কোহিনূর হীরার চমকে দেয়া ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বস্তুগুলোর মধ্যে হীরা অন্যতম। অলংকার কিংবা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই হীরার চাহিদা অনেক বেশি। বিশ্বে যত হীরা রয়েছে, তার মধ্যে কোহিনূর এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু সাম্রাজ্যের মধ্যে এই হীরার হাতবদলের ইতিহাস এর তাৎপর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
মোগল সম্রাটের সিংহাসনে, পারস্যের অধিপতির বাহুবন্ধনীতে, পাঞ্জাব মহারাজার দরবারে অথবা সবশেষে ব্রিটিশ রানীর মুকুটে– ইতিহাসে কোহিনূর হীরার হাতবদল ঘটেছে বার বার। আবার এই হীরার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের করুণ পরিণতি হীরাটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জল্পনাকল্পনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আধুনিককালে এর মালিকানা নিয়ে বেশ কিছু দেশের মধ্যে যে বিবাদ, সেটাও সাধারণ মানুষকে এই হীরা সম্পর্কে আরও বেশি আগ্রহী করে তুলেছে।
হীরার মূল্যবান হয়ে ওঠার পেছনে একটি বড় কারণ এর দুষ্প্রাপ্যতা। প্রাচীনকাল থেকেই এর চাহিদা অনেক বেশি হলেও এর যোগান ছিল অত্যন্ত কম। অর্থনীতির একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে- চাহিদার তুলনায় যদি যোগান কম হয়, তাহলে দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। অভিজাত শ্রেণীর মাঝে হীরার প্রবল চাহিদা থাকলেও যেহেতু এর যোগান অনেক কম, তাই স্বাভাবিকভাবে এর দাম অনেক বেশি।
হীরার বাজারে একচ্ছত্র রাজত্ব করা ডি বিয়ার্স কোম্পানির বিজ্ঞাপনী নীতিও হীরার দাম বৃদ্ধির পেছনে দায়ী। পুরো পৃথিবীতে হাতেগোণা কয়েকটি দেশে হীরার খনি রয়েছে। আবার সব খনিতে মজুদ থাকা হীরার অর্ধেক বাজারে বিক্রয় করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।
মাটির নিচে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার তাপ ও চাপের মাধ্যমে কার্বন কণার রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে হীরা গঠিত হয়। খনিতে যেসব হীরা পাওয়া যায়, সেগুলো গঠিত হতে লাখ লাখ বছর লাগতে পারে।
একসময় পৃথিবীতে হীরার একমাত্র উৎস ছিল ভারত। কারণ একমাত্র ভারতেরই মাটির উপরের পৃষ্ঠে হীরা পাওয়া যেত। তখন মাটির নিচের খনিতে হীরা থাকলেও তা চিহ্নিত ও উত্তোলিত করার মতো প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি। প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু নদীর বালি থেকে ছাঁকন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হীরা খুঁজে বের করা হতো। এরপর সেসব হীরার স্থান হতো বিভিন্ন রাজদরবারে।
আবার যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে বিজয়ী রাজ্য বা সম্রাট হীরা ও অন্যান্য মূল্যবান অলংকার লুট করে নিয়ে যেতেন। ১৭২৫ সালে প্রথমবারের মতো ভারতবর্ষের বাইরে হীরার সন্ধান পাওয়া যায়। সেই বছর ব্রাজিলের একটি খনিতে হীরার সন্ধান মেলে। প্রাচীনকালের রাজতান্ত্রিক শাসনামলে রাজদরবারগুলোতে কোন অভিজাত ব্যক্তি কোন হীরার অলংকার পরিধান করবেন, তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকত। রত্নবিদ্যার উপর সবচেয়ে প্রাচীন যে গ্রন্থ, সেটিও ভারতবর্ষেই লেখা হয়েছিল।
কোহিনূর হীরা ঠিক কোথায় এবং কোন সময়ে পাওয়া গিয়েছিল, তা আজও সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এটি যে ভারতবর্ষেই পাওয়া গিয়েছিল, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ এটি যে সময়ে প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে আসে, সেই সময়ে ভারতবর্ষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও হীরা পাওয়া যেত না।
কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, এই হীরা সনাতন হিন্দু ধর্মের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সময়ের শ্যামন্তক মণি। তবে এর পক্ষে যথাযথ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। আবার অনেকের মতে, ত্রয়োদশ শতকে বর্তমান অন্ধ্র প্রদেশের কল্লুর নামের একটি খনিতে এই হীরা পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্বের দাবির মতো এর পক্ষেও কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। কোহিনূর হীরা সম্পর্কে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য দাবি হচ্ছে- এটি বর্তমান দক্ষিণ ভারতের কোনো নদীর বালু থেকেই খুঁজে বের করা হয়েছিল, যেটি পরবর্তীতে হাতবদলের মধ্য দিয়ে মুঘল শাসকদের হাতে পৌঁছায়।
১৫২৬ সালে মধ্য এশিয়া থেকে সম্রাট বাবর ভারতবর্ষে এসে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। আজকের দিনে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও পূর্ব আফগানিস্তান পর্যন্ত এই সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে। ১৬২৮ সালে তৎকালীন মোগল সম্রাট শাহ জাহান একটি রাজকীয় সিংহাসন তৈরির নির্দেশ দেন। প্রায় সাত বছর ধরে সেই সিংহাসন তৈরি হয়। তাজমহল তৈরিতে যা ব্যয় হয়েছিল, এর চারগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করা হয় এই সিংহাসন নির্মাণে।
