নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
পশ্চিমে কাথিয়াওয়াড়, উত্তরে সুবিস্তৃত হিমালয় পর্বত, আর সুদূর দক্ষিণে প্রমত্তা নর্মদা নদী। এই দীর্ঘ ভৌগোলিক পরিসরে বিস্তার লাভ করে গুপ্ত সাম্রাজ্য। কুমারগুপ্ত মহেন্দ্রাদিত্য তথা ইতিহাসের চিরচেনা প্রথম কুমারগুপ্তের শাসনকাল তখন। আর ঠিক এ সময়েই, অর্থাৎ ৪১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা পায় এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নালন্দা।
এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কতই না গল্প, তর্ক-বিতর্ক আর ঝগড়া-বিবাদ চলমান! এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের ইতিহাস নিয়ে সবাই এতটাই মশগুল যে খুব কম মানুষই জানতে চায় এর প্রতিষ্ঠাতার নাম।
ত্রিপক্ষ সংঘর্ষের ভাগ্যজোর পাল রাজা ধর্মপালের শক্তিমত্তা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। তিনি আগবাড়িয়ে জারি করেন খালিমপুর তাম্রশাসন। আর সেখানে বিধৃত গল্পের সত্যটা কতটুকু, তা নিয়ে চিন্তার অবসরে আরও কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে হয় ইতিহাস গবেষকদের। কারণ, তার সময়েই একে একে বিক্রমশীলা, সোমপুর ও ওদন্তপুরী বিহারও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। আর তার সূত্র ধরেই মূলত নালন্দা মহাবিহারে জ্ঞানচর্চার গতি ত্বরান্বিত হয়েছিল।
নালন্দা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেন চৈনিক পর্যটক জুয়ান জ্যাং তথা হিউয়েন সাং। তার অবস্থানকালে নালন্দায় প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণের খবর পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের দিকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১০০টি শ্রেণীকক্ষে হাজারবিশেক শিক্ষার্থীকে পাঠদানের কথা জানা যায়। কোরিয়া, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তুরস্ক, তিব্বতসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে আগত শিক্ষার্থীরা তখন নালন্দার ক্যাম্পাসকে মুখরিত করেছিল।
যা-ই হোক, সৃষ্টির আগে কখনও ধ্বংস নিয়ে আলোচনা করতে দেখেছেন? ইতিহাসের বাঁকবদলে সেই অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাস গবেষকরা। উদ্ভট বাক্যালাপ আর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মনগড়া ব্যাখ্যা বিপন্ন করেছে ইতিহাস সংশ্লিষ্ট সবাইকে। প্রথম কুমারগুপ্ত মহেন্দ্রাদিত্য এই বিহার নির্মাণের পর তার উত্থান-পতন নিয়ে লিখেছেন আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন থেকে শুরু করে হাল আমলের অদ্রে ত্রুশকে (Audrey Truschke)।
আধুনিকতম গবেষণা হিসেবে সবার আগে আমরা আলোচনায় আনতে পারি অদ্রে ত্রুশকের ‘The Power of the Islamic Sword in Narrating the Death of Indian Buddhism’ শীর্ষক গবেষণাপত্র। এখানে তিনি নালন্দার ধ্বংস নিয়ে উপযুক্ত তথ্যসূত্র সামনে রেখে বিস্তৃত আলাপের চেষ্টা করেছেন।
এখানে ত্রুশকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন পিটার হার্ভের (Peter Harvey) ২০১৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ ‘An Introduction to Buddhism: Teachings, History and Practices’-কে। পাশাপাশি দিউয়ান চাঁদ আহিরের (D. C. Ahir) লেখা ‘Buddhism Declined in India: How and Why’ থেকেও বিকল্প সূত্র গ্রহণ করেছেন তুশকে। আর এজন্যই ‘The Power of the Islamic Sword in Narrating the Death of Indian Buddhism’ শীর্ষক লেখার ৪০৭ নং পৃষ্ঠায় তিনি তথ্যগুলোকে নতুন করে যাচাই করে দেখার কথা বলেছেন।
