নরবলির ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
লাতিন আমেরিকার মায়া, ইনকা, অ্যাজটেক থেকে শুরু করে আফ্রিকার নানা দেশ, ফিজি, হাওয়াই, ডাহোমে আর মিসর, কিংবা আমাদের ভারতবর্ষ আর চীন- বাদ পড়েনি কেউই। ওদিকে হাওয়াই থেকে শুরু করে হিব্রু সভ্যতা আর ইট্রুস্কান অঞ্চলের নানা স্থানে প্রচলিত ছিল ভয়াবহ ‘নরবলি’ প্রথা। আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, বাংলাদেশের রাজশাহীতেও শাহ মখদুম (রহ.) এর দরগাহ সংলগ্ন স্থানে নরবলি দেওয়া হতো বলে অনেকে দাবি করেন।
অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমাতিথি সামনে রেখে ঘটা করে আয়োজন করা হতো এসব নরবলির। মনে করা হয়, বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে তাদের দেবতাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে এই কাজ করা হতো, কিংবা ঐশ্বরিক অনুগ্রহপ্রাপ্তির আশায় কেউ কেউ এই কাজ করতো। অনেক ক্ষেত্রে রাগী দেবতাকে শান্ত করার লক্ষ্যেও সরাসরি মানুষ হত্যা করেছে তারা।
প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ, ফসলহানি, ব্যাধি আর মহামারীর সঙ্গে নরবলির সম্পর্ক রয়েছে। মনে করা হয়, আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে আদি ইউরোপের কৃষিভিত্তিক সমাজে নরবলির ব্যাপক প্রচলন ঘটে। তবে অপরাধের শাস্তি হিসেবে যে হত্যাকাণ্ড ঘটে সেটাকে নরবলি হিসেবে মনে করার কোনো সুযোগ নেই।
ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০-১১০০ অব্দের দিকে কেনানে তথা দক্ষিণ লেভান্টের মানুষ নরবলিতে অভ্যস্ত ছিল। অন্যদিকে, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-১০০ সালব্যাপী ইট্রুস্কান এলাকার মানুষ এই ভয়াবহ অভ্যাস আয়ত্ব করে।
অনেক ক্ষেত্রে পাশবিক গণ-নরবলি হতেও দেখা গিয়েছে। প্রাচীন মিসরের অনেক সম্রাটের সময় নরবলিতে নির্গত রক্তকে গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র মনে করা হতো। তারা নরবলির রক্ত দিয়ে উপাসনার স্থান পরিষ্কার করার রীতি প্রচলন করে। ফলে একসঙ্গে অনেক মানুষকে তারা নরবলি দিয়েছে এমন তথ্যও পাওয়া যায়। অন্যদিকে মায়া সভ্যতায় শিরশ্ছেদের পর মৃত ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড বের করে ফেলা হতো বলে জানা গিয়েছে।
অ্যাজটেকদের নরবলির ইতিহাস, এর বিস্তারিত আয়োজন ও একে ঘিরে মানুষের উন্মাদনা শুনলে তো আপনার পিলে চমকে যাবে! মধ্য মেক্সিকোতে বিকাশ লাভ করা এই মেসোআমেরিকান কালচারের নরবলি নিয়েই চলুন শুরুতে আলাপ করা যাক। এরপর আমরা যাব বাংলাদেশের রাজশাহীতে নরবলি নিয়ে আলাপে।
নরবলি দিয়ে উপাস্য দেবতাদের সন্তুষ্ট রাখবার ব্যাপারে বেশ সচেষ্ট ছিল অ্যাজটেক সভ্যতার লোকেরা। প্রচুর মানুষকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করত তারা। এজন্য প্রাথমিকভাবে যুদ্ধবন্দীদের ব্যবহার করত। পরে যখন এতেও হচ্ছিল না, তখন পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সাথে চুক্তি করে যুদ্ধের আয়োজন করত তারা। যে পক্ষের সৈন্যরা হেরে যেত, সেই পক্ষের সৈন্যদের দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো!
