কিবলা পরিবর্তনের ইতিহাস জানতে দেখুন আমাদের ভিডিও
আর্টিকেল পড়ুন
মুসলিম হিসেবে আমাদের নিয়মিত ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব ও এশা এই ৫ ওয়াক্তের ফরজ নামাজ আদায় করতে হয়। এ সময়গুলোতে মুসলিমরা যে যেখানেই থাকুক না কেন, নামাজ যারা পড়ছেন, তারা সবাই দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন কিবলামুখী হয়ে।
কিন্তু এই কিবলা আসলে কী? ক্বিবলা একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ দিক। বাংলায় অবশ্য লোকমুখে বার বার উচ্চারিত হতে হতে এটি কিবলা ও কেবলা উভয় নামেই পরিচিত। সে যা-ই হোক, এই ক্বিবলার ‘দিক’ হচ্ছে মক্কায় অবস্থিত পবিত্র ক্বাবা শরীফের দিক, যাকে ‘মসজিদুল হারাম’ও বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে এই ক্বিবলা পশ্চিম দিকে। তাই এই দেশের মুসলিমরা পশ্চিম দিকে ফিরেই নামাজ আদায় করেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের বেলায়—যে দেশ থেকে কাবা শরীফ যেদিকে, সেই দেশে বসবাসরত মুসলিমরা ঠিক সেদিকে ফিরে নামাজ আদায় করেন। এভাবে দেশ বা অঞ্চলভেদে এই দিক উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব বা পশ্চিম যা-ই হোক না কেন, কেন্দ্র হিসেবে সব সময়ই রয়েছে কাবা শরীফ।
একটা কথা অবশ্য আপনাদের জানিয়ে রাখা ভাল। ইসলামের শুরুতে কিন্তু কাবা শরীফ মুসলিমদের কিবলা ছিল না; বরং প্রথম কিবলার সম্মান জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসার। হযরত মুহাম্মাদ সা. এর মদীনায় হিজরতের পর আল্লাহর নির্দেশে কিবলা পরিবর্তিত হয়ে যায়, নতুন কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয় ক্বাবা শরীফ।
কিবলা যে পরিবর্তিত হলো, এর পেছনেও আছে একটি ঘটনা।
মদীনায় হিজরতের পর রাসুল সা. মসজিদুল আকসার দিকে ফিরেই নামাজ আদায় করতেন। কিন্তু তিনি অনুভব করছিলেন যে মসজিদুল আকসার কিবলা হয়ে থাকার সময়ের অবসান ঘটেছে, বরং ইসরাঈলী বংশের নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে এখন সময় ইবরাহিমী কিবলার দিকে মুখ ফেরানোর।
এই উদ্দেশ্যে নবী সা. জিবরাইল (আঃ) কে বলেছিলেন, “আমার আশা, আল্লাহ্ তা‘আলা যেন আমার চেহারা ইহুদীদের কিবলা হতে ফিরিয়ে দেন।” জিবরাইল আ. তখন বললেন, “আমি তো আল্লাহর একজন বান্দা মাত্র। আপনি আপনার রবের কাছে প্রার্থনা করুন, এবং তাঁর কাছেই বিষয়টি বলুন।” নবী সা. তাই আল্লাহর কাছে এজন্য দোয়া করেন। তিনি আকাশের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলেন এজন্য যে- কোনো ফেরেশতা আল্লাহর নির্দেশ নিয়ে আসছেন কিনা।
তখন আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১৪৪ নং আয়াত নাজিল করেন, যার অর্থ,
“অবশ্যই আমরা আকাশের দিকে আপনার বার বার তাকানো লক্ষ্য করি। সুতরাং অবশ্যই আমরা আপনাকে এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব যা আপনি পছন্দ করেন। অতএব আপনি মসজিদুল হারামের দিকে চেহারা ফেরান। আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তোমাদের চেহারাসমূহ এর দিকে ফেরাও, এবং নিশ্চয়ই যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে তারা অবশ্যই জানে যে, এটা তাদের রব এর পক্ষ থেকে হক। আর তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ গাফেল নন।”
