পারস্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
মোহনীয় কমনীয় সব শিল্পকলা, ইয়াখচালের মতো হিমাগার, আর কানাত টানেলের পানি সরবরাহ, স্তম্ভনির্ভর স্থাপত্য, সুশৃঙ্খল প্রশাসন, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর জরথুস্ত্রবাদের জন্ম থেকে শুরু করে অন্যান্য ধর্মীয় ধারণার বিকাশ এক অর্থে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় প্রাচীন পারস্য সভ্যতার সঙ্গে। মেসোপটেমীয় সভ্যতার সর্বশেষ সংস্কৃতির ধারক হিসাবে ক্যালডীয়দের ইতিহাস যেমন আলোচনার দাবি রাখে, তেমনি ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পর থেকে বাকি গল্পটা লিখতে হয় পার্সীয়দের হাত ধরেই।
যতদূর জানা গিয়েছে- যীশুখ্রিস্ট র্অথাৎ হযরত ঈসা আ.-এর জন্মেরও প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর আগে থেকে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে প্রবেশ শুরু করে পারস্যের মানুষ। তারা প্রায় পুরো ক্যালডীয় সাম্রাজ্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। এ অঞ্চলে পার্সীয়দের দ্বারা অভিন্ন সংস্কৃতির পুনর্বিন্যাস না ঘটে একটি নতুন সভ্যতা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ক্যালডীয়দের কাছ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করলেও তারা একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।
পার্সীয়দের ধর্মবিশ্বাস যেমন এক স্বতন্ত্র সত্তার দাবি করতে পারে, তেমনি বিভিন্ন দখলতকৃত অঞ্চলের অভিজ্ঞতা পার্সীয় চিত্রকলা বিকাশের পথ করে দেয়। তারা ক্যালডীয় বিজ্ঞানকে উন্নত করার দিকে দৃষ্টি দেয়নি, তেমনি বাণিজ্য ও শিল্পের উন্নয়নে আগ্রহ দেখিয়েছে অনেক কম। তাই তারা এমন কিছু অঞ্চল পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করেছিল যেখানে ক্যালডীয়দের সম্প্রসারণ সেভাবে হয়নি। অন্যদিকে, একটি দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো এবং একটি নতুন ধর্মীয় দর্শন তাদের সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দেয়।
পার্সীয় জাতির উৎস অনুসন্ধান করতে গেলে দুটি বিশেষ তৃণভূমির কথা বলতে হয়। এর মধ্যে আরব মরুভূমির সীমান্ত রেখায় যে তৃণভূমির অবস্থান, তা যাযাবর মানুষদের বসতি গড়ে তোলায় উৎসাহ যুগিয়েছিল। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলীয় তৃণভূমিটির অবস্থান ছিল দানিয়ুব নদীর নিম্নাঞ্চল থেকে পূর্বদিকে বিস্তৃত। এটি কৃষ্ণসাগরের উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ রাশিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এশিয়ার উত্তরাঞ্চলসহ কাস্পিয়ান সাগরের পূর্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এই অঞ্চল ভেড়ার পাল চরিয়ে বেড়ানো জনগোষ্ঠীর কাছে প্রিয় থেকে প্রিয়তম হয়ে ওঠে।
ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকে তাদের বসতিস্থল, যার ধারাবাহিকতায় এই অঞ্চলসমূহে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে দুই পরাশক্তির উত্থান ঘটে। তার একটি ছিল দক্ষিণাঞ্চলীয় সেমেটিক গোষ্ঠী এবং অন্যটি উত্তরের ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। মনে করা হয়, তাদেরই একটি শাখা দক্ষিণ-পশ্চিম ও পশ্চিমাঞ্চলে অগ্রসর হয়েছিল। তারা আধুনিক ইরান অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে।
