লাতিন আমেরিকায় ইউরোপীয় নির্যাতনের ইতিহাস জানতে দেখুন আমাদের ভিডিও
আর্টিকেল পড়ুন
জ্যান্ত মানুষকে একটা চাকার সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে তার হাড়গোড় ভেঙে ফেলা হচ্ছে। তার হাতের আঙুল, পায়ের গিরা কিংবা হাঁটু আর অস্থিসন্ধিতে ঢোকানো হচ্ছে পেরেক।
একটা কাঁটাদার টেবিলের উপর শুইয়ে জীবিত কাউকে টান টান করে বেঁধে দুই দিক থেকে ক্রমাগত টান বাড়ানোর পাশাপাশি বেদম পেটানো হচ্ছে। পাশাপাশি তাকে পুরোপুরি বিবস্ত্র করে লটকে রেখে দুই পাশ থেকে টানার পাশাপাশি গায়ের চামড়ায় দেওয়া হচ্ছে গরম শিকের ছ্যাঁকা। একইসঙ্গে ষাঁড়াশি দিয়ে উপড়ে নেওয়া হচ্ছে হাত-পায়ের নখ, ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে লিঙ্গ এবং অণ্ডকোষ।
অনেক সময় পায়ুছিদ্র দিয়ে ঢোকানো হচ্ছে হাঁস-মুরগির ডিম, লাঠি এবং গরম ধাতব দণ্ড। শরীরের উন্মুক্ত চামড়ার উপর গনগনে কাঠকয়লার স্পর্শ স্যাঁত করে শুষে নিচ্ছে ঝলসে যাওয়া অংশ।
কাউকে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিছুটি কিংবা বিলাই খামচির মতো চুলকানির উপাদানযুক্ত হুলওয়ালা জ্যাকেট কিংবা দিনের পর দিন খাবার-পানি বাদে একজন মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে একটা ছোট চেম্বারে। এরপর খাওয়ার অভাবে সবার সামনে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে মানুষটি।
ধর্মীয়ভাবে ভিন্নমতের অনুসারীদের দমন কিংবা উপনিবেশ অঞ্চলের আদিবাসীদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করতে এমনি মানবতাবিরোধী ভয়াবহতার আশ্রয় নিয়েছিল স্পেন, পর্তুগাল,ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, জার্মানির মতো ইউরোপীয় দেশগুলো। দখলকৃত অঞ্চলে ভয়াবহ গণহত্যার পাশাপাশি তারা যেমন নারী ও পুরুষকে আলাদা রেখে তাদের বংশবিস্তার রোধ করেছে, তেমনি এমন রোমহর্ষক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তাদের মনে তৈরি করেছে ত্রাসের রাজত্ব। বিশ্বের নানা স্থানের মাঝে লাতিন আমেরিকার উপনিবেশে ইউরোপীয়দের নির্যাতন ছিল ভয়াবহতম।
আফ্রো-এশিয়ার নানা স্থানে ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তৃতি লাভ করলেও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি কিংবা জীবনযাত্রার মধ্যে একটা স্বতন্ত্র দিক শেষ অবধি টিকে থাকে। তারা স্বাধীনতা অর্জনের পর নতুন করে নিজেদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতির সেই সাধারণ বৈশিষ্ট্য সামনে রেখে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে। লাতিন আমেরিকার উপনিবেশ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে তাদের সংস্কৃতি, সমাজ, ভাষা, এমনকি ধর্মচিন্তা- সবকিছু হয়ে গিয়েছিল ইউরোপের মতো। এমনকি তাদের নাম অবধি পাল্টে ফেলা হয়। ১৯ শতকের মধ্যভাগে তাদের নাম দেওয়া হয় লাতিন আমেরিকা। এর মধ্য দিয়ে তাদের আজন্ম দাসত্বের যে গল্প, তার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছিল- এমনটা বলাই যায়।
স্পেন, ফ্রান্স ও পর্তুগালের উপনিবেশে থাকা আমেরিকার যেসব অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজ ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে ইউরোপের এই দেশগুলোর মতো হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোকেই ডাকা হয় লাতিন আমেরিকা নামে। আর সেই হিসেবে লাতিন আমেরিকা কোনো আঞ্চলিক নাম নয়, বরঞ্চ উপনিবেশ শেষ হওয়ার পর ঔপনিবেশিক ইউরোপীয়রাই এই অঞ্চলের নামা দিয়েছে ‘লাতিন আমেরিকা’।