মেসোপটেমীয় সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
কোনো একক সভ্যতা না হয়েও সভ্যতার ইতিহাসের একটা চিরচেনা গল্প, অল্প অল্প করে বিস্তার ঘটেছিল যার। যদি দুটি নদীকে নিয়ে ইতিহাসের এই আলেখ্য রচনা হয়ে থাকে, তবে নামকরণটা অদ্ভুত সুন্দরভাবে মিলে মিশে একাকার হয়েছে ‘মেসোপটেমিয়া’ শব্দবন্ধে। গ্রিক শব্দ থেকে মেসোস (Mesos) তথা ‘মধ্যবর্তী’ এবং পটামোস (Potamos) অর্থাৎ ‘নদী’ থেকে আমরা সহজ বাংলায় বলতে পরি ‘দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমি’।
দজলা-ফোরাত কিংবা টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস যা-ই বলা হোক, মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বিস্তার দুটি নদীর তীরে অবস্থিত পলল বিধৌত উর্বর ভূমিতে। মানচিত্রের মাঝে এই উর্বর ভূমিরূপকে দেখাত অনেকটাই বাঁকানো চাঁদের মতো। তাই এর একটা গালভরা নামও দেওয়া হয়েছিল- ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’।
মূলত ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন আর জর্দান মিলেই এই ফার্টাইল ক্রিসেন্টের বিস্তার। অনেকে কুয়েতের উত্তরাংশ এবং তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাংশের পাশাপাশি ইরানের পশ্চিম দিকের একাংশকে এই উর্বর অর্ধচন্দ্রাকৃতির ভূমিরূপ তথা ফার্টাইল ক্রিসেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
মার্কিন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক জেমস হেনরি ব্রেস্টেড (James Henry Breasted) অর্ধচন্দ্রাকৃতির এই উর্বর জমিনকে অনেকটা যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই নামে পরিচয় করিয়েছিলেন তার দুটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ফলাফল, অর্থাৎ ১৯১৪ সালে লেখা ‘Outlines of European History এবং ১৯১৬ সালে লেখা Ancient Times: A History of the Early World’ শীর্ষক গ্রন্থ দুটিতে।
সহজ ভাষায় বললে, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দের দিকে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস তথা দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে মিসরীয় সভ্যতার সমকালীন একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন সভ্যতার সমন্বয়ে বৃহৎ ভৌগোলিক সীমারেখাকে একই নামে চিহ্নিত করতে গিয়ে সেই সভ্যতার নাম দেওয়া হয় মেসোপটেমীয় সভ্যতা।
ভৌগোলিক বিস্তারের কথা হিসেব করতে গেলে এশিয়া মহাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীনতম সভ্যতা এটিই। মূলত সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয় এবং ক্যালডীয় সভ্যতার সম্মিলিত রূপকেই আমরা চিনি মেসোপটেমিয়া সভ্যতা হিসেবে।
এই সভ্যতার বিকাশ যে অঞ্চলে ঘটেছিল, তার উত্তরে আর্মেনিয়ার পার্বত্যাঞ্চল, পশ্চিম ও দক্ষিণে আরব মরুভূমি, দক্ষিণ-পূর্বে পারস্য উপসাগর, পূর্বে এলাম পার্বত্যাঞ্চল এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর অবস্থিত।
উত্তর ও পূর্বদিকে উচ্চ পার্বত্যাঞ্চল মেসোপটেমিয়াকে প্রাকৃতিক প্রাচীরের সুবিধা দিয়েছে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই সুমেরীয়, আক্কাদীয়, আমোরাইট, ক্যাসাইট, অ্যাসিরীয় এবং ক্যালডীয় জাতিগোষ্ঠী মিলে প্রাচীনকালে এই ভূখণ্ডে একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে তোলে।