ইন্দো-ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দুটি শক্তিধর গোত্র ছিল মেডেস ও পার্সীয়। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দের দিকে এশেরীয়দের পতন তাদের কপাল খুলে দেয়। তারা পারস্য উপসাগর ও কৃষ্ণসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এ সময় গড়ে তুলেছিল শক্তিশালী পারস্য সাম্রাজ্য। মেডেস এবং পার্সীয়রা সেমেটিকদের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন ছিল। এশিয়া মাইনর অঞ্চলে তখন তাদের সামনে দাঁড়াবার মতো শক্তিশালী কোনো জাতির অস্তিত্ব ছিল না।
প্রাচীনকালে পার্সীয়দের ব্যবহৃত ভাষা পার্স থেকেই পারস্য শব্দটির উদ্ভব। তারাও নিজেদের আর্য জাতির অংশ বলে পরিচয় দিতে বেশি উৎসাহী ছিল। তাই পারস্যও আর্যদের আদি জন্মভূমি বলে মনে করেন অনেক ইতিহাস গবেষক। ধারণা করা হয়, যাযাবর জীবনের একপর্যায়ে পার্সীয়রা প্রথমে আধুনিক ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে বসবাস শুরু করে। তারা সেখানে পাসারগাদিয়া ও পার্সেপলিস নামে দুটি বিখ্যাত শহর গড়ে তুলেছিল। গ্রিকদের কাছে পার্সা ও পারসিস নামে পরিচিত পারস্যের এই অংশটি সম্রাট দারিয়ুসের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ ছিল।
পার্সীয়দের বিশ্বাসমতে, এদের পূর্বপুরুষ ছিলেন ‘একেমেনিস’। তাই তারা অনেক ক্ষেত্রে আকামেনিড নামেও পরিচিত। আকামেনীয় সাম্রাজ্য নামেও একসময় পারস্য পরিচিত হয়েছিল। পারস্য রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার শেষ দুর্বৃত্ব রেজা শাহ পাহলবীর সময় ‘ইরান’ নামটি গ্রহণ করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ছয় শতক থেকে শুরু করে পার্সীয়দের সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
পারস্যের পূর্বদিকে ছিল এক উঁচু পর্বত যা তাদের জন্য প্রাকৃতিক দেয়াল তৈরি করেছিল। সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল পোতাশ্রয় গড়ে তোলার পাশাপাশি বাণিজ্য বিকাশের পথ করে দেয়। বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত প্রাচীন পার্সীয়রা ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্রথম কয়েকটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল। তার মধ্যে খ্রিষ্টপূর্ব ছয় শতকের দিকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মধ্যে মিডিয়ায় মেডেস রাজ্য শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা অন্যান্য পার্সী রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। মিডীয় শাসনকর্তাদের নৈতিকতার অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে তাদের সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
পারস্য সম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে মূলত সাইরাসের উত্থানের মধ্য দিয়ে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৯ অব্দে সাইরাস দক্ষিণ পারস্য গোত্রের রাজা হন। পাঁচ বছরের মধ্যেই তিনি প্রতিবেশী বিভিন্ন অঞ্চলের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমগ্র পারস্যের সম্রাট হয়ে বসেন। বলে রাখা ভাল, ইংরেজিতে অনেক বড় যোদ্ধা বোঝানোর জন্য সাইরাসের নামের আগে যে গ্রেট বসানো হয়ে থাকে তার বাংলা ভাবানুবাদের ভুল শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ‘মহান সাইরাস’ নামে। একজন রক্তপিপাসু যোদ্ধা, প্যাথলজিক্যাল কিলার এবং দখলবাজকে আর যা-ই হোক, মহান বলার সুযোগ তুলনামূলক কম। তবে তিনি নিঃসন্দেহে একজন দূরদর্শী বিজেতা ছিলেন। মাত্র বিশ বছরের মধ্যে তিনি সমকালীন ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ভূখণ্ডের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