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞানুযায়ী, লাতিন আমেরিকা কোনো সুনির্দিষ্ট অঞ্চল নয়। সচরাচর দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা, মেক্সিকো এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপদেশগুলোকে এর অন্তর্গত মনে করা হয়। আর সেই হিসেবে হিস্পানিক আমেরিকার নানা এলাকা, ব্রাজিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফরাসি উপনিবেশ এলাকা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপের মধ্যে ফরাসি ভাষাভাষী অঞ্চলগুলোও এর মধ্যে পড়ে।
ইতিহাসের মারপ্যাঁচ আর ভৌগলিক জটিলতা বাদ দিয়ে চলুন জানা যাক বর্তমানে কোন দেশগুলো ল্যাটিন তথা লাতিন আমেরিকার মধ্যে পড়ে। তারপর আমরা বোঝার চেষ্টা করব এই অঞ্চলগুলোতে ইউরোপের বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি, যেমন- স্পেন, ফ্রান্স কিংবা পর্তুগাল কীভাবে অত্যাচার চালিয়ে তাদের স্বাভাবিক সংস্কৃতি, জীবনাচার, ধর্ম ও ভাষা ধ্বংস করেছিল।
ফুটবল বিশ্বকাপ চলার সময় আমরা স্বভাবতই দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলো দেশের নাম শুনি। এগুলো আরও স্পষ্ট হয় কোপা আমেরিকার খেলা শুরু হলে। হ্যাঁ ভিউয়ার্স, সেই এলাকাগুলো কম-বেশি সবই লাতিন আমেরিকার মধ্য পড়ে। সেইসঙ্গে যুক্ত হবে আরও কয়েকটি দেশ। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, বলিভিয়া, চিলি, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, কিউবা, ডোমিনিকান রিপাবলিক, ইকুয়েডর, এল সালভাদর, ফ্রেঞ্চ গায়ানা, গুয়াডেলোপে, গুয়াতেমালা, হাইতি, হন্ডুরাস, মার্টিনিক, নিকারাগুয়া, পানামা, প্যারাগুয়ে, পেরু, পুয়ের্তো রিকো, সেইন্ট বার্থেলমিউ, সেইন্ট মার্টিন, উরুগুয়ে এবং ভেনিজুয়েলা নিয়ে এই এলাকা।
সর্বনাশের শুরু সেই ১৪৯২ সালে, কলম্বাসের আমেরিকার মাটিতে পা রাখার মধ্য দিয়ে। তখন থেকে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তি নিউ ওয়ার্ল্ড তথা আমেরিকার মাটিতে একের পর এক সৈন্যদল প্রেরণ করতে থাকে। প্রাথমিকভাবে নৌবাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে তাদের এই অভিযান শুরু হলেও তা ক্রমশ রূপ নেয় এক ভয়াবহ দখলদারিত্ব এবং ঔপনিবেশিক তাণ্ডবে। তারা পরস্পর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে লাতিন আমেরিকার নানা অঞ্চল দখল করতে থাকে। নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ের পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীরাও তাদের ভূখণ্ড রক্ষা করতে জীবনবাজি রেখে বাধা দিতে চেষ্টা করে।
স্থানীয় দুর্বল হাতিয়ার ব্যবহার করা অপেক্ষাকৃত কম যুদ্ধবাজ, কৃষিনির্ভর লাতিন আমেরিকানদের বিপরীতে ইউরোপীয়রা কামান, বন্দুক এবং বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র ব্যবহার করে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যই লাতিন আমেরিকার অধিবাসীরা ইউরোপীয়দের কাছে পরাজিত হতে থাকে।
অনেক জায়গায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই ও কোন্দল থেকে সুযোগ নেয় ইউরোপীয়রা। তারপর তারা ঐ এলাকায় দখল নিশ্চিত করতে পারলে পুরোপুরি কচুকাটা করে সবাইকে। স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিরোধ ভেঙে দিতে বারুদ এবং গান পাউডার ব্যবহার করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় ইউরোপীয়রা। পাশাপাশি, প্রতিরোধকারীদের কেউ ইউরোপীয়দের হাতে ধরা পড়ার পর তার উপর নারকীয় অত্যাচার চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা হয় অন্যদের মনে।