আপনার কাছে কি মনে হচ্ছে যে এভাবে নরবলি দেয়াকে তারা তাদের উপর অত্যাচার হিসেবে দেখত? মোটেও না! বরং দেবতার উদ্দেশ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারাকে বেশ সম্মানের চোখেই দেখত অ্যাজটেকরা। তাই তো স্বেচ্ছায় পর্যন্ত তারা নরবলির তালিকায় নাম লেখাত। দলে দলে পতিতারা নিজেদের জান বিলিয়ে দিত প্রেমের দেবীর উদ্দেশ্যে।
অ্যাজটেক ক্যালেন্ডারের একটি মাসের নাম টক্সকাট্ল (Tōxcatl)। এই মাসে তারা এমন এক ব্যক্তিকে বলির জন্য মনোনীত করত, যে সুন্দর দেহাবয়ব ও লম্বা চুলের অধিকারী। পরবর্তী ১ বছর ধরে তাকে একেবারে দেবতাদের মতো সম্মান করা হতো। সুন্দর সুন্দর পোশাক ও গয়না পরানো হতো তাকে, খাওয়ানো হতো রাজকীয় সব খাবারদাবার। চারজন নারীকে দেয়া হতো তার সম্ভোগের জন্য। এভাবে পুরো এক বছর চলে যেত। সেই বছরের শেষে তাকে দেবতার উদ্দেশ্যে বিশাল উৎসব করে বলি দেয়া হতো। খুঁজে নেয়া হতো নতুন আরেক ব্যক্তিকে। এভাবে চলতেই থাকত!
এখন চলুন অ্যাজটেকদের নরবলির উৎসব সম্পর্কে বলা যাক। এজন্য একজন ব্যক্তিকে কোনো একটি পিরামিডের উপর তোলা হতো। সেখানে তাকে বেদীর উপর শুইয়ে সামনে দাঁড়াত রঙচঙ মাখা পুরোহিত, তার হাতে থাকতো ভলকানিক গ্লাসের তৈরি ধারাল ছুরি। মুহূর্তের মাঝে সেই ছুরি বেদীর উপর শুয়ে থাকা লোকটির বুক ভেদ করে ঢুকে যেত, পুরোহিত হাত ঢুকিয়ে বের করে আনত তার হৃদপিণ্ড।
সেই হৃদপিণ্ড এরপর এক হাতে উপরে তুলে নিচে সমবেত জনতাকে দেখাত পুরোহিত, আনন্দে চিৎকার করে উঠত সকলে। এবার সেই হৃদপিণ্ড বেদীর উপর রেখে ছুরি দিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলা হতো। প্রাণহীন সেই দেহকে পিরামিডের সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দেয়া হতো। গড়াতে গড়াতে সেটা নিচে থাকা জল্লাদদের পায়ের কাছে এসে থামত। জল্লাদরা সেই দেহ টুকরা টুকরা করে ফেলত। এরপর?
এভাবে অনেকগুলো দেহ থেকে অনেক টুকরা মাংসই জমে যেত। ভুট্টা দিয়ে সেসবের স্যুপ তৈরি করে পুরোহিত, সমাজের অভিজাত ব্যক্তিবর্গ, এবং কখনও কখনও আমজনতাও নরমাংসের স্যুপের স্বাদ আস্বাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়ত!
