জিলাপির ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
ডাক্তারদের রক্তচক্ষু, ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি, আর ডায়বেটিস রোগীদের জন্য প্রাণহানীর শঙ্কা- কোনো কিছুতেই কাজ হয় না। নানা ধর্মীয় বিধানের বাইরে বাঙালির ইফতার আয়োজনে ভাজা-পোড়া যেমন চাই, ঠিক তেমনি চাই জিলাপিও।
সারাদিনের সিয়াম সাধনার পর মুখে একটু পানি দিতে না দিতেই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে পেঁয়াজু, বেগুনি কিংবা চপের উপর কষে একটা কামড় দিতে মন কেমন যেন একটা তাড়না অনুভব করে। ঠিক তেমনি মনটা আকুপাকু করে এক টুকরা কুড়মুড়ে জিলাপির জন্য।
জিলাপির আছে রকমফের। ঢাকার ইয়া পেল্লাই সাইজের শাহী জিলাপি কিংবা ময়মনসিংহের সেই টক জিলাপির বাইরে আরও আছে রেশমি জিলাপি কিংবা প্যাঁচে প্যাঁচে কুণ্ডলি পাকানো অমৃত্তি। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে- কোথা থেকে এলো এই জিলাপি?
জালেবি কিংবা অন্য কোন শব্দ থেকে ঠিক এই জিলাপি শব্দের উৎপত্তি না বোঝা কঠিন। তবে এর শুরুটা ইহুদিদের ‘হানুক্কাহ’ উৎসব থেকে। বুৎপত্তি থেকে বিচার করতে গেলে এই হানুক্কাহকে আমরা আলোক উৎসব তথা ‘ফেস্টিভ্যাল অব লাইট’ বলতে পারে।
এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানা গিয়েছে তালমুদের বর্ণনা থেকে।মনে করা হয় ইহুদিদের দুর্দিনে প্রতিটি ঘরে একটি বাতি জ্বালানোর সামর্থ ছিল না। এরপর পরিবারের জনসংখ্যা অনুযায়ী প্রজ্জলিত মোমবাতির সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। তারপর তারা এই সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
প্রশ্ন উঠতে পারে হানুক্কাহ তো আলোক প্রজ্জ্বলনের উৎসব। এর সঙ্গে জিলাপির সম্পর্ক কোথায়? মূলত আলোক প্রজ্জ্বলনের পাশাপাশি এই সময় শিশু কিশোরদের জন্য মিষ্টান্নের প্রয়োজন দেখা দেয়। তবে অনেক ইহুদির আর্থিক অবস্থা তখন এতোটা ভাল ছিল না যে সহজেই তারা দুধ থেকে বের করা ছানা কিংবা ক্রিম দিয়ে কেকের মতো দামী তৈরি করবে। এক্ষেত্রে যব কিংবা গবের আটা তেলে ভেজে নিয়ে সেটাকে চিনির শিরায় চুবিয়ে তৈরি করা হয় মুখরোচক জিলাপি।
আরামাইক স্ক্রল (Aramaic Scroll) থেকে আমরা জিলাপির প্রাচীন ইতিহাসের একটা সময়কাল নির্ধারণ করতে পারি। সেটা আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছরের পুরাতন। তবে একেবারে শুরুর দিকে জিলাপির গড়ন, গঠন, আকারও আকৃতি কেমন ছিল তা প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে একেবারে শুরুর দিকে জিলাপির আবিষ্কারক হিসেবে মিসরের ইহুদি সম্প্রদায়ের কথা বলা যায়।
কল্পকথা কিংবা গল্পগাথায় যে তথ্য পাওয়া যাক না কেনো জিলাপির ক্ষেত্রে ইতিহাসের গল্পটা অল্পকথায় অন্যভাবে বলা যায়। আর সেখানে সবার আগে তুলে ধরতে হবে মুহম্মদ বিন হাসান আল-বাগদাদির লিখিত ত্রয়োদশ শতাব্দীর রান্নার বইটির কথা। তিনি এখানে প্রথমবারের মতো লিখিত তথ্য হিসেবে তুলে ধরেছেন সুস্বাদু জিলাপির ইতিকথা।
ইহুদিদের হানুক্কাহ উৎসবে আটায় তৈরি তেলে ভাজা আর চিনির শিরায় চুবানো সেই মিষ্টান্নের নাম ছিল ‘জ্বালাবিয়া’। আর তাই এই ‘জ্বালাবিয়া’ খুব সম্ভবত বর্তমান জিলাপির এক্কেবারে আদিরূপ। তবে সময়ের আবর্তে জিলাপি বিশ্বের নানা দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছে।