ইউরোপীয়রা তাদের হাতে আটক যুদ্ধবন্দীদের সরাসরি করাত দিয়ে হাত-পা কেটে ফেলেছে, অনেকের নাক কিংবা কানের মতো অঙ্গচ্ছেদ করে পুরোপুরি বীভৎস অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। অনেককে ধরে তার লিঙ্গ কিংবা অণ্ডকোষ কেটে মালা মানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিংবা নাক ছিদ্র করে সুতা দিয়ে সেখান থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এর বাইরে তারা যুদ্ধবন্দীদের ধরে গরম লোহার রড কিংবা গণগণে জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে শরীরে ছ্যাঁক দিত। অনেককে গরম তাওয়ার উপর জোর করে বসিয়ে নিতম্ব ঝলসে দেওয়া হতো। শরীরের নানা স্থানে, বিশেষত হাঁটুতে পেরেক কিংবা গজাল ঠুকে সরাসরি ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল তাদের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা।
লাতিন আমেরিকার কোনো গ্রাম দখল করার পর ইউরোপীয় বর্বরতার সবচেয়ে ভয়াবহ শিকার হতো ঐ গ্রামের নারী ও শিশুরা। গ্রামের প্রায় সব পূর্ণবয়স্ক পুরুষকে হত্যার পর তারা বেশিরভাগ শিশুকে ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত। এরপর নারকীয় নির্যাতন চালাতো বেঁচে থাকা নারীদের উপর। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, অঙ্গচ্ছেদ কিংবা গোপনাঙ্গে গলিত সিসা ঢেলের দেওয়ার পাশাপাশি এমন কোনো নারকীয় তাণ্ডব নেই যা পর্তুগিজ, স্প্যানিশ কিংবা ফরাসি ঔপনিবেশিকরা করেনি।
আমরা জানি ইউরোপে ধর্মবিপ্লবের যুগে বিপ্লবী ধর্মমতগুলোকে দমন করতে গিয়ে ১৪৭৮-১৮৩৪ সালের দিকে প্রচলন ঘটেছিল ভয়াবহ স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের। ১৪৭৮ সালের দিকে স্পেনের শাসক হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দ ইনকুইজিশনের বৈধতা চেয়ে পোপের কাছে আবেদন করেন। পোপ ৪র্থ সিক্সটাস (Pope Sixtus IV) তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে চল্লিশ কিংবা তদূর্ধ্ব বয়সী একজন ব্যক্তিকে ইনকুইজিটর নিয়োগের পক্ষে মত দেন। তারপর এই নারকীয় নির্যাতনের কুৎসিৎ ব্যবহার প্রতিপক্ষকে দমনে বেশ সফলতার দেখা পায়।
ফলাফল হিসেবে ১৪৮৩ সালে ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলা টমাস দ্য টর্কমাডা (Tomás de Torquemada)-কে নিয়োগ দেন প্রথম ইনকুইজিটর জেনারেল হিসেবে। অবাক হলেও সত্য- যে পোপ ৪র্থ সিক্সটাস ইনকুইজিশনের বৈধতা দিয়ে প্যাপাল বুল জারি করেছিলেন, তিনিও একপর্যায়ে এর বিরোধিতা শুরু করেন। কিন্ত ততদিনে এই ঘৃণ্য পদ্ধতির সফল প্রয়োগ করে আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠা ফার্দিনান্দ আর ইসাবেলাকে ঠেকায় সেই সাধ্য কার!
ইনকুইজিশনের এই ভয়াবহ তাণ্ডবে বিশ্বমানবতা যখন গুমরে মরছিল, তখন অনেক সচেতন ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ওদিকে লাতিন আমেরিকায় ছিল এর ভিন্ন চিত্র। বিশেষত, আইবেরিয়ান পেনিনসুলার স্ট্রংহোল্ড হিসেবে টিকে থাকা গ্রানাডার পতন ঘটে ১৪৯২ সালে। ইনকুইজিশনের মাধ্যমে সেখানকার দুই লক্ষাধিক মুসলিম ও অন্য জনগোষ্ঠীর কিছু সংখ্যককে জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে রূপান্তর নয়তো দেশান্তরের সফলতা আরও লোভী করে তোলে স্প্যানিশদের। তারা লাতিন ও মেসোআমেরিকার নানা স্থানে এর বিস্তার ঘটায়। John F. Chuchiak তাঁর The Inquisition in New Spain, 1536–1820: A Documentary History শীর্ষক লেখায় দেখিয়েছেন মেক্সিকো এবং তার আশেপাশের এলাকায় কীভাবে ভয়াবহ থাবা বিস্তার করেছিল স্প্যানিশ ইনকুইজিশন। এমনকি মেক্সিকো সিটিতে স্থাপন করা হয় কুখ্যাত প্যালেস অব দ্য ইনকুইজিশন (Palace of the Inquisition)।