এতক্ষণ ধরে যাদের বলির কথা বলা হলো, তারা সবাই ছিল প্রাপ্তবয়স্ক। তবে শিশুরাও বাদ যেত না এই কুপ্রথা থেকে। অ্যাজটেকদের ধর্মে ত্লালক (Tlaloc) নামে এক দেবতা ছিল, যাকে তারা বৃষ্টির দেবতা হিসেবে পূজা করত। এই দেবতা সন্তুষ্ট হতো কেবলমাত্র শিশুর রক্ত পেলেই। তাই তো যে বছর বৃষ্টিপাত কম হতো, সেই বছর একের পর এক শিশুবলি দিয়ে ত্লালককে সন্তুষ্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত অ্যাজটেকরা।
অ্যাজটেক সভ্যতা নিয়ে অনেক আলাপই তো হলো, এবার চলুন আমাদের বাংলাদেশে আসা যাক।
বাংলাদেশে রাজশাহীতে যে বিশেষ স্থানটিতে বলি দেওয়া হতো বলে জানা গিয়েছে, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বিশেষ করে, এই স্থানে বলি যে দেওয়া হতো তার উপযুক্ত লিখিত ইতিহাস নেই। পাশাপাশি, এখানে পশু বলি দেওয়া হয়েছিল নাকি সরাসরি নরবলি দেওয়া হতো সেই ইতিহাসও বেশ বিতর্কিত।
প্রচলিত জনপ্রিয় ইতিহাস থেকে ধারণা করা হয়- রাজশাহীর ঐ বিশেষ স্থানে অমাবস্যার রাতে বলির আয়োজন করা হতো। যখন কালীর আরাধনা করতে গিয়ে সমবেত হতেন হাজার হাজার মানুষ। তারা সবাই ঢাকের তালে তালে নাচতে শুরু করতো। ধূপধুনোর আয়োজনে ধোঁয়ায় চারদিক ভরে যেত। ঠিক ঐ সময়েই কোনো ব্যক্তিকে ধরে আনা হতো বলির স্থানে; শিরশ্ছেদ করা হতো তার। তারপর নির্দিষ্ট ছিদ্রপথ ও ড্রেন দিয়ে তার রক্ত চলে যেত পদ্মায়।
কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ আর স্থানীয় অনেকের মুখে গল্প শুনে ইতিহাসের গল্প টিম মূলত আগ্রহী হয় শাহ মখদুমের মাজার সংলগ্ন এই বলির স্থান দেখার জন্য। তবে সরেজমিনে ভ্রমণ করার আগে আমাদের নিজেদেরও ধারণা ছিল না এই স্থানের এ সব কাহিনী সম্পর্কে।আহমেদ. এস. সৈকতসহ ইতিহাসের গল্পের অনুসন্ধানী দলের তানভীর, ইমতিয়াজ, জহরুল এবং আলতাফ সেখানে দিয়ে দেখতে পেয়েছে সুন্দর কারুকাজ করা একটি দরজা। সুবিশাল একটি পুকুর। তার পাশে বেশ বিরাট এক লাল অট্টালিকার দেখা মেলে। এই এলাকার মূল আকর্ষণ এটিই।
মনে করা হয়, শাহ মখদুম (রহ.) কোনো এক কুমিরের পিঠে চড়ে এই এলাকায় এসেছিলেন। পরে সেই কুমির বাস করতো এই পুকুরে। মূলত, এই পুকুর পেরিয়ে গিয়ে সাদা একটা ভবন। ঠিক তার পেছনে লালচে একটা তাঁবুর মতো ঘর। সেখানে শাহ মখদুমের পাশাপাশি তাঁকে বহন করে আনা কথিত সেই কুমিরের মাজারও রয়েছে। লাল সেই ঘরের পাশে ছদকার মোরগ ও ছাগল রাখার একটি ঘরও চোখে পড়ে। এখানে অনেক দর্শনার্থীর ভিড় হলেও কৌতূহলোদ্দীপক সেই বলির স্থান সেখান থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত।
খানিকটা ইট, আর বাকিটুকু লোহার গ্রিল। ইতিহাসের গল্পের অনুসন্ধানী দলের সৈকত আহমেদের নজরে আসে স্থানটি। অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে তারা নিশ্চিত হতে পারেন- এখানেই ‘মানুষ বলিদানের’ গল্প লোকমুখে জনপ্রিয় হয়েছে। জনপ্রিয় ইতিহাসকে সামনে রেখে অনেকে দাবি করছেন- এই জায়গাতেই গৌড়ের রাজারা অমাবস্যা-পূর্ণিমায় জ্যান্ত মানুষ ধরে এনে বলিদান করতেন।
