জার্মানির ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি আর সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণ কিংবা বর্ণবাদী আচরণের কথা উঠলে সবার আগে যাদের নাম ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হয়েছে, তারা জার্মানি। তবে রণাঙ্গণের বাইরে আরও অনেক ক্ষেত্রে তারা স্ব মহিমায় চিরভাস্বর। তাদের নানা অর্জন-বর্জনের দোলাচলে সচল হয়েছে বিশ্ব ইতিহাস ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষ। বিশ্ব ফুটবলেও তারা তারা পরাশক্তি হিসেবে সুপরিচিতি।
ফুটবলের জার্মানি মানে কালোত্তীর্ণ কয়েকজন খেলোয়াড়ের দেশ। তাঁদের মধ্যে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, গার্ড মুলার, লোথার মাথিউস, উই জিলার, ফিলিপ লাম, গান্টার নেটজার, মিরোশ্লাভ ক্লোসা কিংবা হাল আমলের ম্যানুয়েল নয়্যারের নাম না বললেই নয়। তারা মাঠে নামলে পুরো নব্বই মিনিটই দাপট দেখিয়েছে জার্মানি। তাই বাংলাদেশে তাদের ভক্ত, সমর্থক কম নেই।
তবে জামার্নির ইতিহাসের বিবরণ প্রথম পাওয়া যায় রোমান অধিপতি জুলিয়াস সিজারের সময় থেকে। তার দখলের বাইরে থাকা রাইন নদী-পূর্ববর্তী অঞ্চলকে তখন বলা হতো জের্মানিয়া। জুলিয়াস সিজার মধ্য ইউরোপের গল তথা বর্তমান ফ্রান্স পর্যন্ত দখল করতে পারলেও তিনি সুবিধা করতে পারেননি এই জের্মানিয়াতে।
অন্যদিকে ৯ খ্রিষ্টাব্দের তেউতোবুর্গ বনের যুদ্ধে জার্মান গোত্র জয়লাভ করে। তাদের বিজয়ের ফলে এই অঞ্চল রোমান সাম্রাজ্যের বাইরে থাকে। তবে রাইন নদীর পাশে জের্মানিয়া সুপিরিয়র ও জের্মানিয়া ইনফেরিয়র নামে দুটি আলাদা রোমান প্রদেশ গড়ে ওঠে তখন।
পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন এই অঞ্চলের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল নিয়ে আসে। এরপর ফ্রাঙ্করা পশ্চিম জার্মানীর বিভিন্ন গোত্রকে পরাজিত করতে থাকে। ৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রাঙ্ক সামাজ্য আবার বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে।
তখন শার্লেমেনের উত্তরাধিকারীরা নিজেদের মধ্যে বিবাদ শুরু করে। তাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতে পূর্ণ জনপদ তখন পরিচিতি লাভ করে পূর্ব ফ্রাঙ্কিয়া নামে। ৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম অটো মধ্যযুগের জার্মান রাজ্য তথা পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতি নির্বাচিত হন। এর মধ্য দিয়েই মূলত জার্মানির রাজনৈতিক উত্থানের শুরু।
রাজনৈতিক ইতিহাস যত পরেই লেখা শুরু হোক না কেন, জার্মানির সাংস্কৃতিক বিকাশের শুরু সেই প্রাক-ইতিহাসের সময় থেকেই। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে হোমো হাইডেলবার্গেনসিস চোয়ালের হাড় আবিষ্কার জার্মানির ইতিহাসের সূচনাপর্বকে নির্দেশ করে। এর মধ্য দিয়ে জার্মানিতে কমপক্ষে ৬,০০,০০০ বছর আগে থেকেই মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে।
লোয়ার স্যাক্সনির শ্যোনিঙ্গেনের কয়লা খনি থেকে পাওয়া গিয়েছে আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এখান থেকে প্রাপ্ত পাথরের হাতিয়ার পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শিকারাস্ত্র হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে আটটি ৩,৮০,০০০ বছরের পুরনো কাঠের বল্লম পাওয়া গিয়েছে জার্মানি থেকে।
১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর রাইন-ওয়েস্টফেলিয়ার ডুসেলডর্ফের কাছাকাছি নিয়ান্ডার উপত্যকার প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযান পরিচালিত হয়। সেখানে চুনাপাথরের স্তর থেকে বিলুপ্ত মানব প্রজাতির হাড়ের ফসিল উদ্ধার করা হয়, যার বয়স আনুমানিক ৪০,০০০ বছর। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে হারমান শাফহাউসেন জীবাশ্ম-নৃবৈজ্ঞানিক প্রজাতির বৈশিষ্ট প্রকাশ করেন। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রজাতির নামকরণ করা হয় নিয়ানডার্থাল (Homo neanderthalensis)। বিবর্তনে বিশ্বাসী প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা দাবি করে থাকেন, এই নিয়ানডার্থাল থেকেই নাকি আধুনিক মানুষের যাত্রা শুরু।