মনে করা হয়, আলনসো দ্য ওজেদা (Alonso de Ojeda) গায়ানা, ভেনিজুয়লা এবং ত্রিনিদাদের মাটিতে প্রথমবারের মতো স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের এই ভয়াবহ তাণ্ডবের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ ঘটান স্থানীয় আদিবাসী আমেরিকানদের দমন করতে। তারপর থেকে অনেকটা সংক্রামক ব্যাধির মতো বিস্তার ঘটে লাতিন আমেরিকার নানা অঞ্চলে। তবে Caroline Dodds Pennock এর মতো অনেক গবেষক Mass Murder or Religious Homicide? Rethinking Human Sacrifice and Interpersonal Violence in Aztec Society ধাঁচের প্রবন্ধ লিখে ইউরোপীয়দের তাণ্ডব ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছেন। তারা দেখাতে চেয়েছেন- ইউরোপের উপনিবেশ স্থাপনের অনেক আগে থেকেই লাতিন আমেরিকার মানুষ হিংস্র ছিল। তারা ধর্মীয় নানা কারণে আগে থেকেই অঙ্গচ্ছেদ কিংবা নরবলির মতো আয়োজনে অভ্যস্ত ছিল। তাই তাদের ভূখণ্ডে স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের তাণ্ডব নতুন কিছু নয়।
অপেক্ষাকৃত নির্মোহ ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেছেন ম্যাথিউ রাসেল ও ক্রিস লেন। তাঁদের Latin America in Colonial Times শীর্ষক গ্রন্থ থেকে লাতিন আমেরিকার তৎকালীন ইতিহাসের অনেক গুরুপূর্ণ তথ্য জানার সুযোগ হয়েছে। ওদিকে Mark Lentz তাঁর Crime and Punishment in Colonial Latin America শীর্ষক গ্রন্থে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবিষ্ট করেছেন। এর আলোকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপনের পর সেখানকার মানুষের উপর দিয়ে নারকীয় তাণ্ডব বইয়ে দিয়েছিল ইউরোপীয়রা।
বাংলাদেশ এবং ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের নির্যাতনের যে খণ্ডচিত্র আমরা নানা গল্প ও ইতিহাসে জানতে পারি, তার অনেকটাই পুরোপুরি দিবালোকের মতো সত্য মনে হবে লাতিন ইতিহাসে ইউরোপীয় নির্যাতন সম্পর্কে জানার পর। তখন অনেকেই মনে করবেন- নীল চাষ না করার কারণে কৃষককে ধরে আটকে রেখে দিনশেষে একমুঠো ধান খেতে দেওয়া কিংবা হাতের আঙুল কেটে নিয়ে মসলিন তৈরি বন্ধ করার মতো ঘটনা আলবৎ ঘটেছিল ভারত উপমহাদেশে। কারণ, এর থেকেও ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে লাতিন আমেরিকায়।
রিকার্ডো ডি. সালভাটোর (Ricardo D. Salvatore), কার্লোস অ্যাগুইয়ার (Carlos Aguirre), গিলবার্ট এম. জোসেফ Gilbert M. Joseph তাঁদের সম্পাদিত Crime and Punishment in Latin America, Law and Society Since Late Colonial Times শীর্ষক গ্রন্থে অনেক বর্ণনা দিয়েছেন, যা পুরোপুরি শিউরে ওঠার মতো। এর সঙ্গে বেশ কিছু মিল পাওয়া গিয়েছে Gabriel Haslip-Viera-র লেখা Crime and Punishment in Late Colonial Mexico City, 1692-1810 শীর্ষক গ্রন্থে। তাঁরা দেখাতে চেষ্টা করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন শক্তি, বিশেষ করে পর্তুগাল, স্পেন ও ফ্রান্স লাতিন আমেরিকার নানা দেশে কীভাবে তাদের শক্তির চূড়ান্ত প্রয়োগ করেছিল। পুরো অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব তৈরির মাধ্যমে তারা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যাতে কেউ বিদ্রোহের সাহস না করে।
২০১৫ সালে হার্পার কলিন্স থেকে প্রকশিত জিন হাওয়ার্ডের A People’s History of the United States থেকে জানা গিয়েছে, উপনিবেশ স্থাপনের পর কী ধরনের তাণ্ডব চালানো হয়েছিল লাতিন আমেরিকায়। তিনি লিখেছেন, “লাতিন আমেরিকায় এতটাই তাণ্ডব চালানো হয়েছিল যে তাদের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের মধ্যে তিন ভাগই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।”