ত্রুশকে তার গবেষণায় সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলো পেয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ম্যাকিয়নের (McKeown, A. P.) ডক্টরাল অভিসন্দর্ভে। এই গবেষণায় [From Bodhgayā to Lhasa to Beijing: The Life and Times of Śāriputra (c. 1335-1426), Last Abbott of Bodhgayā] তিনি দাবি করেছেন, “Buddhism went extinct or nearly extinct from South Asia in the early second millennium.” এখানে তিনি হাসমুখ ধীরাজলাল শানকালিয়ার (Hasmukh Dhirajlal Sankalia) তথ্যসূত্র সামনে রেখে প্রচলিত ইতিহাসবিদদের বারংবার উত্থাপিত অভিযোগের কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রত্নতাত্ত্বিক শানকালিয়া নালন্দা বিষয়ক গ্রন্থের (University of Nalanda) ২০৮ নং পৃষ্ঠায় সরাসরি উল্লেখ করেছেন, “The history of the end of Nalanda, hence, is, in a sense, the history of the extinction of Buddhism from the land of its birth.” কিন্ত উপযুক্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে, বিশেষত মার্শাল হজসনের (Marshall Hodgson) বক্তব্য উত্থাপন করে, ত্রুশকে এই ধারণা বাদ দিতে চেয়েছেন।
ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস থেকে ১৯৭৪ সালের প্রকাশিত ‘দ্য ভেঞ্চার অব ইসলাম’ (The Venture of Islam) গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের ৫৭৭ নং পৃষ্ঠায় মার্শাল হজসন (Marshall G. S. Hodgson,) উল্লেখ করেন, “প্রচলিত ইতিহাসবিদদের বয়ান অনুযায়ী- বৌদ্ধরা সরাসরি তরবারির আঘাত কিংবা আক্রমণের ভয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেনি। তারা এক্ষেত্রে একটু ভিন্ন পথ নিয়েছিলেন। তারা চেষ্টা করেছেন নতুনভাবে রাজক্ষমতায় আসা মুসলিমদের থেকে সুবিধা নিতে। পাশাপাশি অনেকের কাছে বৌদ্ধধর্মের প্রচলিত রীতিনীতিকেও সেকেলে মনে হয়েছে। একই কথা বারংবার বলতে বলতে জনমনে প্রচলিত একটি ধারণা বদ্ধমূল হতে দেখা যায়, যেখানে অনেক অতিরঞ্জন রয়েছে। বিশেষত, বৌদ্ধবিহার ধ্বংসের মাধ্যমে কিংবা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেওয়ার যে কাহিনী প্রচলিত, তার ভিত্তি বেশ দুর্বল। কারণ, এমন কোনো তথ্যসূত্র পাওয়া যায়নি যার দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে মুসলিম যোদ্ধারা বৌদ্ধদের গণহারে হত্যা করেছিল, কিংবা বেছে বেছে সব বৌদ্ধ ভিক্ষুকে খুন করেছে। এই ধরনের বর্ণনা দেওয়া আগে অতীতের বেশিরভাগ নেতিবাচক পূর্বানুমানে সক্রিয় সংশোধন জরুরি।”
বাংলাসহ ভারতের নানা স্থান থেকে বৌদ্ধদের বিলুপ্তির কারণ হিসেবে প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে হজসন বলেছেন “Active Revision”। আর এক্ষেত্রে ইতিহাসের সূত্র, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আর সাহিত্যিক উপাদানগুলোর পুনর্পাঠ জরুরি। এক্ষেত্রে প্রচলিত “Islam killed Indian Buddhism” শীর্ষক ন্যারেটিভকেই নাকচ করে দিয়েছেন অদ্রে ত্রুশকে। তার সঙ্গে জোহান এলভার্সকগও (Johan Elverskog) অনেকটা সহমত পোষণ করেছেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘Buddhism and Islam on the Silk Road’ গ্রন্থে তিনি এই বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞের মতামত বিশ্লেষণ করেছেন। সেখানে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে জিনাহ কিম (Jinah Kim) এবং আর্থার ম্যাকিওনের (Arthur McKeown) কথা।