এই সিংহাসনে তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ও দুর্লভ হীরা ও অন্যান্য মণি-মুক্তা ব্যবহার করা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি হীরা ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত। একটি তিমুর রুবি, যেটি তার বর্ণের জন্য মোগল সম্রাটদের কাছে বিশেষ স্থান দখল করেছিল। আরেকটি কোহিনূর, যা সিংহাসনের সবচেয়ে উপরে স্থাপন করা হয়েছিল।
১৭২৬ সালে পারস্যের পরাক্রমশালী অধিপতি নাদির শাহ্ মোগল সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালান। তার শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সামনে মোগলদের প্রতিরোধব্যূহ টিকতে পারেনি। ফিরে যাওয়ার সময় নাদির শাহ্ মোগল সাম্রাজ্যের বিশাল পরিমাণ মণি-মুক্তা ও হীরার পাশাপাশি সম্রাট শাহ জাহানের সময়ে নির্মিত সেই বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসনও নিয়ে যান। এর ফলে কোহিনূরও ভারববর্ষের বাইরে চলে যায়। নাদির শাহ্ সিংহাসন থেকে কোহিনূর আলাদা করে নিজের বাহুবন্ধনীতে ব্যবহার করেছিলেন।
এরপর মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মধ্যে লড়াই চলতে থাকলে বার বার কোহিনূর হাতবদল হতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত শিখ মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের কাছে হীরাটি এসে পৌঁছালে কোহিনূর আবারও ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করে। পাঞ্জাবের রাজতান্ত্রিক শাসনে অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে শেষপর্যন্ত দশ বছর বয়সী দুলীপ সিং পাঞ্জাবের মহারাজা হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন৷ ব্রিটিশরা পরবর্তীতে তাকে বন্দী করে এবং কোহিনূর নিজেদের কাছে নিয়ে যায়।
পাঞ্জাব থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হীরাটি নিয়ে আসলেও পরবর্তীতে এটি ব্রিটিশ রাজপরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৮৫১ সালে এটি লন্ডনের একটি প্রদর্শনীতে রাখা হলেও যথাযথ মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয়। এর একটি বড় কারণ ছিল হীরাটি ঠিকমতো কাটা হয়নি, ফলে আলোর ঠিকমতো প্রতিফলন হচ্ছিল না। সেই সময়ে ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্ট একে সঠিকভাবে কাটার ব্যবস্থা করেন। কাটার পর এর আকার অর্ধেক হয়ে আসলেও সঠিকভাবে আলোর প্রতিফলনের জন্য এটি পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ রাজপরিবারের বিভিন্ন নারী সদস্যের মুকুটে হীরাটি স্থান পেয়েছে।
কোহিনূর হীরা নিয়ে রয়েছে অসংখ্য জল্পনাকল্পনা। অনেকের মতে, এই হীরা যখনই কোনো পুরুষের হাতে গিয়েছে, তখনই তার জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। শুরুতে মোগল শাসকদের কথা বলা হয়। কোহিনূরে হীরা বসানো সিংহাসনে যখন মোগল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ্ শাসন করছিলেন, তখন পারস্যের অধিপতি নাদির শাহের আক্রমণে মোগল সাম্রাজ্য ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
এরপর নাদির শাহ্ কোহিনূর হীরা নিয়ে গেলে একপর্যায়ে তিনিও ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর পারস্যের ক্ষমতা দখল নিয়ে যে সংঘাত শুরু হয়, তাতে প্রচুর রক্তপাতের ঘটনা ঘটে।
এরপর বেশ কিছু হাতবদলের পর ‘পাঞ্জাবের সিংহ’ খ্যাত রঞ্জিত সিংহের কাছে আসলেও তার উত্তরসূরিরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে হীরাটি চলে আসে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি নিজে এই হীরা ব্রিটিশ রানীর কাছে হস্তান্তর করতে যাওয়ার জন্য যে সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন, সেই যাত্রায় জাহাজের আরোহীদের মাঝে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে বলে জানা যায়। এর সাথে জাহাজটি প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের সম্মুখীন হয়। বলা হয়ে থাকে, যেহেতু এই হীরা পুরুষ ব্যবহারকারীদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে, তাই ব্রিটিশ রাজবংশের শুধু নারী সদস্যরাই হীরাটি ব্যবহার করেন।
আকৃতি কিংবা সৌন্দর্য বিবেচনা করলে কোহিনূর হীরার চেয়ে আরও বেশ কিছু হীরা এগিয়ে থাকবে। কিন্তু এই হীরার যে ইতিহাস রয়েছে, তা এককথায় অনন্য। প্রায় চারশো বছর ধরে অসংখ্য শাসকের হাতে এই হীরা পৌছেছিল। শেষপর্যন্ত ঠাঁই হয়েছে ব্রিটেনের রাজপরিবারে।
ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরান– চারটি দেশ এই হীরা নিজেদের ঐতিহাসিক সম্পদ হিসেবে দাবি করেছে। তারা কূটনৈতিকভাবে এই হীরা ফিরে পেতে চেষ্টা চালালেও সফল হয়নি। বর্তমানে টাওয়ার অব লন্ডনে হীরাটি সর্বসাধারণের প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। প্রতিবছর অসংখ্য দর্শনার্থী হীরাটি দেখার জন্য লন্ডনে যান।