সাংস্কৃতিক বিকাশের ফলে খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫০-৭৬৮ অব্দেই জার্মানির বিভিন্ন গোত্র বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। অ্যাভেরিল ক্যামেরনের ধারণা, নর্ডিক ব্রোঞ্জ যুগে তথা প্রাক-রোমান লৌহ যুগের শেষাংশে জার্মানির নানা স্থানে বিভিন্ন গোত্রের আবির্ভাব ঘটে।
১ম শতাব্দীতে তারা দক্ষিণ স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও উত্তর জার্মানিতে থাকা নিরাপদ বোধ করেনি। তাই দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে অভিবাসন শুরু করে। এর মাধ্যমে রা গলের কেল্টীয় গোত্র এবং ইরানি, বাল্টিক, ও মধ্য-পূর্ব ইউরোপের স্লাভিক সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সংস্কৃতির সম্পর্ক তৈরি হয়। মূলত এই সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ তাদের জীবনযাত্রাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছিল।
জার্মানিতে শক্তিশালী শাসন বলতে ৭৬৮ সালের দিকে শার্লামেনের কথা বলা যেতে পারে। তিনি পাভিয়া দখলের মধ্য দিয়ে রয়্যাল লম্বার্ডের ২০০ বছরের শাসন শেষ করেন। ৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজেকেই লম্বার্ডদের রাজা হিসেবে দাবি করেন।
তার রাজত্বের ৩০ বছরে ফ্রাঙ্করা ক্ষমতা বৃদ্ধি করে স্লাভ ও পানোনিয়ান অ্যাভারদের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এই সংঘাতে স্লাভদের পাশাপাশি পানোনিয়ান অ্যাভাররাও পরাজিত হয়। অন্যদিকে স্যাক্সন ও ব্যাভেরিয়ানসহ সকল গোত্র ফ্রাঙ্কদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পেরে ওঠেনি। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সুযোগ গ্রহণ করেন পোপ। ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের বড়দিনে পোপ তৃতীয় লিও শার্লামেনকেই পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের নেতা হিসেবে ‘রোমের ইমপেরাতোর রোমানোরুম’ রাজমুকুট পরিয়ে দেন।
ফ্রাঙ্কদের পর ধর্মবিপ্লবের যুগের জার্মানির ইতিহাস বেশ আলোচিত। আধুনিক যুগের শুরুতে ১৫১৭ সালের দিকে পাদরি মার্টিন লুথার ৯৫টি সন্দর্ভ বিশিষ্ট একটি প্যাম্ফলেট প্রকাশ করেন। তিনি একে ভিটেনবার্গ শহরের মোড়ে লাগিয়ে দেন।
এই ধর্ম সংস্কারের চিন্তা কতটা কাজে লেগেছিল বলা কঠিন, তবে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন মার্টিন লুথার। তবে জার্মান সাম্রাজ্যের কাল বলতে বোঝায় ১৮৭১-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ অবধি সময়। চ্যান্সেলর হিসেবে অটো ফন বিসমার্ক নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জার্মান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক গতিপথ তার প্রচেষ্টায় বদলে যায়। ফ্রান্সকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি ইউরোপে জার্মানির প্রভাব দৃঢ় করতে ইউরোপে আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। সমাজতন্ত্র দমনের পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর রোমান ক্যাথলিক গির্জার প্রভাব কমানো ছিল তার কৃতিত্ব।