১৯৯১ সালের দিকে হিস্ট্রি অব রিলিজিয়ন জার্নালের নম্বর ১ এবং খণ্ড ৩১-এ গ্রেগরি স্কোপেন (Gregory Schopen) প্রকাশ করেন “Archaeology and Protestant Presuppositions in the Study of Indian Buddhism,” শীর্ষক নিবন্ধ। এখানে তিনি স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, প্রচলিত ধারণা সামনে রেখে ব্যাখ্যা দিয়ে কীভাবে ইতিহাসের বাঁকবদল ঘটানো হচ্ছে। তিনি মনে করেন, ইউরোপের প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির বিলুপ্তির ব্যাখ্যাদান সমস্যাজনক। তাঁর মতে, স্থান, কাল ও পাত্রভেদে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ধারা ভিন্ন হতে বাধ্য। এখানে এক অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রদবদলের সঙ্গে অন্য কোনো এলাকাকে মিলিয়ে ফেললে তা হবে সমস্যাজনক।
প্রচলিত ইতিহাস থেকে যুদ্ধ ও সংঘাতনির্ভর বয়ান (A conflict-driven narrative) দাঁড় করানোর প্রবণতা বাংলা থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের ইতিহাসলিখন ও পঠন-পাঠনকে সমস্যার সম্মুখীন করেছে। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন রায়বাহাদুর ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক রচনায় ঠিক এই প্রচলিত ধারণা থেকে ভিন্ন স্রোতে চলার চেষ্টা করেছেন। তিনি কর্ণসুবর্ণ থেকে গৌড়েশ্বর মহারাজাধিরাজ শশাঙ্কের (৫৯০-৬২৫) আক্রমণে বৌদ্ধদের বিপন্ন হওয়ার কথা তুলে ধরেছেন।
অবশ্য তিনিও বানভট্টের হর্ষচরিতকে সামনে রেখে কিছুটা একতরফা দায় দিয়েছেন শশাঙ্কের উপর। শশাঙ্ক উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের বিশাল এলাকাজুড়ে গৌড় রাজ্য গড়ে তোলেন। এর বাইরে তিনি মগধ বা দক্ষিণ বিহার এবং উত্কল তথা উড়িষ্যা অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। মেদিনীপুরও তার দখলে চলে আসায় উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে শশাঙ্কের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। রোটাসগড়ের সিলটির পাশাপাশি কিছু তাম্রশাসন আর সপ্তম শতকের দিকে আসা চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙের বিবরণী, বাণভট্টের লেখা হর্ষচরিত গ্রন্থ থেকে শশাঙ্ক সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, শশাঙ্কের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা পাঠ করেও তার সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’তে শশাঙ্ক সম্পর্কে কিছু তথ্যের অবতারণা লক্ষ্য করা গেছে।
শশাঙ্কের রাজক্ষমতা গ্রহণের আগেই স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের পতন ঘটে, এবং পরবর্তী গুপ্তরাও দুর্বল হয়ে পড়ে। এ দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করেন মহাসামন্ত শশাঙ্ক। তিনি গৌড়ের সিংহাসন দখল করে সামন্ত অধিপতির বদলে গৌড়ের স্বাধীন রাজা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করলেন কর্ণসুবর্ণে, যা বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ এলাকায় অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এখানে আবিষ্কৃত রক্তমৃত্তিকা বিহার শশাঙ্কের স্মৃতি বহন করে। রক্তমৃত্তিকা বা রাঙামাটি আর তার কাছে অবস্থিত কানসোনা গ্রাম এখনও শশাঙ্কের স্মৃতিচিহ্নগুলো ধারণ করে আছে।
