অ্যাংলো-জাঞ্জিবার যুদ্ধের ইতিহাস জানতে দেখুন আমাদের ভিডিও
আর্টিকেল পড়ুন
আচ্ছা, ৩৮ মিনিটের মাঝে আপনি কী কী করতে পারেন- সেটা অনুমান করতে পারেন কি? আপনি বইপোকা হলে হিসাব করতে পারেন বইয়ের কতগুলো পৃষ্ঠা শেষ করা যায় সেটা, পেটুক হলে হিসাব করতে পারেন এই সময়ে কত পিস বার্গার শেষ করতে পারেন সেটা, আবার স্বাস্থ্যসচেতন হলে হিসাব করতে পারেন যে এই সময়ে আপনি দৌড়ে কত কিলোমিটার অতিক্রম করতে পারেন, কিংবা দ্রুতগতিতে হেঁটে কতগুলো ফুটস্টেপ দিতে পারেন।
আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগছে যে, হুট করে কেন ৩৮ মিনিট নিয়ে পড়লাম আমি? কারণ আছে! আর এর সাথে যুক্ত মানবজাতির একটি যুদ্ধের ইতিহাসই! আপনি যদি গুগলে ‘Shortest war in History’ অর্থাৎ ‘ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম যুদ্ধ’ লিখে সার্চ করেন, তাহলে উনিশ শতকের একটি যুদ্ধের নাম পাবেন- Anglo-Zanzibar War। এর আরেকটি গালভরা নাম আছে- 38 Minutes War!
জ্বি, ঠিকই শুনছেন। এই যুদ্ধটি মাত্র ৩৮ মিনিট ধরেই চলেছিল। কখনও কখনও অবশ্য এই সময়কে ৩৮ থেকে ৪৫ মিনিট বলা হয়। তবে ‘৩৮ মিনিটের যুদ্ধ’ হিসেবেই এটি বেশি পরিচিত। আর এটাই মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সময় ধরে চলা যুদ্ধ। আজ এই যুদ্ধের কাহিনিই শোনাব আপনাদের।
মানবজাতির ইতিহাসের রেকর্ডেড হিস্ট্রির সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত এই যুদ্ধ নিয়ে জানতে আমাদের চলে যেতে হবে ১৮৯০ সালে। সেই বছর জার্মান সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মাঝে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার নাম ‘হেলিগোল্যান্ড-জাঞ্জিবার চুক্তি’। এটি Anglo-German Agreement of 1890 নামেও পরিচিত।
এই চুক্তিতে দুটো সাম্রাজ্যই পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন এলাকায় একে অপরের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছিল। এমনই এক এলাকা ছিল জাঞ্জিবার। এখানে ব্রিটিশদের আধিপত্য মেনে নিয়েছিল জার্মান সাম্রাজ্য। পূর্ব আফ্রিকা নিয়ন্ত্রণে এই জাঞ্জিবারই হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্য। ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রটি বর্তমানে পূর্ব আফ্রিকার দেশ তাঞ্জানিয়ার একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল।
একটু আগেই যে হেলিগোল্যান্ড-জাঞ্জিবার চুক্তির কথা বলা হলো, সেই অনুসারে জাঞ্জিবারকে নিজেদের একটি আশ্রিত রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। কালক্রমে এর শাসনক্ষমতায় তারা বসায় নিজেদেরই এক পুতুল শাসককে, নাম- হামাদ বিন ছোয়াইনি আল বুসাইদ। ১৮৯৩ সালে ক্ষমতায় এসে প্রায় সাড়ে ৩ বছর শাসন করেন তিনি।
এরপর হুট করেই একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হামাদ বিন ছোয়াইনি। তার মৃত্যু যে ঠিক কীভাবে হয়েছিল, সেই ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হবার উপায় নেই। তবে ইতিহাসবিদদের অধিকাংশেরই ধারণা, ক্ষমতার লোভে কাজিন খালিদ বিন বারগ্বাশই তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন।
তাদের এই বিশ্বাসের পেছনে যুক্তি হলো, হামাদ বিন ছোয়াইনির মৃত্যুর ঘণ্টাখানেকের মাঝেই খালিদকে রাজপ্রাসাদে দেখা যায়। তিনি নিজেকে জাঞ্জিবারের নতুন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। এতে অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোনো অনুমোদন ছিল না।
দিনটি ছিল ১৮৯৬ সালের ২৫ আগস্ট। নিজেদের একটি সাম্রাজ্যে এই ধরনের ঘটনা ব্রিটিশরা মোটেই পছন্দ করল না। জাঞ্জিবারে অবস্থানরত প্রধান ব্রিটিশ কূটনীতিক বাসিল কেভও তাই খালিদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী পাঠালেন, জানালেন সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করে প্রকৃত উত্তরাধিকারীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের।
কিন্তু একজন ঔপনিবেশিকের কথাই বা খালিদ মানবেন কেন? তিনি বরং নিজের দাবিতেই অটল থাকলেন। শুধু তা-ই না, এর পাশাপাশি ব্রিটিশদের মোকাবেলায় প্রাসাদে সেনাসমাবেশও ঘটানো শুরু করলেন।
দেখা গেল, সেদিনই আনুমানিক ৩,০০০ সেনাসদস্য নিজের দলে ভিড়িয়ে নেন খালিদ বিন বারগ্বাশ। সাথে ছিল বেশ কয়েকটি কামান। এমনকি নিকটবর্তী বন্দরে রণসাজে সজ্জিত একটি ইয়াটও রেখেছিলেন তিনি।