আধুনিক তুরস্কের উত্তরাংশে এবং সমকালীন পশ্চিম এশিয়া মাইনরের অর্ধাংশ লিডিয়া রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেশটি শুধুমাত্র হালিস নদী দ্বারা লিডিয়া থেকে পৃথক ছিল। এই লিডিয়া বিজয়ই ছিল সাইরাসের প্রথম বিজয়। পারস্য আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লিডীয়দের রাজা ক্রসাস মিসর ও স্পার্টার সঙ্গে মৈত্রী জোট বাঁধেন। তবে তাতেও তাদের শেষরক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক যুদ্ধবাজ আদিবাসী গোষ্ঠীকে প্রতিহত করতে গিয়ে ৫২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরাসের মৃত্যুর পরও পারস্য সাম্রাজ্য থেমে থাকেনি। এরপর শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে তারই ছেলে ক্যাম্বিসেস (৫২৯-৫২২ খ্রিস্টপূর্ব)।
ক্যাম্বিসেস ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশর দখল করে। সেখানে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালায় পারস্য সেনাবাহিনী। তাদের ভয়াবহ যুদ্ধবাজ নীতি পারস্য অধিকৃত এশিয়া অঞ্চলে বিদ্রোহের জন্ম দেয়। পারস্যের শোষণের বিরুদ্ধে তখন ক্যালডীয়, ইলামাইট, এমনকি মিডীয়রাও একজোট হয়া। তারা তাদের স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে। এমন নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি ক্যাম্বিসেসকে দেশের দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য করে। পথিমধ্যে আততায়ীর হাতে জান দিতে হয় তাকেও। এর অল্পদিন পর বিদ্রোহে উত্তাল পারস্যের শাসনক্ষমতা দখল করেন দারিয়ুস (৫১২-৪৮৫ খ্রিস্টপূর্ব)। দীর্ঘদিনের শাসনকালে সম্রাট প্রথম দারিয়ুস তার বিজয় অভিযান এবং প্রসাশনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন।
দারিয়ুস ক্ষমতায় বসেই শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বেশ কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পারস্য সাম্রাজ্য ব্যাপক বিস্তার লাভ করে তার সময়ে। পূর্বদিকে ভারতের পাঞ্জাবে সিন্ধুনদের তীর আর পশ্চিমদিকে মধ্য ইউরোপে দানিয়ুব নদীর তীর পর্যন্ত সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ করেন তিনি। মেসিডোনিয়া এবং উত্তর গ্রিসের অংশবিশেষও দখল করেন তিনি।
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর দারিয়ুস গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের দ্বারপ্রান্তে প্রথম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। হেলেসপন্ট পার হয়ে থ্রেসীয় উপকূলের একটি বড় অংশ দখল করেন তিনি। এতে এথেনীয়রা দারিয়ুসের উপর চরম মাত্রায় ক্ষেপে যায়। এর বাইরে তিনি আয়োনীয় এবং থ্রেসীয়দের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ করার পাশাপাশি জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে বাধ্য করায় এই অঞ্চলের প্রতিটি নগর তার বিরুদ্ধে আগ্নেয়গিরির রূপ নেয়। বলতে গেলে এই এলাকার ঘরে ঘরে বিদ্রোহ দেখা দেয দারিয়ুসের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন নগর দারিয়ুসের আধিপত্য মেনে নিয়ে নিজ নিজ দেশের মাটি আর পানি পাঠিয়ে