মোগল দরবারের বিভিন্ন ইতিহাস লেখকের বর্ণনা থেকে জানা গিয়েছে মোগল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রিয় মিষ্টান্নগুলোর একটি ছিল জিলাপি। অনেকে দাবি করেন জিলাপির স্বাদে মুগ্ধ হয়েই তিনি এই মিষ্টির নাম রেখেছিলেন নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে ‘জাহাঙ্গীরা। এর থেকে অনুমান করা যায় মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর কতটা জিলাপি আসক্ত ছিলেন।
তাজমহল, ময়ুর সিংহাসন এবং আরও অনেক রাজকীয় নিদর্শন তৈরিতে বিখ্যাত মোগল সম্রাট শাহজাহান। তিনি যেমন পানের পানিতে ঠাণ্ডা করতে পাহাড় থেকে বরফের চাঁই টেনে আনাতেন। তেমনি চিকেন ফ্রাই খাওয়ার জন্য মুরগি আনতেন কাশ্মির থেকে। এর বাইরে তার খাওয়ার আয়োজনে থাকা বৈচিত্রময় সব মেন্যুর মধ্যে পাতে একটা জিলাপির টুকরারও তথ্য পাওয়া যায়।
পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট দারিয়ুসের খাবার তালিকায় আটার তৈরি, তেলে ভাজা আর চিনির রসে চুবানো বিভিন্ন খাবারের কথা জানা গিয়েছে। আমরা একটু তুলনা করতে গেলে বুঝতে পারি ঐটা নিঃসন্দেহে বর্তমান জিলাপিরই আদি ও অকৃত্রিম রূপ। পরবর্তীকালের পারস্যের নানা ঐতিহাসিক সূত্র থেকে যে বিশেষ মিষ্টান্নের নাম ‘জেলেবিয়া’জানা গিয়েছে সেটাও এই জিলাপিই।
বর্তমান ইরানেরও এই জিলাপি তৈরির বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। তাদের ইফতারির পুরো আয়োজনটাই নানা রকম মিষ্টান্ন নির্ভর। আর তাই সেখানে আজও রমজান মাসে ‘জেলেবিয়া’ তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে অভাবী মধ্যে যেমন বিতরণ করা হয়, তেমনি তা ঠাঁই পেয়েছে বড়লোকের খাবার টেবিলেও।
উসমানীয় যুগের খাবার সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি অধ্যাপক মেলানি বার্ড (Melanie Byrd ) এবং অধ্যাপক জন পি. ডুন (John P. Dunn) সম্পাদিত প্রখ্যাত একটি গ্রন্থ (Cooking through History [2 volumes]: A Worldwide Encyclopedia of Food with Menus and Recipes) থেকে। দুইখণ্ডে রচিত সুবিশাল এই বইটিতে উসমানীয় সালতানাতের পাশাপাশি বিশ্বের অনেক সভ্যতার জনপ্রিয় সব খাবারের বর্ণনা রয়েছে।
বিভিন্ন মাংসের রেসিপি, কাবাব আর বিরিয়ানির বাইরে উসমানীয় সুলতান, সামরিক নেতা, জেনিসারি বাহিনীর সদস্য কিংবা সাধারণ মানুষ সবার টেবিলে ঠাঁই করে নিয়েছিল ‘জালেবিয়া’। আর নিঃসন্দেহে তা যে আমাদের কাছে বেশ প্রিয় জিলাপির অন্যতম রূপ তা বললেও চলে।
জনপ্রিয় ইতিহাস বলছে ভারত উপমহাদেশে জিলাপি এসেছিল মুসলিম বণিকদের হাত ধরে তাদের খাবার প্লেটে প্রথমবারের মতো ঠাঁই নিয়েই। পারস্য ও তুরস্ক থেকে আগত সৈন্যরা তাদের কাছে প্রবল জনপ্রিয় এই খাবার অভিবাসনের সময় সঙ্গে করে ভারতেও নিয়ে আসে।
মনে করা হয়, তুর্কিদের প্রভাবেই ভারতের নানা স্থানে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তাদের দেশে প্রচলিত ‘জালেবিয়া’। তারপর ধীরে ধীরে না বেশ জনপ্রিয়তা পায় হিন্দু, মুসলিম, শিখ, পারসিকসহ প্রায় সব শ্রেণিপেশা ও ধর্মের অনুসারী মানুষের খাবার টেবিলে।
