৃত বর্ণনার পাশাপাশি এখানে কামাখ্যা মন্দিরের বিস্তারিত বর্ণনাও রয়েছে।
কালিকা পুরাণ কামাখ্যার আলোচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সূত্র এই কারণে যে, এখানে কালী, কামাখ্যা ও দুর্গাসহ বিভিন্ন দেবীর পূজাপদ্ধতি লিপিবদ্ধ আছে। হিন্দুধর্মের শাক্ত শাখার মূল ধর্মগ্রন্থ হিসেবে এখনকার বর্ণনায় কামাখ্যার উল্লেখ থাকা এবং পূজাপদ্ধতিতে কালীসাধনাসহ নানা উপায়ের সংযুক্তি এই অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি কামাখ্যার মন্দিরটি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন জনপ্রিয় লেখালেখিতে যেভাবে ‘১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নীলাচল পর্বতে মঙ্গোল আক্রমণ’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তা পুরোপুরি হাস্যকর এবং অনৈতিহাসিক। ১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আসামসহ কাছাড় কমপ্লেক্সের যেসব প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া যায়, তার আলোকে যে কেউ সহজেই অনুমান করতে পারবেন, একটা মন্দির গড়ে তোলার মতো সক্ষমতা এই অঞ্চলের মানুষের ছিল না। সাধারণ প্রাগৈতিহাসিক কিছু হাতিয়ার প্রাপ্তি এই পাহাড়ি এলাকায় প্রাথমিক মানববসতির ধারণা দেয় মাত্র। পাশাপাশি, পরবর্তীকালীন আরও কিছু আক্রমণের ব্যাপারে কথা প্রচলিত থাকলেও এর গ্রহণযোগ্য তথ্য-প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
যা-ই হোক, আসামের শিবসাগর ও শুয়ালকুচি এলাকার দুটি মন্দিরের সঙ্গে কামাখ্যার এই মন্দিরের বিশেষ মিল রয়েছে। সেখানকার এই দুটি এলাকার ‘জয় দেউল’ এবং ‘সিদ্ধেশ্বর দেবালয়’ ঠিক কামাখ্যার এই মন্দিরের মতো গঠনশৈলীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রচলিত হিন্দু স্থাপনার সঙ্গে একটু উল্টোপথে উল্টোরথে চলা এই স্থাপত্যের সঙ্গে অনেকটা মিল রয়েছে রথ ধাঁচের স্থাপত্যের, যাকে বলা হয় ‘নীলাচল স্থাপত্যরীতি’।
ভারতে মন্দির স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে উড়িষ্যার প্রখ্যাত দেউল রীতি বেশি জনপ্রিয়। তাদের ধারা অনুসরণ করে রেখা দেউল, পীড় দেউল কিংবা খাকড়া দেউলই বেশিরভাগ এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্ত পাহাড়ী এলাকা আসামে এই রীতির বাইরে গিয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ভিন্ন একটি ধারাকে। আর সেখানে মন্দিরের শিখর বেশি উপরে ওঠেনি। উপরন্ত, মুসলিম স্থাপত্যের গম্বুজ ধাঁচের প্রাধান্য বেশি।
কামাখ্যা মন্দিরে রয়েছে চারটি বিস্তৃত কক্ষ। সেখানে আলাদাভাবে গড়ে তোলা হয়েছে গর্ভগৃহ এবং তিনটি মণ্ডপ। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির হিসেবে। তবে কামাখ্যা মন্দিরের গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মাণ করা হয়েছে।
কামাখ্যা মন্দিরের অন্য স্থাপনাগুলো তেজপুরের সূর্যমন্দিরের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অনেকগুলো যৌন উত্তেজক স্টাকো ও খোদাইচিত্র। ভারতের মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো ধারার মন্দিরগুলোতে এই ধরনের যৌনাবেদনময় খোদাইচিত্র রয়েছে অনেক।
দেউল স্থাপত্যের সঙ্গে এর আরও একটি পার্থক্য রয়েছে। এখানে মন্দিরের চূড়া নির্মাণ করা হয়েছে অনেকটাই মৌচাকের মতো করে। তবে কামাখ্যা মন্দিরের গর্ভগৃহটি প্রকৃতপক্ষে ভূগর্ভস্থ একটি গুহার বিবর্তিত রূপ। এখানে উপাসনার উদ্দেশ্যে কোনো মূর্তি রাখা হয়নি। ক্ষুদ্র ও অপরিসর একটি পাথরের সরু গর্ত নিয়ে গঠিত এই গর্ভগৃহ আকৃতির দিক থেকেও বেশ ছোট ও অন্ধকার।