দিলেও তার ঘোষণায় কর্ণপাত করেনি এথেন্স ও স্পার্টা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দেখে দারিয়ুস ৬০০ জাহাজের এক বিরাট বহর নিয়ে এথেন্সের দিকে অগ্রসর হন। তার নেতৃত্বাধীন এই বাহিনীর জাহাজে প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্য ছিল। তিনি যতটা সহজে যুদ্ধ জিতে যাবেন ভেবেছিলেন, বাস্তবে মোটওে তেমন ঘটেনি। তার বিরুদ্ধে মাত্র ৯০টি জাহাজ নিয়েই মরণপণ প্রতিরোধ গড়ে তুলল এথেনীয়রা। এথেন্স নগরীর ২৬ মাইল দূরে ম্যারাথন উপসাগরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এথেনীয়দের তীব্র দেশপ্রেম আর উন্নত সামরিক কৌশলের কাছে দারিয়ুসকে নতি স্বীকার করতে হয়।
৪৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দারিয়ুসের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে জারজেস পারস্যের সিংহাসন দখল করে। সাম্রাজ্যবাদী নীতি ধরে রেখে বাবার মতো সে নিজেও সালামিস, পালাশিয়া ও মাইকেলি দখল নিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। গ্রিকদের বিরুদ্ধে লড়াই বারংবার পরাজয় মেনে নিতে না পেরে খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৫ অব্দে মারা যান জারজেস। শক্তিশালী শাসকের অনুপস্থিতিতে ৪৬৫ থেকে ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে পারস্যে রাজনৈতিক অসন্তোষ চরমে ওঠে।
রাজনৈতিক অসন্তোষের শেষ পর্বে ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুস পারস্য সাম্রাজ্যকে শেষ রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি মেসিডোনিয়ার সম্রাট গ্রিক বিজেতা আলেকজান্ডারের কাছে পরাজিত হওয়ার পর নিজের লোকদের হাতেই খুন হন। তৃতীয় দারিয়ুসের মৃত্যুর পর সমগ্র পারস্যের উপর আলেকজান্ডারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
দীর্ঘদিনের রাজ্য পরিচালনায় পারস্যের সবথেকে বড় অবদান প্রশাসনে। তারা এশেরীয় মডেলের উপর ভিত্তি করেই পারস্যের সরকার-কাঠামো গড়ে তুলেছিল। বিস্তৃত সাম্রাজ্যে বিভিন্নমুখী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন ছিল তার সার্থক প্রতিফলন ঘটে পারস্য প্রশাসনে। পারস্য প্রশাসন গড়ে তোলার মুখ্য কৃতিত্বের দাবিদার সম্রাট প্রথম দারিয়ুস। প্রকাণ্ড সাম্রাজ্যের সংহতির জন্য একটি দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজন প্রথম থেকেই অনুভূত হয়েছিল। সম্রাট সাইরাসকে দিয়ে প্রথম পদক্ষেপ শুরু হলেও তা পরিণতির দিকে নিয়ে যান সম্রাট দারিয়ুস। তার শাসন প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ থাকলেও সরকার-ব্যবস্থায় জনগণের বক্তব্য প্রকাশের কোনো সুযোগ ছিল না।
পারস্যের প্রশাসনিক কাঠামোতে সবার আগে বলা যেতে পারে রাজার সর্বময় ক্ষমতার কথা। তাদের প্রশাসনে রাজা একাধারে সামরিক, বেসামরিক, এবং বিচার বিভাগের প্রধান ছিলেন। প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে সম্রাট দারিয়ুস প্রাদেশিক প্রশাসনের দিকেও মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের বিবেচনায় চারটি রাজধানী গড়ে তুলেছিলেন। তার চারটি রাজধানীর মধ্যে ছিল সুসা (Susa), একবাটানা (Ecbatana), ব্যবিলন (Babylon) এবং পার্সেপলিস (Persepolis)। তিনি সাম্রাজ্যকে ২১টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। পারস্যের ভাষায় প্রদেশকে বলা হত স্যাট্রাপি (Satrapy)। দারিয়ুস যোগ্যতার বিচারে প্রতি প্রদেশে একজন করে প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা স্যাট্রাপ (Satrap) নিয়োগ করতেন। স্যাট্রাপগণ প্রদেশের সামরিক ও বেসামরিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