গোঁড়া শৈব ধর্মানুসারী শশাঙ্ক বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন, যার প্রমাণ রয়েছে হিউয়েন সাঙের বিবরণীতে। প্রশ্ন উঠতে পারে অন্য একটা বিষয়ে। কারণ, হিউয়েন সাঙ শশাঙ্ককে পছন্দ করতেন না। শশাঙ্কের শত্রু থানেশ্বরের রাজা হর্ষবর্ধন ছিলেন হিউয়েন সাঙের একজন পৃষ্ঠপোষক। অন্যদিকে, আরেকজন বর্ণনাকারী বাণভট্ট ছিলেন শশাঙ্কের বিরোধী হর্ষবর্ধনের সভাকবি। তাই তাদের বিবরণের আলোকে শশাঙ্ককে সরাসরি বৌদ্ধদলনকারী হিসেবে আখ্যা দেওয়ার কাজটা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
বাস্তবতার বিচারে আবার এই ঘটনা সত্যও হতে পারে। বিশেষত, উগ্র শৈব মতাদর্শী শশাঙ্কের দ্বারা বৌদ্ধদলন অনেকটাই সম্ভব ও স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরা যায়। তার অন্য অনেক কর্মকাণ্ড এই ঘটনাকে সমর্থন দেয়। তবে তার বোধিবৃক্ষ উপড়ে ফেলা কিংবা বৌদ্ধমূর্তি গঙ্গাজলে নিক্ষেপের যে বর্ণনা, সেখানে অতিরঞ্জন থাকা অসম্ভব কিছু নয়। এক্ষেত্রে দুটি ঘটনাকেই সম্ভাব্য ধরে ইতিহাস রচনা করা উচিত। বিশেষ করে অনেক ইতিহাসবিদ শশাঙ্ককে পূতঃপবিত্র হিসেবে উপস্থাপন করতে গিয়ে বাণভট্ট ও হিউয়েন সাঙকে একহাত নিয়েছেন, সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। সেন শাসনামলে নিম্নবর্ণের হিন্দু-বৌদ্ধ-বহিরাগত মুসলিম দলন থেকে শশাঙ্কের বৌদ্ধদলনের সম্ভাবনা আরো স্পষ্ট হয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর (১৮৫৩-১৯৩১) বর্ণনাকে সামনে রেখেও। তিনি দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন- একপর্যায়ে পূর্ববঙ্গে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল এক কোটি। প্রায় ১১,৫০০ জন ভিক্ষু বাস করতেন বিভিন্ন বিহারিকায়। তাঁরা সেখানে বৌদ্ধধর্মীয় নানা বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন। অন্যদিকে, ঠিক এর অল্প সময় পরে পুরো পরিস্থিতি কীভাবে বদলে গিয়েছিল- প্রশ্ন ওঠা উচিৎ সেখান থেকে।
শশাঙ্কের দীর্ঘ শাসনামলে এই পূর্ববঙ্গের বিস্তৃত ভূখণ্ড থেকে উল্লেখযোগ্য একটা বৌদ্ধগ্রন্থ কিংবা সূত্রের দেখা মেলে না এই সময়ে। পাশাপাশি, বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কোনো উৎসব আয়োজন কিংবা সামাজিক জমায়েতের কোনো তথ্যও নেই এই সময়ের।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে- এই এক কোটির মতো বৌদ্ধকে কি তখন বাংলা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল? তাদের উপর কি কোনো গণহত্যা চালানো হয়েছিল? নাকি তারা এমন সামাজিক পীড়নের মধ্যে ছিল যেখানে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়াই কষ্টকর মনে হয়েছিল? অনেকে দাবি করেছেন- বাংলা থেকে শশাঙ্ক বৌদ্ধবসতির চিহ্ন পর্যন্ত লোপ করতে চেয়েছিলেন।
পরিস্থিতি বদলে যায় পালরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর চারশ’ বছরের বেশি সময় পাল রাজত্ব টিকে থাকে। তখন আবার নতুন করে বাংলায় বৌদ্ধদের দাপট দেখা যায়। তবে এগারো শতকে পরিস্থিতি আবার বদলে যায়। তখন গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদে বিশ্বাসী সেনরা পরধর্মের ক্ষেত্রে কঠোর এবং অনমনীয় আচরণ করে, যা আবার বৌদ্ধদের বিপন্ন করে।