এই অবস্থা দেখে ব্রিটিশদের টনক নড়ে উঠল। আগে থেকেই বন্দরে তাদের দুটো যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা ছিল- HMS Philomel এবং HMS Rush। নিজেদের দূতাবাস রক্ষায়, এবং সেই সাথে স্থানীয় জনগণ যেন বিদ্রোহ শুরু করতে না পারে, সেজন্য দ্রুত সেনা মোতায়েন করল তারা। বাসিল কেভের আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশদের সাহায্যের জন্য সেদিন সন্ধ্যায় আরেকটি জাহাজও চলে আসে, নাম HMS Sparrow।
কেভের হাতে অস্ত্রশস্ত্র, সেনাসদস্য সবই ছিল, ছিল না কেবল আক্রমণ শুরু করার সরকারি কোনো অনুমোদন। তাই উপরমহলের কাছে টেলিগ্রাম পাঠান তিনি; যদি খালিদ সিংহাসনের দাবি না ছাড়েন, তাহলে আক্রমণ করার অনুমতি চান। এর পাশাপাশি তিনি নিয়মিতই জাঞ্জিবারের নতুন সুলতানকে হুমকি-ধামকি দিয়ে যেতে থাকেন।
পরদিন কেভের সাহায্যার্থে আরও দুটো যুদ্ধজাহাজ পাঠায় ব্রিটিশ সরকার- HMS Racoon এবং HMS St George। চলে আসেন ঐ এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত রিয়ার অ্যাডমিরাল হ্যারি রসন। সেই সাথে চলে আসে কেভের কাঙ্ক্ষিত টেলিগ্রামের জবাবও। দরকারি যেকোনো পদক্ষেপই নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয় তাকে।
২৬ আগস্ট খালিদের কাছে শেষবারের মতো বার্তা পাঠান বাসিল কেভ, পরদিন সকাল ৯টার ভেতর সিংহাসন ত্যাগ করতে বলেন তিনি। নাহলে যে তার বাহিনী জাঞ্জিবারে হামলা চালাবে, সেটাও উল্লেখ করেন। তাৎক্ষণিকভাবে এর কোনো জবাব দেননি খালিদ।
পরদিন আল্টিমেটাম শেষের ঠিক ১ ঘণ্টা আগে কেভের কাছে বার্তা পাঠান খালিদ। সেখানে সিংহাসন না ছাড়ার কথা আবারও স্পষ্টভাবে তিনি জানিয়ে দেন। কেভের সাথে এটাই ছিল খালিদের সর্বশেষ আলাপ।
সকাল ৯টার দিকে যুদ্ধজাহাজগুলো রাজপ্রাসাদে হামলার অনুমতি লাভ করে। কয়েক মিনিটের মাঝেই খালিদের কামানগুলোর অধিকাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। কাঠ দিয়ে তৈরি প্রাসাদও খুব বেশি সময় এই গোলাবর্ষণের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। অল্প সময়ের ভেতরই প্রাসাদের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়তে শুরু করে। লোকমুখে জানা যায়, এর কাছাকাছি সময়ই পালিয়ে যান খালিদ বিন বারগ্বাশ। পেছনে রেখে যান তার প্রাসাদ, সৈন্যসামন্ত ও চাকরবাকর।
প্রায় ৩৮ মিনিট ধরে একটানা গোলাবর্ষণের পর থামে ব্রিটিশ সৈন্যরা। ততক্ষণে রাজপ্রাসাদের বেশ ভালই ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরা এসে নামিয়ে ফেলে সুলতানের পতাকা। জাঞ্জিবার আবারও চলে যায় ঔপনিবেশিক শাসকদের থাবায়।
এটা অবশ্যই সত্য যে ঘড়ির কাটা ধরে ঠিক ৩৮ মিনিট ধরে এই যুদ্ধ চলেনি। বরং এই সময়কে ৩৮ থেকে ৪৫ মিনিট বলে উল্লেখ করা হয়। কে জানে, হয়তো নিজেদের বীরত্ব জাহিরের জন্যই ব্রিটিশরা কম সময়কেই বেছে নিয়েছে!
সময়ের দিক থেকে যুদ্ধ যত অল্প সময় ধরেই চলুক না কেন, এর ক্ষয়ক্ষতি বেশ ভালোই ছিল। যার মূল কারণ ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজগুলোর গোলাবর্ষণ। এই যুদ্ধে খালিদের অনুগত ৫ শতাধিক সৈন্য হতাহত হয়। ব্রিটিশদের দেয়া তথ্যমতে, তাদের মাত্র ১ জন সৈন্য আহত হয় এই যুদ্ধে, যে কিছুদিন চিকিৎসার পর সেরে উঠেছিল।
খালিদের অবর্তমানে ব্রিটিশরা আবারও তাদের পুতুল আরেক শাসককে ক্ষমতায় বসায়। এবার শাসক হন হামুদ বিন মুহাম্মদ। ১৮৯৬ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত জাঞ্জিবার শাসন করেন তিনি।
খালিদ বিন বারগ্বাশের কী হলো? কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকে নিয়ে তিনি চলে যান স্থানীয় জার্মান দূতাবাসে। ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে নানা চাপ সত্ত্বেও তারা খালিদকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়নি। বরং মাসখানেক পর জার্মান এক জাহাজে করে তাকে পাঠিয়ে দেয় আজকের দিনের তাঞ্জানিয়ায়।
অবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন খালিদ। তাকে নির্বাসনে সেইন্ট হেলেনা দ্বীপে পাঠানো হয়। নির্বাসনের নির্দিষ্ট সময় কাটাবার পর তাকে পূর্ব আফ্রিকায় ফেরত যাবার অনুমতি দেয়া হয়। তিনি ফেরতও আসেন। সেখানেই ১৯২৭ সালে মারা যান খালিদ বিন বারগ্বাশ।