মনে করা হয়, এই সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে ভৌগোলিক অবস্থানের প্রভাব অনেক। অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ তাঁর ‘বিশ্বসভ্যতা’ শীর্ষক গ্রন্থের ‘প্রাচীন যুগ’ অংশে লিখেছেন, “টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী প্রতি বছর দু’কূল প্লাবিত করত। ফলে পলি জমে জমে উর্বর হয়ে উঠত ভূখণ্ড। তথাপি মেসোপটেমিয়াতে সহজ কৃষি গড়ে তুলতে বেশ খানিকটা বাধা ছিল। প্লাবনের সময় ছিল অনিয়মিত এবং প্রকৃতি ছিল খেয়ালি। বন্যার পাশাপাশি প্রচণ্ড ঝড়ও প্রবাহিত হত। এছাড়াও সমস্যা ছিল, বন্যার পরে অধিকাংশ পলল ভূমিতে আগাছা ও ঝোপঝাড় জন্মাত, যা ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল শ্রমশক্তির। গ্রীষ্মে এ অঞ্চলে খরা হতো। তাই কৃষির জন্য প্রয়োজন ছিল সেচ ব্যবস্থা প্রণয়নের।”
অন্যদিকে মেসোপটেমিয়ার অবারিত সীমারেখায় দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল আরব মরুভূমির বিস্তীর্ণ এলাকা। সেমেটিক ভাষাভাষী প্রায়-যাযাবর জনগোষ্ঠী বসতি গড়ে তুলেছিল সেখানে।
পূর্ব ও উত্তর সীমান্ত, বিশেষ করে ইরান ও আর্মেনিয়ার পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বিপুল জনগোষ্ঠী মেসোপটেমিয়ায় বসবাস শুরু করে। তবে এই অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলায় প্রথম নেতৃত্ব দেয় সুমেরীয়রা। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে মেসোপটেমিয়ার ইউবেইদ অঞ্চলে কয়েকটি জনবসতি পাওয়া গিয়েছে। এর থেকে বিস্তৃত ফার্টাইল ক্রিসেন্টের গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে।
দক্ষিণে প্রাচীন ইরিদু (Eridu) অঞ্চলে তেল আবু শাহরাইন (Tell Abu Shahrain) ও উর (Ur) এবং উত্তরে তেপে গাওরায় (Tepe Gawra) প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে গবেষকগণ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন এই ইউবেইদ সংস্কৃতির মানুষেরা প্রাথমিক দিকে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে নগর সভ্যতার পত্তন করে। তারা রোদে শুকানো তথা না পুড়িয়ে তৈরি করা ইটে ঘরবাড়ি বানাত। ইউবেইদ সংস্কৃতির আরো দক্ষিণে ওয়ারকা (Warka) অঞ্চলে ইয়াননা মন্দির (Eanna Temple) আবিষ্কারের পর আরেকটি বিশেষ সংস্কৃতি সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি হয় গবেষকদের।
ইউবেইদের মতো ওয়ারকা সংস্কৃতি সুমেরীয় ভাষায় ইউরুক (Uruk) ও সেমেটিক ভাষায় ইরেচ (Erech) নামে পরিচিত। এই সংস্কৃতি আদি স্বাক্ষরতা যুগের (Protoliterate) মেসোপটেমিয়ার কথা জানান দিচ্ছে। প্রাথমিক যুগের সংস্কৃতি হিসেবে এই ওয়ারকাতে উন্নতমানের মৃৎপাত্র তৈরির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ইয়াননায় অবস্থিত দেবতা আনুর (Anu) মন্দির এই সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন।
প্রাথমিক যুগের মেসোপটেমিয়া তথা ওয়ারকার অন্যতম স্থাপত্যিক নিদর্শন শ্বেতমন্দির (White Temple)। তখনকার প্রচলিত প্রথানুযায়ী নির্মিত এই শ্বেতমন্দিরের ভূমি নকশা ছিল আয়তাকার।
দজলা-ফোরাত নদীর তীরে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার প্রাথমিক বিকাশের সময় হিসেবে মনে করা হয় ৩৫০০-৩০০০ খ্রিস্টপূর্বকে। তখন এই অঞ্চলের নিচু সমতলে প্রথম সংস্কৃতির চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। ধারণা করা হয়, ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাদের শেষদিকে কয়েকটি জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলেছিল।
প্রাথমিক দিকের মেসোপটেমিয়াতে গড়ে উঠেছিল কিছু ইতিহাসখ্যাত নগররাষ্ট্র। তৎকালীন মেসোপটেমীয় নগররাষ্ট্র হিসেবে উর, ইউরুক, লাগাশ, উম্মা প্রভৃতির কথা বলা যায়। প্রাচীন গ্রামসমূহের চেয়ে আকারে বেশ বড় ছিল এই নগররাষ্ট্রগুলো। পাশাপাশি এখানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের কেন্দ্রভূমিও গড়ে উঠেছিল।
