প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
পিরামিড, পিলার আর মন্দিরের গায়ে হায়ারোগ্লিফিকের পবিত্র লিপিতে আঁকা কিছু ছবি, কিছু গল্প, আর অল্প একটু ইতিহাস। মমির সঙ্গে থাকা প্যাপিরাসে লেখা বুক অব ডেথ, গা ছমছমে অনুভূতিতে হঠাৎ শিউরে ওঠার মতো সব কল্পকথা আর গল্পগাথা নিয়ে তৈরি ফারাওদের বিস্ময়কর মমি, রূপকথার সেই নীলনদ আর রানী নেফারতিতির কথকতা। ইতিহাসের এমনি সব হৃদমোহিনী কাহিনীর বেলা শেষে একটা নামই দেওয়া যায়- মিসরীয় সভ্যতা।
রম্য রচনাকার সৈয়দ মুজতবা আলী মিসর সম্পর্কে বলেছিলেন- নীলনদ আর পিরামিডের দেশ। তবে এই দেশে আরও কী কী আছে তার অনেক কিছুই বাদ পড়ে যায় ছোট্ট একটি শিরোনামে। কারণ, প্রাচীন মিসর মানে শুধুই নীলনদ আর পিরামিড নয়, বরং আছে অনেক কিছু।
প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা বিস্তৃতি ছিল দীর্ঘদিনের। ৫,০০০-৫২৫ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ ধরে এগিয়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ এই মানবসভ্যতা।
মানুষের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে নবোপলীয় গ্রাম-সংস্কৃতির বিলোপ ঘটে। তার বদলে জন্ম নেয় উন্নততর জীবনযাত্রার নগর-সভ্যতা। এক্ষেত্রে নীলনদের তীরবর্তী উর্বর ভূখণ্ডে আফ্রিকার মাটিতে সমৃদ্ধ যে সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তাকেই আমরা জানি প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা হিসেবে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০-৫২৫ অব্দ সময়ে মিসরের মানুষ নবোপলীয় সংস্কৃতি থেকে অগ্রগতি অর্জন করে পত্তন ঘটায় নগর-সভ্যতার।
বিশ্বের যেকোনো প্রাচীন সভ্যতার তুলনায় মিসরকে এগিয়ে রাখতে হবে এর বিস্তৃতি এবং বিকাশ দুটি দিক থেকেই। কারণ, মিসরে একদিকে যেমন কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্পকলার বিকাশ ঘটেছিল, তেমনি তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষও নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, পিরামিডের অভ্যন্তরে শবদেহ দাফনের সময় পবিত্র বাণী লিখতে গিয়ে তারা পত্তন ঘটায় হায়ারোগ্লিফিকের। প্যাপিরাস নামক বিশেষ কাগজে অনেকটা ছবি আঁকার আদলে লেখা এই লিপিমালার মাধ্যমেও তাদের প্রতিভা প্রতিফলিত হয়।
কিন্তু… শুধুই কি পিরামিড আর সিংহমানবের প্রতিকৃতি স্ফিংস? এর বাইরে প্রাচীন মিসরে ছিল দেবতা আইসিসের মন্দির, রামেসিয়াম, মালকাটা, লাক্সরকিংবা কার্নাকের মতো মন্দির। ওদিকে পেলুসিয়াম আর ইয়াফা দুর্গের পাশাপাশি বিচিত্র সমাধি তথা মাস্তাবাগুলো অনন্য স্থাপত্যিক নিদর্শন হিসেবে প্রাচীন মিসরের গৌরব বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।
রাজবংশীয় শাসনের আগেই ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে প্রাচীন মিসরে। তারপর প্রাথমিক রাজবংশীয় যুগ অর্থাৎ Early Dynastic Period (c. 3150–2686 BC), প্রাচীন রাজবংশ অর্থাৎ Old Kingdom (2686–2181 BC), প্রথম অন্তর্বর্তীকাল অর্থাৎ First Intermediate Period (2181–2055 BC), মধ্য রাজবংশীয় যুগ অর্থাৎ Middle Kingdom (2134–1690 BC), দ্বিতীয় রাজবংশীয় যুগ অর্থাৎ Second Intermediate Period (1674–1549 BC) এবং হিক্সস (Hyksos) আধিপত্য, নতুন রাজবংশ অর্থাৎ New Kingdom (1549–1069 BC), তৃতীয় অন্তর্বর্তীকাল অর্থাৎ Third Intermediate Period (1069–653 BC), শেষ রাজবংশীয় যুগ অর্থাৎ Late Period (653–332 BC) পার করে সেখানে এসেছিল টলেমি যুগ (332–30 BC) এবং রোমান সাম্রাজ্য (30 BC – AD 641)।