তিনি স্প্যানিশ পাদ্রি ও ইতিহাস লেখক বার্থেলমিউ দ্য লাস কাসাসের (Bartolomé de las Casas) সূত্র ধরে লিখেছেন, “দখলকৃত লাতিন এলাকার বেশিরভাগ সক্ষম পুরুষকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের নারী ও পুরুষকে আলাদা এলাকায় রাখা হতো যাতে তারা বংশবিস্তার ঘটাতে না পারে। কোনো লাতিন বিপ্লবী কিংবা প্রতিরোধযোদ্ধা কোনোভাবে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করলে তার পেছনে শিকারী কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাকে ধরে আনা হতো। পালিয়ে যাওয়া বিদ্রোহীদের কোনোভাবে ধরতে পারলে তার উপর নারকীয় নানা নির্যাতন নিপীড়নের পর চূড়ান্ত শাস্তি হিসেবে শরীরের মধ্যাংশ বরাবর করাত দিয়ে চিরে হত্যা করা হতো।”
লাস কাসাস তাঁর বর্ণনায় আরও লিখে গিয়েছেন- হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে স্প্যানিশরা আদিবাসী মেক্সিকানদের রাত- দিন দুই সময়েই খনিতে কাজ করতে বাধ্য করেছিল। এমনকি তলোয়ারের ধার কতটা আছে এটা পরীক্ষার জন্যও স্প্যানিশরা অনেক সময় নিরপরাধ মেক্সিকান নারী ও শিশুদের টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। কাসাস মনে করেন, যুদ্ধ, দাসত্ব আর অতিরিক্ত শ্রম দিতে গিয়ে প্রায় তিন মিলিয়ন নেটিভ মেক্সিমান মারা গিয়েছেন স্প্যানিশদের উৎপাতে। স্প্যানিশ নৃশংসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্পেনে জন্ম নেওয়া লাস কাসাস শেষ অবধি সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, “Who in future generations will believe this? I myself writing it as a knowledgeable eyewitness can hardly believe it.”
ডিয়ার ভিউয়ার্স, আপনারা হয়তো আমাদের ইতিহাসের গল্প চ্যানেলে আপলোডকৃত ভিডিও ‘কোডেক্স গিগাস’ (Codex Gigas) দেখে থাকবেন। এমনি অনেকগুলো Maya Codices ছিল যা স্প্যানিশরা পুড়িয়ে ধ্বংস করেছিল, যাতে ঐ অঞ্চলের মানুষ একটা সময় গিয়ে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রকৃত শেকড় সম্পর্কে কোনো কূলকিনারা করতে না পারে। নানা ধ্বংসযজ্ঞের পরেও টিকে থাকা তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অমর গ্রন্থ হিসেবে এখন মনে করা হয় Dresden Codex, Paris Codex, Madrid Codex এর মতো রচনাগুলোর নাম।
স্প্যানিশদের আক্রমণের আগে অনেক সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে মায়া অধ্যুষিত অঞ্চলে তৈরি করা হয়েছিল স্বর্ণের তৈরি নানা শিল্পকর্ম। অনেক দেবতার মূূর্তিও তৈরি করা হয়েছিল উন্নতমানের সোনা থেকে। শুধুমাত্র লুণ্ঠনের সুবিধার্থে স্প্যানিশরা এই সোনার তৈরি দেবতার মূর্তি এবং শিল্পকর্মকে গলিয়ে স্বর্ণপিণ্ডে পরিণত করে। তারপর তা বস্তায় ভরে জাহাজে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় স্পেনে। মন্দির থেকে দেবতার মূর্তি লুঠ করতে গেলে স্বভাবতই তার ভক্তরা বাধা দিয়েছিল। তখন সবার আগে বীভৎস নিপীড়নের মাধ্যমে পুরোহিতকে হত্যা করেছিল। তারপর বন্দুকের সামনে জীবন দিতে হয় পুরোহিতের অনুসারী দেবতার ভক্তদের।