সরেজমিনে দেখে এসে সৈকত আহমেদ, তানভীর এবং কিবরিয়া আমাদের জানিয়েছেন, “জায়গাটি বর্গাকার। সবমিলিয়ে ১০-১২ ফুটের বেশি হবে না। ঠিক মাঝখানে রয়েছে দুটি বেশ ছোট কিন্ত চিত্তাকর্ষক পাথরের স্তম্ভ। স্থানীয়দের দাবি- এই পাথরগুলাই বলিদানের কাতলা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এই দুটি পাথরের মধ্যে হতভাগার মাথা আটকে টেনে ধরে খাঁড়ার এক কোপে তার ধড় থেকে দেহ আলাদা করে ফেলা হতো।”
খুব সম্ভবত বড় একটা পাথর কেটে এই বলির কাতলা তৈরি করা হয়েছে। হঠাৎ করেই মেঝের উপর পাথরখণ্ড পুঁতে তৈরি হয়নি এটি। উপরের থাকযুক্ত দুটি পাথরের ঠিক বামে একটা গর্ত। এই গর্ত দিয়ে নাকি রক্ত বয়ে যেত। তবে এর পাশে ঠিক ঐ পাথরের মধ্যেই রয়েছে গোলাকৃতির গামলার মতো অংশ। এই অংশ কোন কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল সেই ব্যাপারে তেমন কিছুই জানা যায় না। স্থানীয়রা দাবি করেন, এই গামলার মতো অংশেই নাকি বলির পর কাটা মাথা রাখা হতো।
মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ইতিহাসের বাইরে এখানে লেখাও পাওয়া যায় নরবলি নিয়ে। দাবি করা হয়, জনৈক তান্ত্রিক দেবরাজ এই নরবলি দিতেন। পরবর্তীকালে সুফি সাধক শাহ মখদুম (রহ.) এ অঞ্চলের রাজাদের উৎখাত করেন। গৌড়ের ইতিহাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয় নরবলির বীভৎসতা।
মনে করা হয়, তখনকার রাজশাহীর নাম ছিল মহাকালগড়। তবে বর্তমানে সেই নাম হারিয়ে যেতে বসেছে ইতিহাসের পাতা থেকে। পদ্মার তীরে অবস্থিত এই বিশেষ এলাকা নাকি ভাঙনের কবলে পড়ে নদীগর্ভে হারিয়ে গিয়েছে বেশ আগে। ধারণা করা হয়, ১৩ শতকের দিকে সেখানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন জনৈক বিক্রম কেশরী। তিনি ছিলেন একজন অত্যাচারী জমিদার।
বিভিন্ন উপকথার বর্ণনা থেকে ধারণা করা হয় মহাকালগড় ছিল এক সমৃদ্ধ জনবসতি। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বাস করতেন। তবে স্থানীয় জমিদারের অত্যাচার আর শোষণে তাদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা হয়েছিল।
ঐ সময়েই নদীর ধারে ছিল বিশালাকৃতির এক কালী মন্দির। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে ভক্তরা পূজা দিতে আসতেন। তাদের মহাসমাগম সামনে রেখে আয়োজন করা হতো অনেক কিছু। আর সেই সময় নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি জানান দিতে বিক্রম কেশরীর সময়ে দেওয়া হতো নরবলি। অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধবন্দীদের কিংবা বিদ্রোহীদের নিয়ে এসে বলি দেওয়া হতো। কোনো কোনো সময় স্থানীয় দরিদ্র কোনো প্রজার কপালও পুড়তো।
জনশ্রুতি আছে, শাহ মখদুম রহ. আসার পর প্রবল যুদ্ধ হয়। ঘোড়ামারার সেই যুদ্ধে মারা যায় অজস্র মানুষ। তারপর পরাজিত রাজারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তাদের সময়ের সেই ভয়ানক নরবলিও বন্ধ হয় এই যুদ্ধের পর। তবে বলিদানের সেই মঞ্চ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে, কালের সাক্ষী হয়ে ঠিকে আছে এখনও।