তাদের আবির্ভাব সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক বিপন্ন দশা, বর্ণপ্রথার ভয়াবহ বিস্তার আর ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের চরম অবস্থায় রূপ নেয়। এই সময়ে বৌদ্ধদের অবস্থা আরও করুণ হয়। বাধ্য হয়ে তাদের দেশত্যাগ করতে হয়। উচ্চশিক্ষা নিয়েও সমাজে তাদের কোনা সম্মান ছিল না। তাদের অনেককে ক্ষমতার জন্য হুমকি ভেবে হত্যাও করা হয়। এর বাইরে কেউ কেউ অনেক কায়ক্লেশে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। বৌদ্ধ নারী এবং নিম্নবর্গের মানুষ এককথায় হারিয়ে ফেলে স্বাভাবিক মানুষের মর্যাদা।
ভিক্ষু সুনীথানন্দের গবেষণা থেকে দেখা যায় সেন আমলে বৌদ্ধদের উপাসনালয়গুলোও কীভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। অন্যদিকে, নলিনী নাথ দাশগুপ্তও ক্ষেত্রবিশেষে ভিক্ষু সুনীথানন্দের সঙ্গে একই সুরে কথা বলেছেন। সমকালীন গ্রন্থ হিসেবে ‘শঙ্কর বিজয়’ কিংবা শূন্য পুরাণের থেকে সূত্র নিতে গেলে বোঝা যায় বৌদ্ধরা তখন কেমন বিপন্ন দশায় উপনীত হয়েছিলেন। আর সেদিক থেকে চিন্তা করলে তুর্কিক যোদ্ধা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি, যিনি লোকমুখে ‘বখতিয়ার খলজি’ নামেই অধিক পরিচিত, এবং তার সঙ্গে গরমশির থেকে ছুটে আসা অশ্বারোহীদের সামনে ধ্বংস করার মতো তেমন কিছুই ছিল না।
মাঝে মাঝেই অনেকে বেশ জোরের সাথে দাবি করেন- বখতিয়ার খলজি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। সেখানে তিনি অসংখ্য ভিক্ষুকে হত্যা করেছেন। কিন্ত আগে থেকেই ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনো স্থাপত্য কীভাবে নতুন করে ধ্বংস করে- এই প্রশ্নও উত্থাপন হওয়া জরুরি। পাশাপাশি, প্রকৃত অর্থে নালন্দা কীভাবে এবং কখন ধ্বংস হয়েছিল সেটাও বিচার বিশ্লেষণ করা জরুরি।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কয়েকবার আক্রান্ত হয়েছিল বহিঃশত্রুর দ্বারা। বৌদ্ধবিদ্বেষী মিহিরাকুলের আক্রমণে বিপন্ন হয়েছিল নালন্দা। তার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সময় কমবেশি স্কন্দগুপ্তের (৪৫৫-৪৬৭ খ্রি.) সমকালীন। তার প্রত্যক্ষ ক্ষোভের কারণে সরাসরি ঘটে বৌদ্ধ গণহত্যা।
অনেকে দাবি করেন, স্কন্দগুপ্ত ও তার উত্তরসূরীদের কাছে নালন্দা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, তবে রাজা শশাঙ্ক মগধে গিয়ে নালন্দা ধ্বংস করেন। তখন তিনি চড়াও হন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলোর ওপর, বিনষ্ট করেন বুদ্ধের পদচিহ্নও। হিউয়েন সাঙের লেখাতেও ধারণা পাওয়া যায় শশাঙ্কের এই প্রতিহিংসার।
তবে বখতিয়ার খলজি কীভাবে নালন্দা ধ্বংস করেন সেটা নিয়ে বিতর্ক উঠছে বারংবার। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার হিসেবে- ১১০০ সালে বখতিয়ার নালন্দা আক্রমণ করেন। অন্যদিকে, উলসলি হেগ দাবি করেছেন- বখতিয়ার ওদন্তপুরী আক্রমণ করার সময়টা ১১৯৩ সাল।
স্যার যদুনাথ সরকার মনে করেন, ১১৯৯ সালে বখতিয়ার ওদন্তপুরী আক্রমণ করেন। ওদিকে বখতিয়ারের বাংলায় আসার সময়টি কম-বেশি ১২০৪ সালের ১০ মে হওয়ার কথা। তাহলে কি বখতিয়ার বাংলায় আসার ১০৪ বছর আগেই আক্রমণ করে এই এলাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিহার গুঁড়িয়ে দিচ্ছিলেন? প্রশ্নটি একটু অবাক করার মতো নয় কি?