ভারতের প্রখ্যাত গবেষখ কে. টি আচার্য (K. T. Achaya) তার (Indian Food: A Historical Companion) গ্রন্থে জিলাপি সদৃশ অনেক সুপ্রাচীন ভারতীয় খাবারের কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে পঞ্চদশ শতাব্দীর দিকে ভারতে বেশ জনপ্রিয় একটি খাবারের কথা জানা গিয়েছে। অনেকটা শাপের মতো কুণ্ডলি পাকানো এই খাবারকে ভারতবাসী ডাকতো কুণ্ডলিকা নামে। এই কুণ্ডলিকা নামে পরিচিত বেশ জনপ্রিয় মিষ্টান্নটি দেখতে ছিল অনেকটাই জিলাপির মতো ।
কুণ্ডলিকা থেকে ভারতের মানুষের কাছে জিলাপি জনপ্রিয় হয়ে থাকতে পারে। বিশেষত, সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ ‘গুন্যগুনবোধিনী’গ্রন্থে শুধু নামই নয় জিলাপি তৈরির জন্য বিভিন্ন উপাদানের তালিকা পাওয়া। আমরা তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গেলে আধুনিক জিলাপি তৈরির প্রায় সব পদ্ধতির মিল পাই।
ভারতের প্রাচীনতম জিলাপির হিসেব করতে গেলে এই গ্রন্থের আলোকেও আপাত স্থিরকৃত সময়কাল নির্ধারণের চেষ্টা করা যেতে পারে। বিশেষত, এই গ্রন্থের সময়কাল যেহেতু ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ যেহেতু যীশুর জন্মের দেড় হাজার বছর আগেও ভারতের মানুষ জিলাপি খেয়েছে এটা বলাই যায়।
জিলাপি বিশ্বের কোন দেশ সবার আগে তৈরি করেছে !! কোন দেশের মানুষের তৈরি জিলাপি সবথেকে স্বাদের? ছানা নাকি আটায় তৈরি জিলাপি বেশি স্বাদের? এর বাইরে আরও অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে স্ব স্ব দেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মেনে নিতে হবে।
আমরা ধান-চাল আর গম উৎপাদনকারী দেশ। তাই আমাদের দেশের মিষ্টান্নে ধানচালের বিষয়টা থাকার কথা। আর সে হিসেবে আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে আমাদের দেশে কিংবা ভারতবর্ষের মানুষ যেভাবেই হোক জিলাপি তা তার মতো খাবার খেয়ে থাকতে পারে। অন্তত সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘গুন্যগুনবোধিনী গ্রন্থের সময়কাল ও বর্ণনো মেনে নিলে এটা স্বীকার করতেই হয়।
জিলাপির ইতিহাস নিয়ে আমার আপনার ভাবনা চিন্তার সঙ্গে কাছাকাঠি হেঁটেছেন প্রখ্যাত গবেষক পি. কে গোড় (P K Gode)। পুনের ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিচার্স ইন্সটিটিউটের এই প্রখ্যাত গবেষক ১৯৪৩ সালে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন দি নিউ ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকুয়েটিতে। সেখনেও তিনি ‘গুন্যগুনবোধিনী গ্রন্থের রেফারেন্স টেনে জিলাপিকে ১৬০০ বছরের পুরাতন ভারতীয় খাবার হিসেবেই দাবি করেছেন।
অন্যদিকে আরেকটি জৈন সূত্র সম্পর্কে জানা গিয়েছে অধ্যাপক গোড়ের রচনা থেকে। তিনি লিখেছেন ‘প্রিয়মকম্প্রকথা’ শীর্ষক গ্রন্থের সময়কাল আরো প্রাচীন। ১৪৫০ সালের এই গ্রন্থেও বিভিন্ন রান্নার রেসিপির মধ্যে রয়েছে জিলাপির কথা।
রঘুনাথের ‘ভোজন-কুথুহালা’ গ্রন্থে এই ‘প্রিয়মকম্প্রকথা’ থেকেই রেফারেন্স নেওয়া হয়েছে ভারতের বিভিন্ন প্রাচীন খাবার সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে। তাই ভারত কিংবা পশ্চিম এশিয়ায় জিলিবি, জিলিপি, জিলাপি, জেলাপি, জিলাপির পাক, ইমারতি, জাহাঙ্গিরি, জালেবি, জেলেবিয়া কিংবা অন্য যে নামেই ডাকা হোক এর রয়েছে অন্তত সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাস।