আইসক্রিমের অজানা ইতিহাস জানতে দেখুন আমাদের ভিডিও
আর্টিকেল পড়ুন
প্রায় ২৪ বছর ধরে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের শাসক হিসেবে ছিলেন প্রথম চার্লস। তার একটি ভয়াবহ নৃশংসতার গল্প জানা গিয়েছে আইসক্রিমকে ঘিরে।
চার্লস তার রাজবাবুর্চিকে বছরে ৫০০ পাউন্ড করে দিতেন শুধু এজন্য যে সে যেন এর রেসিপি কারও কাছে প্রকাশ না করে। কিন্তু হুট করে একদিন তার কানে এলো- ইংরেজ অভিজাতদের খাবার টেবিলে তার পছন্দের আইসক্রিমই শোভা পাচ্ছে!
এটা শুনে রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেললেন রাজা। সাথে সাথেই তিনি রাজবাবুর্চির শিরশ্ছেদের ব্যবস্থা করেন। বেচারার অপরাধ ছিল কেবল এটাই যে সে রাজার প্রিয় আইসক্রিম তৈরির রেসিপি জনগণের কাছে প্রকাশ করে ফেলেছিল।
তুর্কিরা দাবি করে- পৃথিবীতে সবার আগে আইসক্রিম তৈরি করেছিল তারাই। আনাতোলিয়ান অঞ্চলের শীতল প্রকৃতির সুযোগ নিয়ে তারা এই আইসক্রিম বানিয়েছে। তারপর বালু, তুলা আর পশমী কাপড়ে মুড়িয়ে আইসক্রিমের পাত্রকে দীর্ঘক্ষণ শীতল রাখার প্রযুক্তিও নাকি তাদের। তবে এর পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দেখানো হয়ে থাকে।
প্রচলিত বিভিন্ন বইপত্র এবং ইউরোপীয় নথিতে আইসক্রিমের আবিষ্কারের সময় হিসেবে ১৭ শতকের কথা বলা হলেও তা মূলত হাজার বছরের পুরাতন। ইউরোপের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর ইতিহাস হিসেবে যা কিছু লেখা হয়েছে তা মূলত ইউরোপেরই গুণগান। আর আইসক্রিমের ইতিহাস হিসেবে বেশিরভাগ রেফারেন্স যা বলছে, তা মূলত ইউরোপীয়দের আইসক্রিম আবিষ্কারের গল্প।
প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র থেকে বিশ্লেষণ করলে- খ্রিস্টপূর্ব ২,০০০ অব্দে প্রথমবারের মতো আইসক্রিম তৈরির ধারণা পাওয়া গিয়েছে। চীনের আইসক্রিম তৈরির গল্প ইউরোপের প্রচার হওয়ার পরেও তারা তা মেনে নেয়নি। উল্টো ইউরোপের ইতিহাস গবেষকরা নতুন করে গল্প ফেঁদেছে।
চীন প্রথম আইসক্রিম তৈরির দাবি জানাতেই ইউরোপে আরও দুটি গল্প জনপ্রিয় হয়। তারা দাবি করে- গ্রিক সমরনেতা আলেকজান্ডার তুষার ও বরফ মেশানো মধু খেতে পছন্দ করতেন। তারা একেই আইসক্রিমের আদিরূপ বলে প্রচার করে। পাশাপাশি দাবি তোলে বাইবেলের রেফারেন্স থেকে।
ইউরোপের অনেক ইতিহাস গবেষক বাইবেলকে উদ্ধৃতকরণের মাধ্যমে দাবি করে যে- রাজা সলোমন কৃষিকাজের সময় বরফ মেশানো পানীয় খুব পছন্দ করতেন। অন্যদিকে নিরো ক্লদিয়াস সিজার বিভিন্ন ফলের রস ও টুকরা মেশানো খাবার খেয়েছেন বলেও আরেক দল ইতিহাস গবেষক দাবি করেছেন। তবে তার এই সময় হচ্ছে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যভাগ।
নিকট প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ শেষে মার্কো পোলো ইতালিতে ফিরে আসেন। তিনি সবাইকে গল্প শোনান শরবতের। তার বর্ণনায় পাওয়া এই শরবত এবং আইসক্রিম মোটেও এক জিনিস নয়, তবে তা খাবার হিসেবে পরস্পর সম্পর্কিত। অন্তত এই শরবত এবং আইসক্রিম দুটোই ডেজার্ট হিসেবে বহুল ব্যবহৃত।
ইতিহাসবিদদের ধারণা- বিচিত্র সব শরবত ধীরে ধীরে ১৬ শতকের দিকে আইসক্রিমে রূপ নেয়। ইংরেজরা এই সময়েই আইক্রিমের একটি সংস্করণে অভ্যস্ত হয়। তারা এর নাম দিয়েছিল ‘ক্রিম আইস’। এই রেসিপি এক পর্যায়ে ১৭ শতকের ইংরেজ শাসক প্রথম চার্লসের খাবার টেবিলে নিয়মিত আইটেম হয়ে দেখা দেয়।
এর আঙ্গিকে আমরা বলতে পারি- ইতালীয় এবং ইংরেজরা আইসক্রিম খাওয়া শুরু করে আনুমানিক ১৭ শতক নাগাদ। তাদের আইসক্রিম খাওয়া দেখে ফরাসিরাও থেমে থাকবে কেন? তারা শুরু করে দেয় একটু অন্যভাবে।
আবার দাবি করা হয়- ইতালির ক্যাথরিন দ্য মেদিচির মাধ্যমে ফরাসিরা আইসক্রিম খাওয়ার সুযোগ পায়। ১৫৫৩ সালে ফ্রান্সের দ্বিতীয় হেনরির স্ত্রী হওয়ার পর ক্যাথরিন ফ্রান্সে আইসক্রিমের প্রচলন ঘটান।
শুরুতে রাজা-রাজড়াদের টেবিলে শোভা পেলেও সাধারণ মানুষের খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিতে আইসক্রিমকে অপেক্ষা করতে হয় অনেক বছর। নানা অপেক্ষা আর উপেক্ষার পর অবশেষে আনুমানিক ১৬৬০ সালে আমজনতা আইসক্রিমের স্বাদ নিতে পেরেছিল।
সিসিলি দ্বীপ থেকে আগত এক ব্যক্তি ফ্রান্সে ক্যাফে প্রতিষ্ঠা করে। তার ক্যাফেতে খাওয়ার পর পরিবেশিত বিশেষ ডেজার্টে মেশানো হয়েছিল দুধ, বরফ ও চিনি। পরবর্তীকালে তার ক্যাফেতে দুধ, পনির, দুধের সর, ফলের রস ও চিনি মিশিয়ে সেটা বরফের মতো জমিয়ে বিক্রি শুরু হয়।
অল্পদিনের মাথায় অনেক জনপ্রিয় হয় ফ্রান্সের এই আইসক্রিম রেসিপি। ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক ইংরেজদের হাত ধরে আইসক্রিম আসার দাবি জানানো হলেও সম্রাট শাহজাহানের রেসিপিতে আইসক্রিম ও শরবত ছিল বলে জানা গিয়েছে।
ইতিহাসের পাশাপাশি এবার জেনে নেওয়া যাক কিছু আকর্ষণীয় তথ্য..
- খুনে রোমান সম্রাট নিরো আইসক্রিমের অনেক বড় ভক্ত ছিলেন। রোমের আশেপাশের বিভিন্ন পাহাড় থেকে তরতাজা আইসক্রিম নিয়ে আসার জন্য সে রানার বাহিনী তৈরি করেছিল। এরা পাহাড়ী অঞ্চলের ঠাণ্ডা প্রকৃতির সহায়তা নিয়ে তৈরি আইসক্রিম রোমের বিভিন্ন শহরে বয়ে নিয়ে যেত।
- ইউরোপের মানুষের কাছে ১৩ শতকের দিকে আইসক্রিমের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে খাওয়ার ধারণা নিয়ে আসেন মার্কো পোলো।
- ১৫৬৫ সালে ইতালীয় আর্কিটেক্ট বার্নার্দো বোন্তালেন্তি এমন এক ধরনের রেফ্রিজারেশন টেকনিকের উদ্ভাবন করেন যার ফলে ইতালির রাজপরিবারের সদস্যরা সহজেই ঠাণ্ডা পানীয় ও আইসক্রিমের মতো খাবার খেতে পারত।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১ম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। জর্জ ওয়াশিংটনও আইসক্রিম খেতে বেশ ভালবাসতেন। ১৭৯০ সালে তো তিনি এই খাবারের পেছনে আনুমানিক ২০০ ডলার খরচ করেছিলেন, বর্তমানের হিসেবে এটা প্রায় ৫০০০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের হিসেবে যা প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা।
- রোমানরা একসময় ক্রীতদাসদের পাঠাত বরফ সংগ্রহ করতে। তাদের আনা সেই বরফের সাথে বিভিন্ন ফলের জুস মিশিয়ে একপ্রকার ঠাণ্ডা খাবার বা পানীয় তৈরি করত তারা।
- প্রতি বছরের জুলাই মাসকে জাতীয় আইসক্রিম মাস হিসেবে উদযাপন করে আমেরিকার জনগণ। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ১৯৮৪ সালে এটি চালু করেন।
- একটা কোণ আইসক্রিম যেকোনো মানুষ পঞ্চাশবার চাটলে শেষ হয়ে যায়।
- বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আইসক্রিম খোর হচ্ছে মার্কিনীরা। তারা বছরে প্রায় ১৬০ কোটি গ্যালন আইসক্রিম উৎপাদন করে।
- আমেরিকার প্রায় নব্বই শতাংশ ঘরেই আইসক্রিম খাওয়া হয়।
- প্রথম কোণ আইসক্রিম তৈরি হয় ১৯০৪ সালে।
- গরমকাল আসলেই হরেক রকম স্বাদের আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত হয়ে যাই আমরা। তবে স্বাদের বৈচিত্র্যে জাপানকে ছাড়ানো যাবে না কিছুতেই। সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে খ্যাত এই দেশে অক্টোপাস, গরুর জিহ্বা, এমনকি চিংড়ির ফ্লেভারের আইসক্রিম পর্যন্ত আছে!