ভয়াবহতম ব্যাপার হচ্ছে- স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের যে পদ্ধতিগুলো ইউরোপে ব্যবহৃত হতো অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য, ঠিক একই পদ্ধতি গ্রানাডা থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপনিবেশে আরও ভয়ানকভাবে ব্যবহার করা হয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ভয়ানক পদ্ধতি হিসেবে। বিভিন্ন গবেষক লাতিন আমেরিকায় স্প্যানিশদের ব্যবহৃত মোট ছয়টি পদ্ধতি সম্পর্কে লিখে গেছেন, যা আদিবাসী আমেরিকানদের হত্যার উদ্দেশ্যে স্প্যানিশসহ পর্তুগিজ, ফরাসি ও অন্যান্য ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী ব্যবহার করেছে।
লাতিন আমেরিকায় ব্যবহৃত ভয়াবহ ছয়টি নির্যাতনের মধ্যে ছিল ১. স্ট্রাপেডো (Strappado), ২. ওয়াটারবোর্ডিং (Interrogatorio mejorado del agua or toca), ৩. র্যাক (The Rack), ৪. হুইল (The Wheel), ৫. হুলওয়ালা জামা (The Hairshirt) এবং ৬. টর্চার চেম্বার (Torture Chamber)। বাস্তবে বর্ণনা দিতে গেলে এগুলোর একটিকে অন্যটি থেকে ভয়াবহ মনে হতে পারে। কিন্ত স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের এই অমানবিক পদ্ধতিগুলো দিনের পর দিন বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তি ব্যবহার করে গিয়েছে অবলীলায়।
প্রথমেই বলা যেতে পারে স্ট্রাপেডোর কথা। একটা পুলির নিচে বাঁধা শক্ত আংটার মাধ্যমে একজন মানুষকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ঝোলানোর বিশেষ পদ্ধতি এটি। এখানেও ফাঁসির মঞ্চের মতো বিশাল একটা মঞ্চ তৈরি করা হতো। সেখানে অভিযুক্তকে বেঁধে আংটার সাহায্যে উল্টো করে ঝোলানো হতো। তারপর শাস্তির পরিমাণ আরও ভয়াবহ করতে পিঠমোড়া করে বেঁধে ঝোলানো ব্যক্তির পায়ের নিচে যোগ করা হতো পাথর কিংবা অন্য কোনো ওজনদার বস্তু।
অনেক সময় উপরের প্রান্তের মতো নিচের দিকেও দড়ি দিয়ে পুলির সাহায্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টান বাড়ানো হতো। সাধারণ স্বীকারোক্তির বদলে স্প্যানিশরা এই পদ্ধতিতে অনেকে মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করেছে। তখন সবার সামনে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে কপিকলের সাহায্যে ঝুলিয়ে দুই প্রান্ত থেকে টান বাড়িয়ে একটা সময় ছিঁড়ে ফেলা হতো। এই শাস্তি সবার সামনে দেওয়া হতো যাতে ভয়ে কেউ আর তাদের বিরুদ্ধে অবস্থানের সাহস না করে।
ওয়াটারবোর্ডিংয়ের শাস্তি অনেকটা বর্তমান সময়ের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ব্যবহৃত ওয়াটারবোর্ডিংয়ের মতো। তখনকার দিনে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য অনুসৃত বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে ভয়াবহতম ছিল এই ওয়াটারবোর্ডিং, যাকে স্প্যানিশরা বলতো interrogatorio mejorado del agua। এর মাধ্যমে শাস্তির সম্মুখীন ব্যক্তি মনে করতো সে ডুবে যাচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ এই শাস্তি অনেকটা মরণযন্ত্রণার সমতূল্য। অনেকে দীর্ঘ শাস্তির ধকল সইতে না পেরে মারাও গেছে। ওয়াটারবোর্ডিংয়ের জন্য অভিযুক্তকে একটা পাটাতনের উপর শুইয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলা হতো।
তারপর তার মুখের মধ্যে একটা শক্ত কাঠের টুকরো, বল-বকলেস ক্লিপ কিংবা ত্যানা গুঁজে দেওয়া হতো যাতে সে চিৎকার করতে না পারে। এরপর তার চোখ-মুখ একটা কাপড়ে ঢেকে অনবরত উপর থেকে আস্তে আস্তে পানি ঢালা হতো। কিংবা ট্যাপের সঙ্গে পাইপ যুক্ত করে অনেকক্ষণ পানি পড়তে দেওয়া হতো। এতে অভিযুক্তের মতো হতো সে পানিতে ডুবে যাচ্ছে। ভয়াবহ এই যন্ত্রণা সইতে না পেরে বেশিরভাগ মানুষ তার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ তোলা হতো তা-ই মেনে নিতো। অনেকে ফুসফুসে পানি ঢুকে ওয়াটারবোর্ডিং টেবিলেই মারা গিয়েছে।
