অপারেশন মিডনাইট ক্লাইম্যাক্স নিয়ে জানতে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
আয়নার পেছনে বসে মানুষটা চুপচাপ সামনের দৃশ্য উপভোগ করে চলেছে। রাত গভীর হয়ে এসেছে। ক্ষুধাও পেয়েছে বেশ। তাই একটু পর পর স্ন্যাক্সের প্যাকেটের দিকে হাত যাচ্ছে তার। মাঝে মাঝে একটু ডাউন লাগলে আবার মার্টিনি দিয়ে গলাও ভিজিয়ে নিচ্ছে সে।
আয়নার অপরপাশে থাকা দুই নর-নারী তখন একে অপরের সাথে যৌনমিলনে মেতে উঠেছে। না, তারা স্বামী-স্ত্রী না; বরং তারা অবৈধ সম্পর্কেই লিপ্ত। আর তাদের দৃষ্টির আড়ালে থাকা মানুষটি বেশ রসিয়ে রসিয়েই পুরো দৃশ্যটা উপভোগ করছে, মাঝে মাঝে কী সব যেন হাতের কাছে থাকা নোটবুকেও টুকে রাখছে!
আড়ালে বসে সবকিছু দেখতে থাকা এই লোকটা কে? আয়নার অপরপাশে থাকা মানুষগুলো কি জানে যে তাদের সবকিছু নজরে রাখা হচ্ছে? লোকটা কেন সবকিছু নোট করে রাখছে? আসলে হচ্ছেটা কী এখানে? গোপন কিছু কি?
এতক্ষণ ধরে যা যা বলা হলো তার সবই সত্য। আর এটা ছিল সিআইএ-র বেশ সিক্রেট, বিশাল এক প্রজেক্টের ছোট্ট একটি অংশ। সেই বিশাল প্রজেক্টের আলাপ আজ করব না আমরা, বরং আজ আলাপ হবে রগরগে দৃশ্যের বর্ণনা দেয়া ছোট্ট প্রজেক্টটি নিয়েই, যার নাম ‘অপারেশন মিডনাইট ক্লাইম্যাক্স’।
আমেরিকার ১৭ তম জনবহুল শহর স্যান ফ্রান্সিস্কো অফিসিয়ালি পরিচিত City and County of San Francisco নামে। দেশটির ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সংস্কৃতি, বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই শহরেরই এক এলাকা টেলিগ্রাফ হিল; ভূমি থেকে প্রায় ২৮৫ ফুট উচ্চতায় যার অবস্থান।
এই টেলিগ্রাফ হিলেরই ছয় কামরাবিশিষ্ট সুবিশাল এক বাসায় একসময় আস্তানা গেড়েছিল সিআইএ, গড়ে তুলেছিল নিজেদের সেফ হাউজ। বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। কিন্তু পুরো একটা দশক ধরে মার্কিন এই গোয়েন্দা সংস্থাটি সেখানে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়।
মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত পর্দা দিয়ে ঘেরা সেই বাসায় বসেই উপভোগ করা যেত স্যান ফ্রান্সিস্কো বে-র নয়নাভিরাম দৃশ্য। একসময় সেই বাসায় বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত কিছু রুমের দেয়াল জুড়ে ছিল যৌনোত্তেজক সব চিত্রকর্ম, যাতে কোনো পুরুষ সেই রুমে ঢুকে বিপরীত লিঙ্গের কাছ থেকে কামনার আহ্বান পেলে তা আর প্রত্যাখ্যানের মানসিক শক্তি অর্জন করতে না পারে।
যেসব রুম এই বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো, সেগুলোর দেয়ালে লাগানো থাকত এক বিশেষ ধরনের আয়না, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে Two Way Mirror। এটি Two Way Glass নামেও পরিচিত।