প্রাদেশিক প্রশাসনের উপর নিয়ন্ত্রণ পারস্য সাম্রাজ্যকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। স্যাট্রাপদের হাতে ক্ষমতা দিয়েও সম্রাট প্রথম দারিয়ুসের সতর্ক দৃষ্টি ছিল শাসনকর্তাদের প্রতি। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ভাষা, আইন, প্রথা, আদর্শ, ধর্ম, ঐতিহ্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে স্বাভাবিক বৈচিত্র্য ছিল। পারস্য সম্রাটের উপর আনুগত্য প্রদর্শন ও প্রয়োজনীয় কর প্রদানের বিনিময়ে এ সমস্ত অঞ্চলের জনগণ স্বাধীনভাবে যার যার জীবনযাত্রা পরিচালনা করতে পারত।
সাম্রাজ্যের প্রায় প্রতি অঞ্চলের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই উদ্দেশে পারস্যে বড় বড় রাস্তা তৈরি হয়। তাদের এই নাগরিকবোধ পরবর্তীকালে রোমান সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছিল। প্রধান রাস্তাগুলো সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সার্দিস থেকে সুসা পর্যন্ত যুক্ত হয়েছিল তাদের ‘রাজকীয় সড়ক’ (Royal Road) । রাজকীয় সড়কের ১৪ মাইল পর পর নির্মাণ করা হয়েছিল একেকটি স্টেশন। রাজকীয় সংবাদবাহকরা এখান থেকে নতুন ঘোড়া বদলিয়ে নিতেন। পনি এক্সপ্রেস (Pony Express) বলে পরিচিত এই প্রাচীন ঘোড়ার ডাকব্যবস্থায় সংবাদবাহকরা দেড় হাজার মাইল পথের দূরত্ব মাত্র সাত দিনে অতিক্রম করতে পারত। সাধারণ মানুষের এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগত প্রায় তিন মাস।
সম্রাট প্রথম দারিয়ুস সমুদ্র বাণিজ্যের উন্নয়নে নীলনদের সঙ্গে লোহিতসাগরের সংযোগ রক্ষাকারী প্রাচীন খালের সংস্কার করেন। সংস্কারের প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে পারস্যের সঙ্গে মিশরের বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। বৃহৎ নৌশক্তি গড়ে তোলার জন্য পার্সীয়গণ ফিনিশীয় এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নাবিকদের সহযোগিতায় যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করে। তারা দক্ষ নৌসেনার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নাবিক সাইলাক্সের নেতৃত্বে সম্রাট প্রথম দারিয়ুস ভারতের সিন্ধুনদ পর্যন্ত তাঁর বিজয় অভিযান পরিচালনা করেন।
অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ তাঁর বিশ^সভ্যতা গ্রন্থের প্রাচীন যুগে উল্লেখ করেছেন, “সম্রাট দারিয়ুস চিকিৎসাবিজ্ঞানের গুরুত্ব অনুধাবন করে ধ্বংসোন্মুখ মিসরীয় চিকিৎসা বিদ্যালয়ের সংস্কার সাধন করেছিলেন। তিনিই হচ্ছেন প্রথম এশীয় রাজা যিনি রাজকীয় তত্ত্বাবধানে একটি চিকিৎসা বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নয়নেও তাঁর প্রচেষ্টা ছিল। বিখ্যাত ক্যালডীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী নেবুরিমানুর জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণার প্রতি সম্রাট দারিয়ুসের সমর্থন ছিল। সম্রাট কর্তৃক নেবুরিমানু পৃষ্ঠপোষকতাও লাভ করেছিলেন। অপর ক্যালডীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী কিদিনু (Kidinnu)-কেও পারস্য সরকার পৃষ্ঠপোষণ করেছে।