এটি ছিল হিজরতের ১৬ মাস পরের ঘটনা। স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকে কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ আসার পর কীভাবে এর বাস্তবায়ন ঘটে, তা নিয়েও আছে চমৎকার ঘটনা।
ইবনে সা’আদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাসূল সা. এক দাওয়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে যোহরের সময় হয়ে যাওয়ায় তিনি নামাজে লোকদের ইমামতি করছিলেন। দুই রাকাত নামাজ আদায় হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় তৃতীয় রাকাতে ওহীর মাধ্যমে এ আয়াতটি নাযিল হল। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ও তাঁর সঙ্গে জামাতে শামিল সমস্ত লোক বায়তুল মুকাদ্দাসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কাবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেন।
পরে সেই মসজিদের নাম হয়ে যায় কিবলাতাইন মসজিদ বা দুই কিবলার মসজিদ। আজও মসজিদটিতে দুটি কিবলার চিহ্ন বিদ্যমান।
যা-ই হোক, কিবলা পরিবর্তন, এবং মুসলিমরা একে কতটা সহজভাবে মেনে নিল সেই বিষয়ে নাহয় জানা গেল, এবার চলুন ভিন্ন এক দিকেই নজর দেয়া যাক।
আজকের দিনে আমরা যখন নতুন কোনো এলাকায় যাচ্ছি, কিংবা নতুন কোনো দেশেই যখন যাই, তখন খুব সহজ কিছু উপায়ে সেখানকার কিবলা সম্পর্কে জানতে পারি।
একই দেশে থাকলে হাতে থাকা স্মার্টফোনের কম্পাস অ্যাপের মাধ্যমে বা সেখানে থাকা লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে তারা দেখিয়ে দিচ্ছে।
আবার আপনি যদি নতুন কোনো দেশে যান, এবং সেখানকার কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত বোধ করেন, কিংবা জিজ্ঞেস করা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে চলে যেতে পারেন গুগল প্লে স্টোরে। Qibla Finder, Qibla Compass এই জাতীয় শব্দগুলো লিখে সার্চ করলে লক্ষ-কোটিবার ডাউনলোড হওয়া বিভিন্ন অ্যাপের সন্ধান পাবেন, যার মাধ্যমে আপনার অবস্থান থেকে কাবা শরীফ কোন দিকে তা সহজেই জেনে নিতে পারছেন।
আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় আপনি নাহয় এত সহজেই নামাজের দিক নিয়ে জানতে পারছেন, তাহলে আজ থেকে শত-সহস্র বছর আগে মানুষ এটা কীভাবে করত? তারাও তো এক সাম্রাজ্যের নানা এলাকায় কিংবা ব্যবসার প্রয়োজনে বা সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে এক সাম্রাজ্য থেকে অন্য সাম্রাজ্যে যাতায়াত করত, তখন তারা কীভাবে কিবলা নির্ধারণ করত? এখন চলুন সেই সম্পর্কেই জেনে নেয়া যাক।
যে সময়ের কথা বলছি, তখনও মুসলিম বিশ্বে জ্যোতির্বিজ্ঞান-চর্চা সেভাবে শুরু হয়নি। ওদিকে মক্কা-মদীনা ছাড়িয়ে মুসলিমরা তখন দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। তখনই মূলত কিবলা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এই জটিলতার নিরসনে বিভিন্ন নন-অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল পদ্ধতির আশ্রয় নেয়া হতো। এসবের মাঝে রয়েছে:
১) যদি কোনো সাহাবী সেই এলাকায় এসে নামাজ আদায় করে থাকেন, তাহলে তিনি যেদিক ফিরে আদায় করেছেন, এলাকাবাসীও সেদিক ফিরেই নামাজ আদায় করত। বা,
২) রাতের আকাশে বিভিন্ন নক্ষত্রের অবস্থান দেখে দিকনির্ণয় করত। কিংবা,
৩) বাতাসের গতিপথ বুঝেও এই দিক নির্ধারণ করা হতো।