সাধারণত আমরা যেসব আয়নার সাথে পরিচিত, তা কেবল আলো প্রতিফলিতই করতে পারে। ফলে এর সামনে দাঁড়ালে আলোর প্রতিফলনের কারণে আমরা আমাদের দেখতে পাই। ওদিকে, Two Way Mirror এর একদিক আমাদের পরিচিত আয়নার মতো প্রতিফলন ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও, অন্যদিক থাকে একেবারে পরিষ্কার। ফলে একদিকে দাঁড়ানো মানুষের কাছে ওটা আয়না হিসেবে কাজ করলেও অপরপাশে দাঁড়ানো মানুষের কাছে ওটা জানালা, যা দিয়ে অপরপাশের মানুষটি কী করছে তা নজরে রাখা হচ্ছে।
তো… যেটা বলছিলাম, সুবিশাল এই বাড়িতে ১৯৫৩ সালে সিআইএ গড়ে তুলেছিল তাদের গোপন পতিতালয়, যেখানে থেকে পরিচালনা করা হতো তাদের গোপন এক প্রজেক্ট, নাম- মিডনাইট ক্লাইম্যাক্স। এই বাড়িতে দেহব্যবসায় সাথে জড়িত নারীদের ভাড়া করে আনত সিআইএ এজেন্টরা। রেট হতো রাতপ্রতি ১০০ মার্কিন ডলার। সেই সাথে দেয়া হতো পুলিশি হয়রানি থেকে মুক্তির নিশ্চয়তাও।
কিন্তু কেন দেহব্যবসার সাথে জড়িত কিছু নারীকে এতটা সমাদর করত সিআইএ? তারাই আসলে ছিল এই প্রজেক্টের গিনিপগদের মাঝে মূল দুই পক্ষের একপক্ষ। এই নারীদের কাজ হতো তাদের সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়া পুরুষদের মাইন্ড কন্ট্রোল করা, তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য আদায়ের চেষ্টা করা। আর এটা কতটা সফলতার সাথে করা যাচ্ছে, সেটাই খেয়ালে রাখতে হতো সিআইএ-র এজেন্টদের।
কিন্তু পুরুষরাই বা কেন সেসব তথ্য দেবে? এখানেও কলকাঠি নাড়ত সিআইএ। ফ্রি সেক্স আর ড্রাগের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে এই সেফ হাউজে আনার কাজ করত সিআইএ-র এজেন্টরাই। এখানে আসার পর পরই তাদেরকে একধরনের পানীয় দেয়া হতো, যার মাঝে আগে থেকেই স্বল্প পরিমাণ সাইকেডেলিক ড্রাগ Lysergic acid diethylamide অর্থাৎ LSD মেশানো থাকত।
সবসময় যে এলএসডি ব্যবহার করা হতো তা না। পরীক্ষার জন্য মাঝে মাঝে অন্যান্য ড্রাগও ব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ফ্রি ড্রাগ আর সেক্সের লোভে আসা সেই মানুষটির স্বাভাবিক বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা সাময়িকভাবে লোপ পেত। অস্বাভাবিক ঐ অবস্থায় নিজের মনের উপর সেভাবে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়েই সুকৌশলে তথ্য আদায় করা যেত।
এটাই ছিল সিআইএ-র সেই সিক্রেট প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য- পতিতাদের কাজে লাগিয়ে কারও উপর এলএসডি প্রয়োগ করে কতটা সফলতার সাথে তার কাছ থেকে তথ্য আদায় করা যায়। বলে রাখা ভাল, যে পুরুষদের এই এলএসডি দেয়া হতো, তাদের কেউই কিন্তু জানত না এর ব্যাপারে। তারা কেবল জানত যে তাদের উত্তেজক পানীয় দেয়া হচ্ছে খেতে, স্রেফ এটুকুই।