অন্যদিকে, বাণিজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় পারস্যের অবদান ছিল চোখে পড়ার মতো। সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সম্রাট প্রথম দারিয়ুস বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন অঞ্চলের বর্বর জাতিগোষ্ঠীর সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে সাম্রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কৃষিকে নিরাপদ করার চেষ্টা চালান। এজন্য তিনি বিভিন্ন সড়ক ও সমুদ্রপথে উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দিলেও প্রাচীন বিশ্বের বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মধ্যে পারস্য সবচেয়ে ধনী হয়ে ওঠে।
পার্সীয়দের ব্যবহৃত কিউনিফর্ম লিপি থেকেই পশ্চিম এশিয়ার কিউনিফর্ম লিপির পাঠোদ্ধার সহজ হয়েছিল। অত্যন্ত সহজবোধ্য কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে পার্সীয়রা ৩৯টি বর্ণ চিহ্ন ব্যবহার করত। উনিশ শতকের প্রথমদিকে গ্রোটেফেন্ড (Grotefend) নামের একজন জার্মান স্কুল শিক্ষক সর্বপ্রথম সম্রাট দারিয়ুস ও জারজসেরে নামসহ বেশ কয়েকটি পার্সীয় শব্দ পড়তে সক্ষম হন।
পরবর্তীকালে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা স্যার হেনরি রাওলিনসন (Sir Henry Rowlinson) প্রাচীন পার্সীয় ভাষার চূড়ান্ত পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হন। রাওলিনসনের ইরানের কারমান শাহ হামদান নামক শহরে বাহিস্তান পাহাড়ের ৩০০ ফুট উঁচ্চতায় লম্বায় ২৫ ফুট আর প্রস্থে ৫০ ফুট শিলালিপিটি দেখতে পেয়েছিলেন, যার গায়ে তিন ধাপে তিনটি ভাষায় লেখা খোদাই করা ছিল। একটি প্রাচীন পার্সী, অন্যটি ইলামাইট, এবং শেষটি কিউনিফর্ম। রাওলিনসনের সাফল্যের পথ ধরেই প্রাচীন ব্যাবিলনের কিউনিফর্মের স্বরূপ উন্মেচিত হয়।
অধ্যাপক শাহনাওয়াজ মনে করেন, চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে প্রাচীন পারস্যের খুব একটা ভূমিকা ছিল না। পার্সীয়রা তাদের আদিম মেষপালকের জীবন থেকে এক্ষেত্রে খুব একটা বেরিয়ে আসতে পারেনি। তারা বিজিত অঞ্চলসমূহ থেকে শিল্পকলার ধারণা লাভ করে এবং সীমিত ক্ষেত্রে তার ব্যবহার করে।
অন্যদিকে পাসারগাদিয়া এবং পার্সেপলিসে সম্রাট কাইরাস ও দারিয়ুসের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদ পার্সীয় স্থাপত্য সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেয়। মূল প্রাসাদটি ছিল পাহাড়ের উপরে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হতো। এশেরীয়দের অনুকরণে প্রাসাদের উপরে প্রকাণ্ড পাখা মেলে দেওয়া ষাঁড়ের প্রতিকৃতি ছিল। মূল স্তম্ভের অঙ্গ সৌন্দর্যের জন্য এই ষাঁড় খোদিত হয়েছিল। প্রাসাদের ছাদ ছিল কাঠের তৈরি। আলো বাতাসের প্রয়োজনে প্রশস্ত কক্ষ তৈরি করা হতো। প্রাসাদের অভ্যন্তরে অলংকরণের জন্য ব্যবহার করা হতো উজ্জ্বল রঙের ইট। দেওয়ালের গায়ে রাজা ও ভৃত্যদের প্রতিকৃতি খোদিত ছিল। সাইরাসের সমাধি অত্যন্ত নিপুণতায় সংরক্ষিত ছিল। পিরামিড আকৃতিতে এটি তৈরি করা হয়। এটি ছিল ছয় ছাদবিশিষ্ট ত্রিকোণ ঘর। প্রাসাদের তুলনায় এই স্থাপত্যিক নিদর্শন ছিল আরো সরল ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