ওদিকে, অনেকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের সময় দাবি করেছে ১১৯৩ সালে। তবে বখতিয়ার তখনও বাংলার উদ্দেশ্যে কোনো অভিযান পরিচালনা করেছেন এমন তথ্য নেই। যদুনাথ সরকার ১২০৪ থেকে একটু পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় দাবি করেছেন ১১৯৯ সালের কথা। তারপরও ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংস কি বখতিয়ার করেছিলেন নাকি তার ভূত এসে করেছিল সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।
মিনহাজ-ই-সিরাজের প্রখ্যাত তবাকাত-ই-নাসিরির বর্ণনা থেকে প্রাপ্ত অতিকথন ঝেড়ে-মুছে বাস্তবধর্মী ইতিহাস লেখার চেষ্টা করা উচিত। সেটাই এখন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করা হচ্ছে। তবাকাত-ই-নাসিরির অনুবাদক আবুল কালাম যাকারিয়া মনে করেন, লড়াই সম্ভবত একপক্ষীয় ছিল না, এখানে প্রচণ্ড প্রতিরোধ হয়েছিল, এমন সম্ভাবনা রয়েছে’।
প্রখ্যাত গবেষক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৫-১৯৩০) মনে করেন, বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং সেনাদের যৌথ প্রতিরোধের ঘটনা ঘটে। সুশীলা মণ্ডলের ধারণানুযায়ী, ‘ওদন্তপুরী দুর্গ ছিল দুর্গম, সুরক্ষিত, শিখরের উপর অবস্থিত একটি আশ্রম। এখানে স্বয়ং বিহার রাজা গোবিন্দ পাল নিজের সৈন্যদের নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফলে বিহার জয়ের জন্য খলজি রাজধানীর পরে এখানে আক্রমণ করেন। ফলে সৈন্যদের পাশাপাশি বৌদ্ধভিক্ষুরাও অস্ত্রধারণ করেন। যুদ্ধে তারা পরাজিত হন, এবং গোবিন্দ পাল নিহত হন। ওদিকে নালন্দা মহাবিহার থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মগধে এই ওদন্তপুরী দুর্গের অবস্থান।
বখতিয়ার খলজি নদীয়া জয়ের প্রায় ৪০ বছর পরে মিনহাজ বাংলায় আসেন। তিনি লোকমুখে শোনা গল্প আরেকটু রসালো করতে যা ইচ্ছা তা-ই লিখে থাকতে পারেন। প্রচলিত মৌখিক বক্তব্য ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করে তার উপর ভিত্তি করে বর্ণনা লিখতে গিয়ে সর্বনাশ করেছেন তিনি। অন্তত রিচার্ড এম. ইটন যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেখানেই স্পষ্ট হয়েছে মিনহাজ কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তিনি মনে করেন, “১২০৪ সালে মুহাম্মাদ বখতিয়ারের সেন রাজধানী দখলের প্রায় সমসাময়িক একমাত্র বর্ণনা মিনহাজের তবকাত-ই নাসিরি।”
সুখময় মুখোপাধ্যায়, ড. আবদুল করিম, এবং রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রত্যেকের বর্ণনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে বোঝা যায়- তবাকাত-ই-নাসিরিতে ‘নালন্দা অভিযানের কোনো বিবরণ নেই’। ওদিকে বখতিয়ার নালন্দায় অভিযান করেছেন এমন কোনো নির্ভরযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক দলিলও হাজির করা যায়নি।
আবদুল মালিক ইসামি রচিত ফুতুহ-উস-সালাতিন ও হাসান নিজামির তাজ-উল-মাসির গ্রন্থেও বখতিয়ারের নালন্দা অভিযানের কোনো তথ্য নেই। এরপর ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সলিমও নালন্দা অভিযানের কোনো সূত্র দেখাতে পারেননি।
তিব্বত থেকে ধর্মস্বামী নালন্দায় আসেন ১২৩৪-৩৬ সালের দিকে। তিনি এসে দেখেন- নালন্দায় তখনও চলছে পাঠদান। সেখানে পড়াচ্ছেন মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্র। আর সেখানে গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়ছে ৭০ জন ভিক্ষু।
তবে সরদার আবদুর রহমানের মতে, ‘নালন্দা ধ্বংস আসলে হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘাতের ফসল’। হিন্দু ধর্ম প্রচারক ও দার্শনিক শঙ্করাচার্য বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কমিয়ে দিয়েছিলেন অনেকাংশে। তিনি ১২ বছর ধরে সূর্যের তপস্যা শেষে যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগার এবং বৌদ্ধবিহারগুলোতে প্রবেশ করেন। তখন তার নির্দেশেই বিহার এবং লাইব্রেরিগুলোতে আগুন লাগিয়ে থাকতে পারেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। আর সেই হিসেবে এই আগুনেই পুড়ে ছাই হয় নালন্দা।
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলার ইতিহাস গ্রন্থে নালন্দা ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দায়ী করেন। ওদিকে Aspects of Indian History and Civilization গ্রন্থে বুদ্ধ প্রকাশ যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা এই ধারণাকে আরও জোরালো করে তোলে।
নালন্দা বিহার আক্রমণ ও ধ্বংস সাধন ঐতিহাসিক বিতর্কের অধীন। এই বিষয় নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে উপযুক্ত গবেষণা ও অধ্যয়ন জরুরি। দীর্ঘ গবেষণা, প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও জরিপের পাশাপাশি উপযুক্ত নৈর্ব্যক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করলেই নালন্দার প্রকৃত ইতিহাস উন্মোচন সম্ভব হবে।