গর্ভগৃহে প্রবেশের জন্যও বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। বিশেষ করে অনেক কম প্রশস্ত একটি খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে পৌঁছানো যায়। এর ভেতরেই একটি বিশেষ গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের পাথরখণ্ড চোখে পড়ে। অনেকটাই যোনি আকৃতির এই পাথরে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর একটি গর্তও রয়েছে। পাহাড়ের সরু কোনো চিড় থেকে বেয়ে আসা পানিতে এই যোনি আকৃতির গর্তটি ভরে থাকে। ভক্তরা একেই দেবী কামাখ্যা নামে পূজা করেন।
কামাখ্যা মন্দির চত্বরের অন্যান্য মন্দিরেও একই রকম যোনি-আকৃতির পাথর রয়েছে। সেগুলোও অজ্ঞাতনামা পাহাড়ি ফাটল থেকে বয়ে আসা পানিতে ভর্তি রাখা হয়। ভক্তরা প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে অম্বুবাচী মেলার সময় কামাখ্যা দেবীর ঋতুমতী হওয়ার ঘটনাকে উদযাপন করে। তখন মূল গর্ভগৃহে অবস্থিত পাথুরে গর্তের পানিতে প্রচুর আয়রন অক্সাইড যুক্ত থাকে। ফলে তা দৃশ্যত টকটকে লাল হয়ে থাকে।
ভক্তদের মতে, একে ঋতুস্রাবের মতো দেখায়, আর তারা সেখানেই অলৌকিক শক্তির উৎস ও রহস্য সন্ধান করে। দেবী কামাখ্যা নামে পাথরের মধ্যে যোনি আকৃতির পানিভর্তি গর্তের পাশাপাশি মন্দিরের বাইরে গণেশ ও অন্যান্য হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তিও দৃশ্যমান। পাশাপাশি, এখানে নরনারায়ণ এবং নানা দেব-দেবী সম্পর্কিত শিলালিপি রয়েছে।
অহোম রাজত্বের সময়েই কামাখ্যার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। জনশ্রুতি আছে, ‘কোচবিহার রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই মন্দির পরিচালনা কষ্টকর হয়ে ওঠে। ১৬৫৮ সালে অহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহ নিম্ন আসাম জয় করলে এই মন্দির সম্পর্কে তাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। অহোম রাজারা শাক্ত বা শৈব ধর্মাবলম্বী হতেন। তারাই এই মন্দির সংস্কার ও পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব নিতেন’। Journal of Assam Research Society-তে প্রকাশিত ‘A Study of Temple Architecture Under Ahoms’ প্রবন্ধে পি. শর্মা এই কথাগুলো উল্লেখ করেছেন। এরপর রাজা রুদ্র সিংহ (রাজত্বকাল (১৬৯৬-১৭১৪) ও মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে শিব সিংহ (রাজত্বকাল ১৭১৪-১৭৪৪) রাজা হন।
রাজা শিব সিংহ কামাখ্যা মন্দির ও পার্শ্ববর্তী বিরাট একটি ভূখণ্ড দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করেন। তাকে ও তার বংশধরদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ‘পর্বতীয়া গোঁসাই’ নামে। তারা নীলাচল পর্বতের উপরে বাস করতেন। পরবর্তীকালে কামাখ্যা মন্দিরের অনেক পুরোহিতের পাশাপাশি বর্তমান আসামের অনেক শাক্ত এই পর্বতীয়া গোঁসাইদের শিষ্য হিসেবে সুবিদিত।
যতটুকু ইতিহাস, ঠিক ততটুকুই গল্প, আর অল্প একটু রহস্য মিলে মিশে একাকার হয়েছে কামরূপ কামাখ্যার কথকতা। যেকোনো দর্শনার্থী গেলেই দেখতে পাবেন, মন্দির চত্বরে প্রচণ্ড ভিড়। ‘সবাই জাদু মন্ত্রপূত কামরূপ-কামাখ্যা দেখার জন্যই গিয়েছেন’- এমন কথা বলাটা অন্যায়। কারণ, অনেকেই সেখানে গিয়েছেন মনের না বলা কথাগুলো বলে আসতে। আর অনেক অপ্রাপ্তির বেদনা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে।