পারস্যের ধর্ম ছিল মূলত প্রকৃতিনির্ভর। তারা প্রাচীনকাল থেকে সূর্য, বৃষ্টি, বাতাস, আকাশ, মাটি ও আগুনের পূজা করত। পূজায় তারা এসমস্ত প্রাকৃতিক শক্তির উদ্দেশে প্রার্থনা করত, এবং শস্য, ফুল, দুধ ইত্যাদি উৎসর্গ করত। এরপর তাদের মধ্যে জনপ্রিয় ধর্মীয় মতবাদ হিসেবে জরথুস্ত্রবাদের জন্ম হয়। তাদের ধর্মীয় নেতা জরথুস্ত্র খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০ থেকে ৬০০ অব্দের দিকে মিডিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের বিশ্বাসে ত্রিশ বছরে বয়সে জরথুস্ত্র সর্বশক্তিমান আহুরামাজাদা তথা আলো ও জ্ঞানের অধিপতির কাছ থেকে জ্ঞান ও বুদ্ধির গ্রন্থ আবেস্তা লাভ করেন। তিনি পারস্যের বিভিন্ন প্রাচীন বিশ্বাসের মধ্য থেকে বহু দেবতার আরাধনা, পশু উৎসর্গ ও যজ্ঞ, নরবলি, যাদুটোনা প্রভৃতির উচ্ছেদ ঘটিয়েছিলেন। খ্রিস্টীয় সাত শতকে মুসলিম বিজেতারা পারস্য অধিকারের পর পারস্যে জরথুস্ত্রবাদের প্রভাব কমে যায়।
জরথুস্ত্রবাদকে জানার মূল উৎস মনে করা হয় তাদেও ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাকে। আবেস্তার বিবরণীগুলো আবার চার ভাগে বিভক্ত। তার মধ্যে রয়েছে:
১. ইয়াসনা (Yasna): প্রাচীন পার্সীয় ভাষায় লেখা প্রার্থনা-সঙ্গীত।
২. ইয়াস্ট (Yashts): প্রশংসা সঙ্গীত।
৩. বিসপেরাদ (Visperad) : আহুরা মাজদার সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পাঠ করার মন্ত্র।
৪. বিদেভদাত বা ভেনদিদাত (Videvdat or Vendidat): শয়তান বিতাড়ন ও দেহকে পবিত্র করার মন্ত্র।
আবেস্তার পূর্ণাঙ্গ সংকলন তৈরিতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। পারস্য সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় পর্যায়ে আবেস্তা মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।
যা-ই হোক, ধারণা করা হয় দশ খ্রিস্টাব্দের দিকে জরথুস্ত্রবাদের একটি শাখা পারস্য থেকে উত্তর ভারতে প্রবেশ করে। অনেক ধনী ব্যবসায়ীদের এই গোষ্ঠী কালের আবর্তে পারসিক তথা অগ্নি উপাসক নামে পরিচিত হয়। গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে এরা প্রাথমিকভাবে পেশা হিসাবে কৃষিকাজ বেছে নিয়েছিল। বৃটিশরা ভারতে তাদের জবরদখল প্রতিষ্ঠার পর পার্সীয়রা তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। তারা সামুদ্রিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বেশ সমৃদ্ধিশালী একটি জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। তারা গুজরাট ও মহারাষ্ট্র থেকে বর্তমান মুম্বাইয়ের দিকে সরে যেতে থাকে। জরথুস্ত্রবাদের বাইরে অন্যান্য ধর্মীয় ধারণা হিসেবে মিথ্রাসবাদ এবং মানিবাদ পারস্যের জনগণকে প্রভাবিত করেছিল।
এশেরীয়দের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোকে উন্নততর রূপ দিয়ে প্রায় ২০০ বৎসর স্থায়ী একটি সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার কৃতিত্ব পারসীয়দের। তাদের ধর্মে ছিল সুস্পষ্ট মৌলিকত্বের ছাপ। ঘোড়ার মাধ্যমে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন, ‘কানাত টানেলের’ মাধ্যমে পানি সরবরাহ লাইন গড়ে তোলা, উন্নততর কিউনিফর্ম লিপির বিকাশ, কর ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ছিল তাদের বিশেষ অর্জন। এমনকি সেই ৪০০ খ্রিস্টপূর্বোব্দেই তারা গড়ে তুলেছিল ইয়াখচাল (Yakhchāl) নামক হিমাগার। ইয়াখ অর্থ বরফ আর চাল অর্থ গর্ত। আর সে হিসেবে বরফের গর্তের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের এই দুর্দান্ত প্রযুক্তি ছিল তাদেরই। তবে সম্রাটদের স্বৈরাচারী মনোভাব, অধিকৃত অঞ্চলের উপর করের বোঝা চাপানো আর সীমাহীন হিংস্রতা তাদের পতন ডেকে এনেছিল।