মমি তৈরির কৌশল নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
“মমি”- শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিশর, পিরামিড আর ব্যান্ডেজের মতো পেঁচিয়ে বাঁধা কিছু শরীরের ছবি! মৃত্যুর পর দেহ যাতে পচে না যায়, সেজন্যই মমি করে ফেলা হতো, যা লাশ সংরক্ষণের একটি উপায়। সংরক্ষণের জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতো তাকে বলে এম্বামিং (Embalming)। এর শেষপর্যায়ে কাপড়ে পেঁচিয়ে আমরা যে মমি দেখি, সেরকম রূপ দিত মিশরীয়রা।
তবে মৃতদেহ মমি করার আচার মিশরীয়দের একার ছিল না, এমনকি প্রথম মমির কৃতিত্বও তাদের নয়। আজকের দিনের চিলিতে প্রায় নয় হাজার বছর আগে উৎপত্তি হয় চিঙ্কোরো (Chinchorro) সভ্যতার। তারাও মৃতদেহ সংরক্ষণে এরকম কিছু করতে পারতো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এর বাইরে ইনকা (Inca), অ্যাজটেক (Aztec), আফ্রিকান কিছু গোত্র, এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরাও মমি করার পদ্ধতি জানতো।
মিশরীয়রা প্রাথমিক যুগে তাদের মৃতদের মাটিতে পুঁতে ফেলতো। মরুভূমির শুকনো আবহাওয়ায় শরীর থেকে আর্দ্রতা দূর হয়ে যেতো। অনেকটা প্রাকৃতিকভাবেই সংরক্ষিত হতো মৃতদেহ। কিন্তু কফিনের ব্যবহার শুরুর পর সমস্যা দেখা দেয়। কারণ কফিনে রাখা মৃতদেহ পচে যেতো।
প্রশ্ন হলো- এত কষ্ট করে মৃতদেহ সংরক্ষণের দরকার কী? প্রাচীন মিশরীয়দের ধারণা ছিল- মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে আমাদের শরীরের প্রয়োজন হবে। তাদের বিশ্বাস- শরীর যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে আত্মারও মৃত্যু ঘটবে। ফলে শরীর যাতে মৃত্যুর পর পচে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে মমি করে ফেলতো তারা।
ঠিক কবে থেকে আরম্ভ হয় মমি করার রীতি? প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, সম্ভবত খ্রিষ্টের জন্মের সাড়ে তিন হাজার বছর আগে থেকে এর সূচনা। সবচেয়ে প্রাচীন যে মিশরীয় মমি পাওয়া গেছে তা প্রায় ৪,৩০০ বছর আগের। প্রায় ২৫ টন ওজনের বিশাল এক পাথরের কফিনে পাওয়া গেছে এই মমি। সেই সময়কে বলা হয় পিরামিডের যুগ (Age of the Pyramids; 2686 – 2181 B.C.)। এই সময় প্রধানত চতুর্থ রাজবংশের মিশরীয় সম্রাটরা ব্যস্ত ছিলেন বিশাল বিশাল পিরামিড নির্মাণে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মৃত্যুর পর মমি করা দেহ এই সমাধিতেই স্থান পাবে।
মিশরের শুকনো আবহাওয়াতে মৃতদেহ সংরক্ষণ করা খুব কঠিন ছিল না। তারপরও এজন্য বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মৃতদেহকে নিয়ে যাওয়া হতো।
স্বাভাবিকভাবেই সবার পক্ষে এই প্রক্রিয়া জানা সম্ভব ছিল না। যাদের এই জ্ঞান ছিল, তারা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানীত। তাদের বলা হতো এম্বামার (Embalmer)। তারা পুরোহিতদের সমমর্যাদার বিবেচিত হতেন। বড় বড় মন্দিরে অবাধ যাতায়াত ছিল তাদের। অনেকে মনে করেন, তারা আসলে পুরোহিতদের বিশেষ একটি দল। বংশপরম্পরায় মমি করার পদ্ধতি জেনে আসতেন তারা। মানুষের শারীরিক গঠন (human anatomy) সম্পর্কে বিশদভাবে জানতেন তারা। মমি করতে হবে- এমন কারো মৃত্যু ঘটলেই ডাক পড়তো তাদের।
ঠিক কীভাবে মমি করা হতো? ধাপে ধাপে বেশ কয়েকটি উপায়ে মৃতদেহ পরিশোধন করে তারপরই কেবল চূড়ান্তভাবে সমাধিতে রাখা হতো তা। প্রথমে ভালো করে মৃতদেহ ধুয়ে ফেলা হতো। এরপরের কাজ ছিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের করে আনা। মিশরীয়দের জানা ছিল- এগুলোতেই সবার আগে পচন ধরবে। মগজকে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় মনে করতো তারা, তাই প্রথম কোপটা পড়তো সেখানেই। ধাতব একটা হুক নাক দিয়ে ঢুকিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে মগজ ছোট ছোট টুকরো করে বের করে আনা হতো।