স্প্যানিশরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে অবিশ্বাসী কিংবা অন্য ধর্ম, বিশেষ করে মুসলিম ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষদের শাস্তি দিতে। তারা গ্রানাডা দখলের পর তথ্য উদ্ধার কিংবা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে এই শাস্তি দিয়েছে অনেককে। পরবর্তীকালে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় তারা এই পদ্ধতিতে অনেককে হত্যাও করেছে।
রন. ই. হ্যাসনার (Ron E. Hassner) ২০২২ সালে কর্নেল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ অ্যানাটমি অব টর্চার। সেখানে স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের ভয়াবহ একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত র্যাকের স্থিরচিত্র ব্যবহার করেন বইয়ের প্রচ্ছদেই। এখানে মূলত হাত ও পা টান টান করে বেঁধে অভিযুক্তকে আটকে রাখা হয়। দুই প্রান্ত থেকে পুলির সাহায্যে টান বাড়ানোর মাধ্যমে শরীরকে ছিড়ে ফেলার ব্যবস্থা থাকে এখানে। পাশাপাশি, আটকে রাখা ব্যক্তিকে মোটা লাঠি, হকিস্টিক কিংবা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে থ্যাঁতলা করা হয়।
অনেকসময় যে তক্তার উপর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বেঁধে রাখা হয়, সেখানে থাকে সূঁচের মতো পিন। এর মাধ্যমে র্যাকে বাঁধা ব্যক্তিকে টানার সময় দ্বিমুখী ভয়াবহতার সম্মুখীন করা হয়। সে হাত ও পায়ের দিক থেকে ভয়াবহ টান অনুভব করে। সেই সঙ্গে তার শরীরের নানা স্থানের চামড়া কেটে ফালাফালা হতে থাকে। ওদিকে, কেটে যাওয়া চামড়ায় লেবুর রস কিংবা লবণ ঢালার পাশাপাশি গায়ের নানা স্থানে গণগণে কয়লা কিংবা ধাতব খণ্ড দিয়ে ছ্যাঁক দেওয়া হয়।
অনেকের হাত ও পায়ের আঙ্গুলের নখ উপড়ে ফেলা হয় সাঁড়াশি দিয়ে। হাত ও পায়ের আঙুলের গিরার পাশাপাশি হাঁটুতে হাতুড়ি দিয়ে ক্রগামত পেটানো হয়। এতে গিঁটগুলো ফুলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা দেখা দেয়। অনেকক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা বাড়াতে এবং জনমণে ত্রাস সৃষ্টি করতে বেঁধে রাখা ব্যক্তির শরীরের নানা স্থানে পেরেক ঠোকা হয়।
অনেকের ক্ষেত্রে কেটে নেওয়া হয় অণ্ডকোষ এবং লিঙ্গ। কারও ক্ষেত্রে পুরোপুরি বিবস্ত্র করে উল্টোভাবে বেঁধে পিঠ, নিতম্ব ও ঘাড়ে গরম শিক দিয়ে খোঁচানো হয়। পাশাপাশি গুহ্যদ্বার দিয়ে প্রবেশ করানো হয় লাঠি কিংবা গরম ধাতবখণ্ড। স্বীকারোক্তি আদায়ের পাশাপাশি অভিযুক্তকে নরকযন্ত্রনা দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যেই স্প্যানিশরা এই পদ্ধতি বেশি ব্যবহার করেছে।
নরক যন্ত্রণার এই র্যাক থেকে একটু সংস্কার করে স্প্যানিশ ইনকুইজিটররা তৈরি করেছিল হুইল। পদ্ধতি অনেকটা একই, কিন্তু এখানে চাকার মাঝের ফাঁকা অংশগুলো তারা কাজে লাগাতো অভিযুক্তকে পেটানোর জন্য। এক্ষেত্রে কুখ্যাত Catherine Wheel এর কথা বলা যেতে পারে। বড় গরুর গাড়ির চাকার মতো করে তৈরি বিশেষ ধরণের চাকার সঙ্গে মানুষকে ধরে বাঁধতো তারা। তারপর ইচ্ছেমতো লাঠিপেটা করতো। পাশাপাশি, হ্যান্ডেলের সাহায্যে এই চাকা ঘুরানোর ব্যবস্থা ছিল। তারা বেল্ট কিংবা দড়ি দিয়ে এই চাকার সঙ্গে কাউকে বেঁধে ইচ্ছেমতো গতিতে উপর-নিচে ঘুরিয়ে তার অবস্থা খারাপ করে ফেলতো। পাশাপাশি, হাতে থাকা চাবুক কিংবা লাঠি দিয়ে চলতো নির্মম প্রহার।