বারংবার ক্ষমতার রদবদল প্রাচীন মিসরের গৌরবকে একটুও ম্লান করতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক পালাবদল মিসরকে নতুন করে সাজিয়েছে। অবশেষে খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫ অব্দের ফারাওশাসিত মিসর পার্সীয়দের অধিকারে চলে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে মিসর পর্যায়ক্রমে রোমান, গ্রিক, আরব ও তুর্কিদের দ্বারা শাসিত হয়।
বিশ শতকের মাঝামাঝি মিশর আপন অধিকারে ফিরে আসার পূর্বপর্যন্ত শেষ বহিঃশক্তি হিসেবে ইংরেজদের আধিপত্য ছিল সেখানে।
দীর্ঘ সময়ের সভ্যতার বিকাশ মিসরকে উন্নত করে নানাদিক থেকে। বিভিন্ন স্তম্ভ কিংবা পিরামিডের গায়ে থাকা লিপিগুলো প্রথমদিকে দুর্বোধ্য থাকায় ইতিহাসের অনেক তথ্য অজানা ছিল। এরপর ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়নের সৈন্যরা তাঁবু খাটাতে গিয়ে খুঁজে পায় রোজেটা পাথর।
পরে নেপোলিয়নের প্রভাবে এ লিপি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন জ্যাঁ ফ্রাঁসোয়া শ্যাম্পোলিয়ঁ। ফ্রান্সের এই বহুভাষাবিদ পণ্ডিত দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের গবেষণায় রোজেটা পাথর থেকে হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হন।
খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে চার হাজার বছর পূর্ব থেকে শুরু হওয়া হায়ারোগ্লিফিক লিপি অবশেষে বোধগম্য হয় রোজেটা পাথরে এসে। এই রোজেটা লিপি লেখা হয়েছে অনেক পরে— খ্রিস্টপূর্ব ১৯৬ অব্দে, যখন পঞ্চম টলেমি ছিলেন মিসরের রাজা। তিনি গ্রিক ভাষা জানতেন বলেই সম্ভবত হায়ারোগ্লিফিক এবং ডেমোটিক লিপির পাশাপাশি গ্রিক ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। মূলত এই সূত্র ধরেই মিসরীয় চিত্রলিপির পাঠোদ্ধার করা গিয়েছিল।
রোজেটা পাথর থেকে হায়ারোগ্লিফিক লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হওয়ায় এক নতুন ইতিহাসের জন্ম হলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলো থেকে প্রাচীন মিসরের অনেক অজানা ইতিহাস জানা যায়। ইংরেজদের হাতে ফরাসিদের পতন ঘটার পর ইংরেজরা রোজেটা পাথর নিয়ে আসে ইংল্যান্ডে। সেই থেকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে রোজেটা পাথর।
নীলনদের উর্বর ভূমিতে সভ্যতার বিকাশ। তাই কথিত ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস এই সভ্যতাকে বলেছেন ‘নীলনদের দান’। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উন্নততর জীবনের দিকে ধাবিত হওয়া মিসরের প্রশাসন ও বাণিজ্যে গতিময়তা আসে নদীকেন্দ্রিক সহজ যাতায়াতের সূত্র ধরে।
তবে প্রাকৃতিক সম্পদ, পশুপাখি ও পরিবেশের দিক থেকে বেশ উন্নত ছিল এই অঞ্চল। তারপর সেখানে বিকাশ ঘটে উপযুক্ত সামাজিক শ্রেণি, আইন ও বিচার বিভাগের। পাশাপাশি, ভাষাগত উৎকর্ষ, শব্দশৈলী ও ব্যাকরণ, লিখনশেলী, সাহিত্য প্রভৃতির ক্ষেত্রেও প্রাচীন মিসরের উন্নয়ন ছিল ঈর্ষণীয়।