বিশালাকৃতির মন্দির চত্বরে থরে থরে সাজানো রঙিন ফুলের সমারোহ। মন্দিরের পাথুরে দেয়াল ছেয়ে আছে নানা দেবদেবীর প্রতিকৃতি, মূর্তি আর ফুল-লতা-পাতার বিচিত্র নকশা। বেশ কিছু মূর্তি সেখানে রয়েছে কাচের বাক্সে বাধাই করে রাখা। আর তার মধ্যে কিছু কিছু ছড়িয়ে আছে মন্দিরের চত্বরে। কামাখ্যা মন্দিরের সেই মূল অংশ। অর্থাৎ টকটকে লাল পানিতে ভরা পাথরখণ্ড ও গর্তটি দেখার সুযোগ সবার হয় না। তবে ‘কামাখ্যায় পূজা করলে সব ইচ্ছা পূর্ণ হয়’ এমন বিশ্বাস নিয়ে তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীরা ভিড় করেন সেখানে।
মানত নিয়ে কামাখ্যা মন্দিরে যারা এসেছেন তাদের অনেকেই ‘পাঁঠা কিংবা কবুতর’ বলি দিয়ে থাকেন। এখানে অতি আগ্রহী অনেককে মানত পূরণে সিঁড়িতে কিংবা চত্বরে দণ্ডি কাটতেও দেখা যায়। পাশাপাশি, তাদের অনেকে মন্দির চত্বরের গাছে হলুদ–লাল মন্ত্রপূত সুতা বাধেন। অনেক মোমবাতি কিংবা প্রদীপ জ্বালান। কারণ, তাদের বিশ্বাসে ১৮টি মহাশক্তি পিঠের একটি হচ্ছে এই কামাখ্যা। তাই ইচ্ছা পূরণে কিংবা স্ব স্ব তান্ত্রিকশক্তি বৃদ্ধির আশায় এখানে ভিড় বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর ‘অন্ধকারে আলোর রেখা’ শীর্ষক বইটি যারা পড়েছেন, তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে পারে জাদুমন্ত্র, বশীকরণ কিংবা প্রেতসাধনার মতো বিষয়গুলো। আর সেখানে বারংবার ঘুরে ফিরে আসে কামরূপ কামাখ্যার নাম। অনেকে বলেন, মন্ত্রপূত নানা সাধনার বাইরে কালাজাদু থেকে মুক্তির পথও পাওয়া যায় এই কামাখ্যায়। আর সেজন্য বিভিন্ন পূজা কিংবা হাওভানে সময় লেগে যেতে পারে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার উপরে।
কালোজাদু থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে কামরূপ কামাখ্যায় যে পদ্ধতিগুলোর আশ্রয় নেওয়া হয় তার মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে স্থাপনা, শাস্ত্রীয় বচন, গণেশ পূজা, নবগ্রহ পূজা, কামাখ্যা দেবীর আরাধনা এবং দেবী কালীর দশটি রূপের পূজা। তার এই দশটি বিশেষ রূপ সমষ্টিগতভাবে ‘দশমহাবিদ্যা’ নামে খ্যাত।
তান্ত্রিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মুণ্ডমালা তন্ত্র অনুসারে দশমহাবিদ্যা হিসেবে ‘কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা’ নামগুলো এসেছে। তবে, তাদের এই মহাবিদ্যার সংখ্যা নিয়ে মতান্তর দৃশ্যমান। অনেকে মনে করেন, মহাবিদ্যার সংখ্যা ২৭ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাদের হিসেবে দুর্গা, কামাখ্যা ও অন্নপূর্ণাও মহাবিদ্যার অংশ।
মালিনী বিজয় গ্রন্থ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মহাবিদ্যার মধ্যে পড়েন ‘কালী, নীলা, মহাদুর্গা, ত্বরিতা, ছিন্নমস্তিকা, বাগ্বাদিনী, অন্নপূর্ণা, প্রত্যঙ্গিরা, কামাখ্যাবাসিনী, বালা, হিংলাজ, ডাম্রী, মাতঙ্গী ও শৈলবাসিনী’। কামরূপ কামাখ্যার দেবী আরাধনার অংশ হিসেবে এর থেকে বাদ পড়েননি তেমন কেউ।
জাদুটোনা ও মন্ত্র থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ২১ হাজার মন্ত্র উচ্চারণ করে মুক্তির পথ অনুসন্ধান করেন কামরূপ কামাখ্যায় এসে। এর বাইরে আরও নানা রকম হাওভান ও আহুতির প্রচলনও এখানে রয়েছে। কেউ কেউ আরতি এবং পুষ্পাঞ্জলির মধ্যেও মুক্তির পথ খুঁজছেন।
কামরূপ কামাখ্যার রহস্যের জাল ছেদ করতে গিয়ে ইচ্ছে অনিচ্ছেয় অনেকে জন্ম দিয়েছেন আরও অনেক রহস্যের, যেগুলো এখনও এই ‘কামরূপ কামাখ্যা’ নামের মধ্যেই হতবাক করে রাখে অনেককে। তাই তাদের কাছে কামরূপ কামাখ্যা মানেই একগুচ্ছ জাদুমন্ত্র আর তার গুরুগম্ভীর উচ্চারণ।