অনেকে চমকে উঠতে পারেন এটা ভেবে যে আসলেই কি সম্ভব এই নরবলি! তাদের জানানো যেতে পারে ডয়চে ভেলেতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে নিয়েই। ‘ভারতে আজও নরবলি দেয়া হচ্ছে’ শীর্ষক এই সংবাদে বলা হয়েছে, “ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নরবলি বা শিশুবলির মতো কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথা এখনও চলেছে, হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজেই৷ দিন দশেক আগেও কর্নাটকে ১০ বছরের মেয়ে আয়েশাকে বলি দেওয়ার পর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে তার আত্মীয়রা৷”
ডয়েচে ভেলের ঐ সংবাদে তারা আরও উল্লেখ করেছে, “এই নরবলি প্রথা শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই ছিল৷ তবে অতীতে৷ প্রাচীন গ্রিসে দেবতা জিউসের সামনে শিশুবলি দেবার প্রমাণ পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা৷ খরস্রোতা নদীর ওপর বাঁধ ও সেতু নির্মাণের আগে কিংবা ঘরবাড়ি তৈরির আগে অশুভশক্তিকে তুষ্ট করতে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল জাপানে৷ মিশরে ফারাওদের কবরের সঙ্গে বেশ কিছু ক্রীতদাসকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হতো৷ দক্ষিণ এশিয়াতেও বড় বড় রাজা-মহারাজা বা জমিদারেরা বিশেষ কামনা পূরণের জন্য নরবলি দিত৷ নরমুণ্ড মালিনী, জিবে রক্তধারা, হাতে খাঁড়া নিয়ে দেবি কালীর বা দেবি চামুন্ডার বিগ্রহে অথবা বেদীতে নরবলি ছিল মর্যাদার প্রতীক৷ কালক্রমে এ প্রথাই মোষবলিতে বা পাঁঠা বলিতে নেমে আসে৷ হিন্দু পুরাণেও অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো নরমেধ যজ্ঞের উল্লেখ আছে।”
প্রশ্ন উঠতে পারে- রাজশাহীর এই বলিমঞ্চে সত্যিই কি নরবলি দেওয়া হতো? এই প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কারণ তান্ত্রিক ধর্মের প্রচলন থাকতে সেখানে নরবলি অসম্ভব কিছু নয়। গাঠনিক অবস্থা থেকে এই পাথরের মঞ্চ এটুকু নিশ্চিত করেছে যে সেখানে অবশ্যই বলিদান করা হতো। সেখানে পশু বলির পাশাপাশি সরাসরি নরবলি হতো কি না সেটা খতিয়ে দেখার জন্য উচ্চতর গবেষণা হওয়া জরুরি।
এক্ষেত্রে ঐ বলির মঞ্চ ও তার আশেপাশের অংশ থেকে খনন করে মাটির স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা জরুরি। কিংবা ওখানে নরবলির শিকার হতভাগাদের শবদেহ কোথায় দাফন করা হতো কিংবা ফেলে দেওয়া হতো সে ব্যাপারেও অনুসন্ধান করা যেতে পারে। ঠিক তার পর উপযুক্ত তথ্যের আলোকেই বিবৃতি দেওয়া উচিত। এর আগে সরাসরি একে নরবলির মঞ্চ বলা অনেকাংশে বিভ্রান্তি ও ঐতিহাসিক বিকৃতিরও জন্ম দিতে পারে। তবে নরবলির স্থলে একে বলির মঞ্চ হিসেবে চিহ্নিত করলে সেখানে কোনো ভুল নেই।