গির্জার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েও নিজের অবস্থান শক্তিশালী রেখেছিলেন বিসমার্ক। তিনি জনগণের জন্য সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা, ভাতা প্রদানের পরিকল্পনা ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সমাজতন্ত্র-বিরোধী আইন জারির পাশাপাশি সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ১৮৮৮ সালে কাইজার দ্বিতীয় ভিলহেল্ম সম্রাট নির্বাচিত হন। তিনি অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের উপদেশ প্রত্যাখ্যান করে ১৮৯০ সালে বিসমার্কের পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিসমার্কের দক্ষ পররাষ্ট্র নীতি ছুড়ে ফেলে তিনি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো ঔপনিবেশিক নীতি অনুসরণ করেন।
একটা কথা অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, ১৮৭১ সালে অটো ফন বিসমার্কের অধীনে একত্রিত হবার পরই জার্মানির অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটে। তখন সেখানে দ্রুত শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে।
বিশ শতকের শুরুতে জার্মানি ইউরোপে একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা চালায়। তাদের এই আধিপত্যবাদী নীতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করে। ১৯১৮ সালের দিকে এই যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ঘটলে দেশজুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অনেকে নানা প্রচেষ্টা নিলেও সফল হন অ্যাডলফ হিটলার। তার প্রদর্শিত উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয় নাৎসি পার্টির। জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে হিটলারের নাৎসি পার্টি ১৯৩০-এর দশকে জার্মানির ক্ষমতায় আসে। তার সময় জার্মানি আবার পূর্বের মতো ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। ইউরোপের ঔপনিবেশিক পরাশক্তি ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ পশ্চিমের অন্য শক্তি তাদের এই উত্থানকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে ১৯৩৯ সালে বেধে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
ইউরোপ, প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন, মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগর এবং আফ্রিকার পাশাপাশি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় বিস্তার ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয় এবং জার্মানির পরাজয় মূলত দেশটির ইতিহাসের খোলনলচে বদলে দেয়। এর মাধ্যমে তাদের বিখ্যাত থার্ড রাইখ সরকারের বিলোপ ঘটে। অন্যদিকে পতন ঘটে জাপানি ও ইতালীয় সাম্রাজ্যের। এই সুযোগে উত্থান ঘটে জাতিসংঘের। অন্যদিকে, নতুন পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।
১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তি তথা যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পরাজিত হওয়ার পর জার্মানিকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে ফেলা হয়। তখন ব্রিটিশ, ফরাসি, মার্কিন ও সোভিয়েত সেনারা একেকটি অঞ্চলের দায়িত্ব বণ্টন করে নেয়। একপর্যায়ে ১৯৬১ সালে পূর্ব জার্মানির সরকার বার্লিনে একটি প্রাচীর তুলে সীমান্ত আরও শক্তিশালী করে।
দীর্ঘদিনের অচলাবস্থার পর ১৯৮৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর খুলে দেয়া হয় বিখ্যাত ‘ব্রান্ডেনবুর্গ গেইট’। বার্লিন প্রাচীরের সিংহভাগ অপসারণ করা হলেও অল্প কয়েকটি স্থানে প্রাচীরের কিছু অংশ রেখে দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক স্মারক হিসেবে।
যা-ই হোক, জার্মানির ইতিহাস অনেকটা ফুটবল মাঠে তাদের পারফর্মেন্সের মতোই। অর্থাৎ, পুরোটা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার আর দাপট দেখানোর চেষ্টা। এতে কখনও সফল হলেও আকাশচুম্বী সফলতা আর পরাজয়ের অর্থ অনেকাংশে নক্ষত্রের পতনের মতো। আর এভাবেই নানা যুদ্ধ-হাঙ্গামা আর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসকে পূর্ণতা দিয়েছে জার্মানি।