ওদিকে একটু আগেই যে Two Way Mirror এর কথা বলা হয়েছিল, তার অপরপাশে বসে বসে সব দেখত এই প্রজেক্টে নিয়োজিত সিআইএ-র একজন এজেন্ট। দরকারি বিভিন্ন তথ্য নোট করে রাখাই ছিল তার কাজ।
এভাবে মানুষের মাইন্ড কন্ট্রোল নিয়ে নিজেদের গোপন এই পতিতালয় সিআইএ চালু রেখেছিল প্রায় ১০ বছর। তবে শুধু এই একটাই না; স্যান ফ্রান্সিস্কোতেই আরও দুটো, এবং নিউ ইয়র্ক সিটির গ্রিনউইচ ভিলেজে একটি পতিতালয় গড়ে তুলেছিল সিআইএ। সবগুলোর উদ্দেশ্য ছিল একই- যৌনমিলনের সময় এলএসডি দিয়ে মাইন্ড কন্ট্রোলের পরীক্ষানিরীক্ষা।
সিআইএ-র দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন যে এসব বেশ উপভোগ করত তা তো না বললেও চলে। এই যেমন বলা যায় আর্মি ক্যাপ্টেন, ওএসএস অফিসার, ফেডারেল ব্যুরো অব নার্কোটিক্সের অভিজ্ঞ এজেন্ট, এবং অবশ্যই সিআইএ-রও এজেন্ট জর্জ হান্টার হোয়াইটের কথাই। মিডনাইট ক্লাইম্যাক্স নামের এই প্রজেক্ট সামলাতেন তিনিই।
দিনের বেলায় সকলের চোখের সামনে তিনি কাজ করতেন মাদকদ্রব্যের বিস্তার কীভাবে রোধ করা যায় সেই বিষয়ে। ওদিকে, যখনই রাতের আঁধার নেমে আসত, তখনই পুরো ১৮০ ডিগ্রি উল্টে গিয়ে তিনি ড্রাগের মাধ্যমে কীভাবে মানুষের কাছ থেকে গোপন তথ্য আদায় করা যায়- সেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।
আয়নার পেছনে বসে সেসব দৃশ্য হোয়াইট এতটাই উপভোগ করতেন যে একটা মুহূর্তও যাতে মিস না হয়, সেজন্য নিজের রুমে তিনি ছোট্ট একটা ফ্রিজ আর পোর্টেবল টয়লেটের ব্যবস্থা পর্যন্ত করে নিয়েছিলেন!
অপারেশন মিডনাইট ক্লাইম্যাক্সের মতো গোপন প্রজেক্ট কীভাবে কাজ করত তা নাহয় জানা গেল, এবার চলুন জানা যাক তাদের প্রায় ১ দশকের কাজকর্মের ফলাফল সম্পর্কেই।
হাজার হাজার আমেরিকানের উপর তাদের অজ্ঞাতসারে, এবং তাদের অনুমতি ছাড়াই সাইকেডেলিক ড্রাগ এলএসডি প্রয়োগ শেষে সিআইএ সিদ্ধান্তে পৌঁছায়- যখন একজন টার্গেটের উপর ড্রাগ এবং সেক্স একইসাথে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তখন তুলনামূলক দ্রুতই নিজের বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করছে। তবে যে মানুষগুলোর অনুমতি ছাড়া তাদের উপর ড্রাগ প্রয়োগ করা হলো, শেষপর্যন্ত তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা আর জানা যায়নি।
অবশেষে দৃশ্যপটে হাজির হন সিআইএ-র ইন্সপেক্টর জেনারেল জন ইয়ারম্যান। তার রিপোর্টের প্রেক্ষিতে সিআইএ তার এই মিডনাইট ক্লাইম্যাক্সের কর্মপরিধি সীমিত করে আনতে বাধ্য হয়। শেষপর্যন্ত ১৯৬৫ সালে স্যান ফ্রান্সিস্কো, আর ১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কের সেফ হাউজ বন্ধ করে দেয় তারা। পুরো প্রজেক্টটা এতটাই গোপনীয় ছিল যে সরকারের অতি উচ্চপর্যায়ের মানুষজনের মাঝেও খুব কম সংখ্যক মানুষই এর ব্যাপারে জানত।