উন্নত সংস্কৃতির বিকাশ প্রাচীন মিসরের মানুষকে একটি সমৃদ্ধ যাপিত জীবনের সুযোগ করে দিয়েছিল। তাই খানাপিনা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রা প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ছাপ সুস্পষ্ট। তাদের স্থাপত্য ও শিল্পকলার যে চোখধাঁধানো উন্নয়ন তা আজও বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে দেয়।
বিশেষত, বড় বড় পাথর দিয়ে সুক্ষ্ম মাপ রেখে স্থাপত্য নির্মাণে একমাত্র মিসরীয়রাই সফলতা দেখিয়েছিল। তাই গিজার জায়ান্ট পিরামিড, স্ফিংস, থিবসের মন্দিরগুলো এখনও বিশ্ব স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত।
মালকাটা এবং আমার্না থেকে আবিষ্কৃত রাজপ্রাসাদগুলোর গায়ে অঙ্কিত চিত্রলিপি থেকে তাদের সমৃদ্ধ জীবন সম্পর্কে অনুমান করা গিয়েছে। অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে এগুলো তাদের শিল্পকলার উৎকর্ষের পরিচয়ও বহন করে।
অন্যদিকে, রানী নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তিটি ভাস্কর্যকলার বিস্ময় হিসেবে স্বীকৃত। ১৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রখ্যাত মিসরীয় ভাস্কর থুটমোসের তৈরি এই শিল্প নিদর্শন ১৯১২ সালের দিকে আমার্না থেকে আবিষ্কৃত হয়। নেফারতিতির এই আবক্ষ মূর্তি বর্তমানে জার্মানির নুয়েস জাদুঘরে রাখা আছে।
প্রাচীন মিসরের ধর্মচিন্তায় পরকাল গুরুত্ব পেয়েছিল। অন্যদিকে, পুনর্জন্মের প্রতি বিশ্বাস তৎকালীন মিসরের শাসক তথা ফারাওদের অনেক বেশি আকৃষ্ট করে। তারা তাদের এই বিশ্বাসের বাস্তব নিদর্শন হিসেবে একের পর এক তৈরি করেছে বিভিন্ন পিরামিড। মৃতদেহের সঙ্গে উৎসর্গীকৃত উপকরণ হিসেবে সমাধিতে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী।
তাদের ধর্মবিশ্বাসে পুনর্জন্ম এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে তারা সমাধিতে খাবার থেকে শুরু করে হাতিয়ারও নিয়ে যেত। এমনকি, অনেক ফারাওয়ের মৃত্যুর পর তাদের মমির সঙ্গে স্ত্রী এবং দাসদাসীদেরও একই পিরামিডে দাফন করে দেওয়া হয়েছিল।
মিসরীয়রা তাদের ধর্মবিশ্বাস থেকে পিরামিড তৈরি করতে গিয়ে একাধারে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের অধিকারী হয়। মৃতদেহ মমি করে সমাহিতকরণের উদ্দেশ্যে তারা দক্ষতা অর্জন করে শল্যচিকিৎসায়। পাশাপাশি, ভেষজ ওষুধশিল্পের বিকাশও ঘটেছিল সেখানে।
অন্যদিকে, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে তারা উন্নত জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান অর্জন করে। টিন ও ধাতব গ্লেজযুক্ত মৃৎপাত্র (Faience) এবং কাঁচের উপকরণ তৈরিতেও বেশ দক্ষ ছিল প্রাচীন মিসরের মানুষ। কৃষিপণ্য পরিবহন ও বাণিজ্যের প্রয়োজনে নৌপথে উন্নত যাতায়াতব্যবস্থা গড়ে তোলায় তা মিসরের জন্য সামরিক উৎকর্ষেরও কারণ হয়েছিল।
প্রিয় শ্রোতাদর্শক, আমরা খেয়াল করে দেখতে পাই- স্থাপত্য, শিল্পকলা, চিত্রলিপি, উন্নত নগর ও যাতায়াত থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই উৎকর্ষ অর্জন করেছিল প্রাচীন মিসরের মানুষ। সভ্যতার ইতিহাসের ক্ষেত্রে এর প্রতিটি দিক আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। অন্য কোনো একদিন আবার দেখা হবে সেই অজানা ইতিহাসের গল্প নিয়ে।