অনেক সময় এই চাকা সেট করা হতো পানির চৌবাচ্চার উপর। হ্যান্ডেলের সাহায্যে চাকা ঘুরিয়ে অভিযুক্তকে উল্টো করে পানিতে চুবানোর ব্যবস্থা ছিল। একইভাবে বিভিন্ন কপিকল ও পুলির সাহায্যে একই ধরণের চাকাকে গণগণে আগুনের উপর নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিল তারা। এভাবে তারা অভিযুক্তকে সবার সামনে হত্যা করে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করতো। পাশাপাশি, স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য কাউকে চাকায় আটকানো হলে তাকে বেধড়ক পিটিয়ে আধমরা করে তারপর খুলে নেওয়া হতো। অন্য শাস্তিগুলোর মতো এই চাকার শাস্তিকেও এক অর্থে দুনিয়ার বুকে নরকদর্শনই বলা যায়।
ভয়ানক নানা শাস্তির মধ্যে আরেকটি ছিল হুলওয়ালা জামা পরিয়ে দেওয়া। অভিযুক্তের গা খালি করে বিভিন্ন পশুর লোম ও গাছের ছাল থেকে তৈরি হুলওয়ালা জামা পরিয়ে দেওয়া হতো। এর ফলে সৃষ্ট ভয়ানক চুলকানি মানুষকে বাধ্য করতো তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বীকার করে নিতে। এই পদ্ধতিতে তারা বিভিন্ন পশুর লোমের পাশাপাশি বানর খামচি, বিছুটি কিংবা বিলাই খামচির মতো মতো গাছের চুলকানি উদ্রেককারী আঁশও ব্যবহার করেছে। হুলওয়ালা জামা মূলত স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ব্যবহার করা হতো। কিন্ত অতিরিক্ত চুলকানি ও যন্ত্রণা সইতে না পেরে অনেকে স্ট্রোক করে মারা গিয়েছেন এই ঘটনাও বিরল নয়।
ভয়াবহ নানা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির মধ্যে স্প্যানিশদের ব্যবহৃত আরেকটি কুখ্যাত শাস্তি হচ্ছে দরজা-জানালাবিহীন কক্ষ। এখানে অভিযুক্তকে খাবার ও পানি না দিয়ে দিনের পর দিন আটকে রাখতো তারা। বেশিরভাগ মানুষ খাবারের অভাবে মারা যেত। এই চেম্বার তৈরি করা হতো লোকালয়ের মধ্যে, যার ফলে স্থানীয়রা চোখের সামনে তাদের কাউকে মরে যেতে থেকে প্রচণ্ড রকম ভয় পায়। মূলত জোরপূর্বক ধর্মান্তর এবং দখলকৃত অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করতেই স্প্যানিশরা এসব ভয়াবহ শাস্তির উদ্ভাবন করেছিল।
ভয়াবহ এসব শাস্তির উদ্ভাবনের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য আমাদের ইতিহাসের পাতায় একটু হাতড়ে দেখতে হবে। আমরা জানি কুখ্যাত সেই Augsburg Settlement এর কথা, যেখানে বলা হয়েছিল Augsburg Settlement তথা whose realm, his religion। এর অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘রাজার ধর্মই হবে প্রজার জন্য সুনির্দিষ্ট ধর্মাচার’। এটা কেবল মুখে বলে দেওয়ার মতো একটা চুক্তি নয়। এখানে প্রজারা রাজার ধর্ম পালন না করলে কী হবে তা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি। আর সেখানে প্রজাদের জোর করে রাজার ধর্ম পালনে বাধ্য করা হয়েছিল। যারা স্বেচ্ছায় পালন করতে চায়নি, তাদের হয় দেশান্তর হতে হয়েছে, নয়তো এমন ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিল।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে ভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে, বিশেষত ক্রুসেডের সময় দখলকৃত মুসলিম জনপদের মানুষকে শায়েস্তা করতে নানা ধরনের নির্যাতনের পদ্ধতি ব্যবহার করতো ক্রুসেডাররা। তারপর তারা বিশ্বের নানা স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করে। দখলকৃত নতুন ভূখণ্ডের উপর নিজেদের দখল নিরঙ্কুশ রাখতে তারা দিনের পর দিন বাড়িয়ে দেয় নির্যাতনের মাত্রা।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত স্প্যনিশ ইনকুইজিশনের নানা ধারা ডোমিনিকানরা ছড়িয়ে দিয়েছিল তাদের প্রতিটি উপনিবেশে। এর একটি অংশ হিসেবে লাতিন আমেরিকার কথা বলা যেতে পারে। আজ থেকে কয়েকশত বছর আগে তারা মানুষকে নির্যাতনের জন্য যে ভয়াবহ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল, তা ভেবে আজও অনেককে শিউরে উঠতে হয়।