এরপরের পর্যায়ে কাটা হতো পেটের বামপাশে। এদিক দিয়ে একে একে বের করে আনা হতো পরিপাকতন্ত্র, ফুসফুস, পাকস্থলি, লিভার ইত্যাদি। এগুলো শুকিয়ে পুরে ফেলা হতো বিশেষ আকৃতির জারে, যাকে এখন আমরা বলি ক্যানোপিক জার (Canopic Jars)। তবে হৃদপিণ্ড ভেতরেই রেখে দিতো মিশরীয়রা। কারণ তাদের ধারণা ছিল- আমাদের বুদ্ধিবিবেচনা নিয়ন্ত্রণ করে হৃদপিণ্ডই। পরবর্তীকালে অবশ্য প্রক্রিয়াজাত করে সমস্ত অঙ্গ আবার শরীরে ফিরিয়ে দেয়া রীতি চালু হয়। তবে তখনও খালি ক্যানোপিক জার আচারের অংশ হিসেবে রয়ে যায়।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবস্থা করার পর মৃতদেহের পেটের কাটা দিয়ে ভালো করে ধোয়া হতো ভেতরটা। এজন্য যে তরল ব্যবহার করা হয়, তার নাম দেয়া হয়েছে এম্বামিং ফ্লুইড বা এম্বামিং তরল (Embalming fluid)। এরপর কাটা জোড়া দিয়ে পুরো শরীরকে ঢেকে দেয়া হতো ন্যাট্রন নামে একরকম লবণে (Natron)। উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত আর্দ্রতা শুষে নেয়া। প্রায় চল্লিশ দিন লবণে রাখার পর মৃতদেহ পরিষ্কার করে তেল দেয়া হতো চামড়ায়।
এবার আসতো চূড়ান্ত কাজের পালা। প্রায় বিশ স্তরের লিনেনের কাপড়ে প্যাঁচানো হতো সমস্ত শরীর। কাপড় যাতে খুলে না আসে সেজন্য বিভিন্ন স্তরের মাঝে বিশেষ ধরনের আঠা ব্যবহার করতেন এম্বামাররা।
পুরোহিতেরা মমির মুখে ডেথ মাস্ক (Death Mask) নামে বিশেষ ধরনের একটি মুখোশও পরিয়ে দিতেন। কাপড় প্যাঁচানো শেষ হতে সময় লাগতো ১৫-২০ দিন। আর প্রথম থেকে শেষ ধাপ অবধি কম করে হলেও সত্তর দিনের ধাক্কা। এরপর বাকি থাকতো কফিনে ভরে মমি পিরামিডের ভেতরে রেখে আসা।
ফেরাউনদের কফিন ছিল খোদাই করা পাথরে আলাদাভাবে তৈরি, যাকে আমরা বলি সার্কোফ্যাগাস (Sarcophagus)। এর স্থান হতো সুসজ্জিত পিরামিডের ভেতর। পরকালে লাগবে ভেবে মিশরীয়রা দিয়ে দিতো খাবার, সুগন্ধি, ভৃত্য এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস।
কাদের শরীর মৃত্যুর পর মমি করতো মিশরীয়রা? প্রাথমিক যুগে কেবল সম্রাটদের ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ ছিল। তবে ধীরে ধীরে উচ্চবংশীয় লোকেরাও সুযোগ পান মৃত্যুর পর মমিকরণের। ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে সাধারণের জন্যও উন্মুক্ত হয়ে যায় পদ্ধতিটি। তবে বেশ ব্যয়বহুল ছিল মমি তৈরির পদ্ধতি। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই অতি-সম্পদশালীরা ছাড়া মমিকরণের পুরো প্রক্রিয়ার খরচ বহন করতে পারতো না কেউ।
গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস (Herodotus) প্রাচীন মিশর ঘুরে মমি করা নিয়ে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন। তার লেখা অনুযায়ী- মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হবে কীভাবে সেটা আসলে নির্ভর করতো টাকা-পয়সার ওপর। সম্রাট আর উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে জাঁকজমকের কোনো কমতি ছিল না।
মধ্যবিত্ত হলে শরীরে কেমিক্যাল ঢুকিয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট করে ফেলা হতো। ক্যানোপিক জারে সংরক্ষণের সিস্টেম ছিল না। এরপর লিনেনে না মুড়িয়ে মৃতদেহ ফেরত দেয়া হতো আত্মীয়দের। নিম্নবিত্তদের জন্য সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে কিছু বিশেষ তরল দিয়ে পরিষ্কার করেই ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হতো।
মূলত, চতুর্থ শতক থেকেই মমি করার প্রক্রিয়া হারিয়ে যেতে থাকে। মিশর তখন শাসিত হতো রোমের অধীনে। খ্রিষ্টধর্মের প্রসারের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায় মমিকরণ।
মিশরীয়দের মমি করার পদ্ধতি এখনও রহস্যাবৃত। বিজ্ঞানীরা ধাপগুলো জানলেও বিস্তারিত প্রক্রিয়া নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে এম্বামিং করতে কী তরল ব্যবহার করা হতো সেটা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। বড় একটি দলের মত হলো এজন্য সেসেমি তেল (sesame oil), বালসাম উদ্ভিদের (balsam type plant) শেকড়-বাকড়, আঠা ইত্যাদি মিশিয়ে তৈরি করা হতো মিশ্রণ।
মিশরীয়রা এখন আর মমি করে না বটে, তবে মৃত্যু-পরবর্তী আচারের অংশ হিসেবে মমি একেবারে হারিয়ে গেছে বললে ভুল হবে। উনবিংশ, এমনকি বিংশ শতকের শুরুতেও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীপে প্রচলিত ছিল মমি করার নানা পদ্ধতি। পাপুয়া নিউ গিনির কিছু গোত্র এখনও পূর্বপুরুষদের দেহ মমি করে সংরক্ষণ করে থাকে। তবে তারা ব্যবহার করে প্রাচীন মিশরীয়দের থেকে ভিন্ন প্রক্রিয়া।