ইউবেইদ ও ইউরুক যুগের সংস্কৃতির বিকাশ মেসোপটেমীয় সভ্যতাকে পথ দেখায়। মূলত, এই জনগোষ্ঠী সভ্যতার যুগে দ্রুত পদার্পণ করেছিল তাদের সাংস্কৃতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে। তাদের সময়কে বলা যেতে পারে মেসোপটেমীয় সভ্যতার উত্থানপর্ব হিসেবে। আনুমানিক ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই স্বল্পস্থায়ী নগররাষ্ট্র ধাঁচের উন্নত সংস্কৃতির বিলোপ ঘটে।
সভ্যতার উন্মেষপর্ব হিসেবে মনে করা যেতে পারে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দকে। এই সময়ের শেষ দিকে মেসোপটেমীয়রা টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস নদীর পানি বাঁধ দিয়ে আটকে ফেলে। তারা কৃষিকাজের প্রয়োজনে এই বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা পানি সেচের জন্য ব্যবহার করতে থাকে। তারা প্রচুর খাল খননের মাধ্যমে বন্যা প্রতিরোধের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পানি ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল। এতে অভূতপূর্ব সাফল্য এসে ধরা দেয় তাদের হাতে।
ফার্টাইল ক্রিসেন্ট অঞ্চলের কৃষকরা কাঠের লাঙল ব্যবহার করলেও পাথরের কুঠার তাদের ব্যবহার্য হাতিয়ারের মধ্যে ছিল। তাদের প্রধান উৎপাদিত ফসল মনে করা হতো যবকে।
তখনকার মেসোপটেমিয়াতে গৃহপালিত পশুর মধ্যে সিংহভাগ ছিল ভেড়া ও ছাগল। তবে পশুপালনের সময় নিরাপত্তাজনিত কারণে রাখালরা অনেক সময় কুকুর ব্যবহার করত।
মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে মাটির দেওয়াল দিয়ে তার ভেতরে বাগান তৈরি করা হত। মূলত বাইরের তৃণভোজী জন্তু থেকে তারা এই বাগানকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছিল। এসব বাগানে মেসোপটেমীয় অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ফলের গাছ রোপণ করেছিল বলে জানা গিয়েছে।
এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত মাটি পরীক্ষা করে বিভিন্ন গাছের পরাগরেণু ও শেকড়ের ফসিলের পাশাপাশি ফাইটোলিথ, সিস্টোলিথ ও লিথোসিস্ট পাওয়া গিয়েছে। এ আলোকে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ অনুমান করতে পারেন কোন ধরনের উদ্ভিদ বিন্যাস ছিল এই অঞ্চলে।
তবে বাগানের চৌহদ্দি তৈরির ক্ষেত্রে এখানে খেজুর গাছ লাগানোর কথাও জানা গিয়েছে। কৃষিজমি তথা ফসলের মাঠ থেকে বিভিন্ন শহরে ফসল পরিবহনের জন্য স্থলপথে গাধা ছিল তাদের মূল বাহন। তবে জলপথে তারা নৌকার মতো করে তৈরি বিভিন্ন ছোট-বড় ভেলার ব্যবহার করেছিল বলে অনুমান করা হয়।
নদীর তীরে অবস্থিত মেসোপটেমিয়ার সিংহভাগ শহরের কেন্দ্র ছিল দুর্গবেষ্টিত। দুর্গের দেওয়াল ছিল রোদে শুকানো ইট দ্বারা নির্মিত। এই ইটগুলো তখনও পোড়ানোর ক্ষমতা আয়ত্বে আসেনি মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের মানুষের। বিশেষত, ইউরুক শহরে ৬ মাইল দীর্ঘ দুর্গ ঘেরা একটি অঞ্চল আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, কিংবদন্তির বীর রাজা গিলগামেশ এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন।
তবে এই সময়ে নির্মিত বেশিরভাগ নগরে নগর-তোরণ ছিল। প্রতিটি তোরণের সামনে শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাহারা দিত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মূল আবিষ্কারের একটি ছিল চাকা। তারা চাকার ব্যবহার আয়ত্ব করার পর সেখানে রথ ও ফসলের গাড়ি চলার জন্য রাস্তা তৈরি করতে হয়েছিল। নগরের মধ্যে নির্মিত বেশিরভাগ রাস্তা ছিল প্রশস্ত।
ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন আর জর্দান অঞ্চল থেকে প্রচুর বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এই স্থাপত্যগুলো সেই যুগের আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ দেয়। মনে করা হয়, কৃষক ছাড়াও নগরে কামার-কুমারের বাস ছিল। তবে এই কামার তখন লোহার কাজ করত না। তারা বিভিন্ন ধাতুর হাতিয়ার তৈরিতে দক্ষ ছিল।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের মানুষের প্রাথমিক ধর্মবিশ্বাস ছিল পৃথিবীকেন্দ্রিক। মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের তেমন ধারণা ছিল না। তাদের মতে, মৃত্যুর পর একটি ক্ষণস্থায়ী সময় রয়েছে। অস্পষ্ট ছায়াময় এই স্থানে মৃত ব্যক্তির আত্মা ঘোরাঘুরি করার কথা তাদের ভয়ের কারণ হয়েছিল।
তারা প্রাচীন মিসরীয়দের মতো পরকালের জীবনকে গুরুত্ব দেয়নি বলেই হয়তো পিরামিড তৈরি দূরে থাক, মৃতদেহের সমাধি প্রথাও ছিল সাদামাটা। শবদেহের সঙ্গে তারা অন্য কিছু কবরস্থ করেনি। তখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মৃত্যুর পর শবদেহ মাটি চাপা দেওয়া হত।
মূলত, সুমেরীয় ধর্মে নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা কোনোটাই বিশেষ স্থান পায়নি। তারা জীবনমুখী একটি সহজবোধ্য ধর্মের অনুসারী ছিল বলে অনুমান করা হয়। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রমাণ ছিল শহর সংলগ্ন দেবমন্দির। পাহাড়সদৃশ সিঁড়ির ধাপ কেটে এই মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। এগুলোকে বলা হতো জিগুরাত (Zigurat)। প্রাথমিক মেসোপটেমীয় ধর্ম তথা সুমেরীয়দের ধর্ম ছিল বহু দেবদেবীনির্ভর।
মেসোপটেমীয় সভ্যতার ধরন মিসরীয় সভ্যতার চেয়ে আলাদা ছিল। মিসরের মতো প্রাকৃতিক সুরক্ষা না থাকায় বিভিন্ন সময় বহিঃশক্তি এই সভ্যতাকে আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের মধ্য দিয়ে এর রাজনৈতিক ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে। তাই এই অঞ্চলের জাতিসত্তা ছিল বিভিন্ন জাতির মিশ্রণে গড়া। এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন গড়ে উঠেছিল সময় ও স্থানভিত্তিতে একটু আলাদা ধারায়।
মিশরের সঙ্গে মেসোপটেমিয়ার জনগণের চিন্তা, ধর্ম ও সমাজ দর্শনেও পার্থক্য ছিল অনেক। প্রাচীন মিসরের মানুষের কাছে সমাজের ভিত্তি ছিল নৈতিকতা। কিন্ত মেসোপটেমিয়া এই নৈতিকতায় ভর করে চুপ থাকেনি। তারা কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মানুষ সূর্যদেবতা শামাশ; বৃষ্টি, বাতাস ও বন্যার দেবতা এনলিল; পানির দেবতা এনকি; প্রেমের এবং উর্বরতার দেবী ইনাননা তথা ইশতার, প্লেগ রোগের দেবতা নারগলের আরাধনা করেছে।
দেবদেবীর উদ্দেশ্যে এরা তেল, মাখন, শাকসবজি, ফল, ফুল, খাদ্য প্রভৃতি উৎসর্গ করত। তাদের প্রধান ধর্মমন্দির ছিল জিগুরাতে, যেখানে থাকতেন তাদের পুরোহিত রাজা। ওখানে থেকে তিনি ‘পাতেজী’ ধর্ম পরিচালনা করতেন।
সুমেরীয়দের ধারণা ছিল, মানুষের ভালো ও মন্দ উভয় বিষয় দেবতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাদের হিসেবে সূর্যদেবতা মানুষের প্রয়োজনে উষ্ণতা ও আলো দেয়। তেমনি তিনি ক্ষিপ্ত হলে মাটি উত্তপ্ত করতে এবং ফলবতী হওয়ার পূর্বে শস্য চারা ধ্বংস করতে জ্বলন্ত রশ্মি পাঠান। তাই দেবদেবীদের ভালো ও মন্দের এই দ্বৈত রূপ মেসোপটেমীয় সভ্যতার পরবর্তী পর্যায়ে আর সেভাবে দৃষ্টিগোচর হয়নি।
দুটি নদীর তীরে গড়ে উঠলেও এই সভ্যতার চারপাশ ছিল অরক্ষিত। তাই বার বার এই সভ্যতা আক্রান্ত হয়েছে বহিঃশক্তির আক্রমণে। তারপরেও প্রাকৃতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে মেসোপটেমীয় অঞ্চলে সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয় এবং ক্যালডীয় সভ্যতার ধারাবাহিক বিকাশ ঘটেছে। তাই মেসোপটেমীয় সভ্যতাকে একটি স্বতন্ত্র কোনো সভ্যতা হিসেবে বিশ্লেষণ করার সুযোগ নেই।