৮ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাগদাদকেন্দ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞান-চর্চা শুরু হয় মুসলিম-বিশ্বে। এই সময় মুসলিম-বিশ্বে ভারতীয় এবং গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের বেশ প্রভাব ছিল। বিশেষত, রোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে থাকা মিশরের প্রখ্যাত গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, ভূগোলবিদ টলেমির কথা না বললেই নয়।
এভাবেই নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে ৯ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুসলিম বিশ্বে জ্যোতির্বিদগণ প্রথমবারের মতো কিবলা নির্ণয়ের পদ্ধতি বের করেন। এই সময় টলেমির Geography থেকে যেমন অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের সাহায্য নেয়া হয়েছে, তেমনই তৎকালীন বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ত্রিকোণমিতির নানা সূত্রও কাজে লাগানো হয়েছে। মধ্যযুগীয় মুসলিম বিশ্বে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা সংক্রান্ত অধিকাংশ বইয়েই বৈজ্ঞানিক সূত্র কাজে লাগিয়ে ক্বিবলা নির্ণয় সংক্রান্ত অধ্যায় থাকত।
৯ম শতকের শুরুর দিকে এভাবে ক্বিবলা সম্পর্কে যে সমাধান পাওয়া যেত, তা শতভাগ নির্ভুল বলার উপায় ছিল না। কারণ তখন সাহায্য নেয়া হতো সমতল মানচিত্রের, অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক জ্যামিতির, যেখানে আমাদের পৃথিবী হলো গোলাকার। তবে যেসব স্থান মক্কার কাছাকাছি, সেসব স্থানের জন্য এটা তেমন কোনো বিষয় ছিল না। এমনকি মিশর ও ইরান পর্যন্তও এই পার্থক্যের পরিমাণ সর্বোচ্চ ২ ডিগ্রি পর্যন্ত হতো।
এই সমস্যাও ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে থাকে ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি এবং Spherical Trigonometry-র সাহায্যে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন হাবাশ আল হাসিব, ইবনে ইউনুস, আবুল ওয়াফা, হাসান ইবনে আল হাইসাম, আল-বিরুনী প্রমুখ।
পরবর্তীকালের জ্যোতির্বিদগণ তাদের দেখানো পথ ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্বিবলা কোন দিকে তা নির্ণয়ের জন্য টেবিল তৈরি করেন, যেখানে মক্কা থেকে সেই স্থানগুলোর অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের পার্থক্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
এক্ষেত্রে চতুর্দশ শতকের জ্যোতির্বিজ্ঞানী শামস উদ্দীন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদের কথা না বললেই নয়। তিনি ২,৮৮০টি স্থানাঙ্ক সম্বলিত একটি ক্বিবলা টেবিল তৈরি করেছিলেন, যেখানে মক্কা থেকে ৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত দ্রাঘিমাংশের পার্থক্য অন্তর্ভুক্ত ছিল, অক্ষাংশ ছিল ১০ ডিগ্রি থেকে ৫০ ডিগ্রি পর্যন্ত। তার কাজের ব্যাপারে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক ইতিহাসবিদ ডেভিড এ. কিং বলেছেন, মধ্যযুগীয় ক্বিবলা টেবিলসমূহের মাঝে শামস উদ্দীনেরটি নির্ভুলতা ও ব্যাপকতার দিক থেকে ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
এই হিসাব কতটা নির্ভুল হবে, তা নির্ভর করত যে স্থান থেকে ক্বিবলা নির্ধারণ করা হবে, সেই স্থানের অক্ষাংশ, মক্কার অক্ষাংশ, এবং সর্বোপরি দুই স্থানের দ্রাঘিমাংশের পার্থক্যের উপর। ১৮ ও ১৯ শতক থেকে শতভাগ নির্ভুলভাবে এই ইনপুট ভ্যালুগুলো পাওয়া সম্ভব হয়, যার ফলে বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে ক্বিবলা নির্ধারণও হয়ে ওঠে শতভাগ নির্ভুল।