ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনীর বোমারু ইঁদুর সম্পর্কে জানতে দেখুন আমাদের ভিডিও
আর্টিকেল পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিশ্ব যে গোয়েন্দাগিরির কত রকম নতুন নতুন আইডিয়ার সাথে পরিচিত হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেসবের কিছু কিছু যেমন পিলে চমকে দেয়ার মতো, তেমনই কিছু আবার এমনই ছিল যে সেসব যে বাস্তবে কেউ ঘটানোর চিন্তা করতে পারে সেটা মাথায় আনাও ছিল দুঃসাধ্য। অথচ, সত্যি সত্যিই সেসব ঘটেছিল।
চলছে ১৯৪১ সাল; ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর প্রায় ২ বছর পেরিয়ে গেছে। ইউরোপে ভালই তান্ডব চালাচ্ছে নাৎসি বাহিনী। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরের উপর বোমাহামলা চালাচ্ছে জার্মান বিমান বাহিনী। ওদিকে স্বস্তিতে নেই মিত্রবাহিনীর নৌবহরও। তাদেরও রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে জার্মান ইউ-বোটগুলো।
এমন পরিস্থিতিতে ক্রম-অগ্রসরমান জার্মান বাহিনীকে ঠেকাতে ব্রিটেনের দরকার ছিল এমন কোনো অস্ত্র কিংবা যুদ্ধযান নিয়ে আসার, যা কেবল নাৎসি বাহিনীকে স্তব্ধই করে দেবে না, বরং সামনের দিনে কোনো পদক্ষেপ নেবার আগেও দুবার ভাবতে বাধ্য করবে। ঠিক এই সংকটময় মুহূর্তেই ব্রিটিশদের গোপন সংগঠন Special Operations Executive তথা SOE যুগান্তকারী এক আইডিয়া নিয়ে আসে।… কী সেটা? তা বলার আগে সংক্ষেপে চলুন SOE-র পরিচয় দিয়ে নেয়া যাক।
২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪০ সালের ২২ জুলাই গঠিত হয় গোপন এক ব্রিটিশ সংগঠন, নাম Special Operations Executive, সংক্ষেপে SOE। এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন Minister of Economic War হিউ ডাল্টন। প্রায় ৬ বছর সক্রিয় এই সংগঠনের মূল কাজ ছিল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে দখলকৃত ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে সতর্ক নজর রাখা, বিভিন্ন গোয়েন্দা কার্যক্রম ও চোরাগোপ্তা হামলা পরিচালনা।
এই SOE-র পক্ষ থেকেই প্রস্তাবনা আসে, এবার একটা Rat Bomb অর্থাৎ বোমারু ইঁদুর বানানো হবে! কিন্তু কীভাবে?
প্রথমেই তারা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা চালাবার নাম করে শতাধিক ইঁদুর সংগ্রহ করে। এবার সেগুলোকে মেরে ভেতরে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ভরে আবার এমনভাবে সেলাই করে দেয়া হয়, যেন বাইরে থেকে দেখে মনে হয় একটা মরা ইদুরই কেবল পড়ে আছে, এর চেয়ে বেশি কিছু না।
কিন্তু পেটের ভেতর বোম নিয়ে মরা ইঁদুর আবার কী করবে? এখানেই আসলে লুকিয়ে ছিল SOE-র কারসাজি।
তাদের পরিকল্পনা ছিল যে তারা গুপ্তচরদের সহায়তায় জার্মানির বিভিন্ন রেল ইঞ্জিন, কারখানা, পাওয়ার স্টেশন, এবং এই ধরনের অন্যান্য নানা স্থানের খুব কাছাকাছি কোথাও মরা ইঁদুর এখানে-সেখানে ফেলে রাখবে। এই স্থাপনাগুলোতে তো বয়লার রুম থাকে। ফলে পরিষ্কার করতে গিয়ে কেউ যখন সেসব মরা ইঁদুর পাবে, তখন সাত-পাঁচ না ভেবে ইঁদুরের মৃতদেহকে কোনো রকমে বয়লারে ছুড়ে ফেলে মুক্তি পেতে চাইবে। যেন আগুনে পুড়েই শেষ হয়ে যায় ইঁদুরের দেহাবশেষ।
ওদিকে, যে-ই না আগুনে ফেলা হবে, অমনি বিস্ফোরিত হয়ে যাবে মৃত ইঁদুরটির পেটের ভেতরে লুকানো সেই বোমা। এভাবে জার্মানির বিভিন্ন স্থানে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরণ ঘটতে থাকবে। ভেঙে পড়বে তাদের বিভিন্ন অবকাঠামো, সামরিক স্থাপনাগুলোতে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা, বড়সড় ক্ষতির মুখে পড়বে কলকারখানাগুলোও। এভাবে ধীরে ধীরে গোটা জার্মানিতেই বিশৃঙ্খলা ও গণবিদ্রোহের জোয়ারের স্বপ্ন দেখেছিল SOE, স্রেফ এই বোমারু ইঁদুরগুলোর মাধ্যমেই।
যা-ই হোক, এবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পালা। তাই প্রথম ব্যাচের বোমারু ইঁদুরের চালান পৌঁছল জার্মানিতে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে প্রথমবারেই সেগুলো ধরা পড়ে গেল জার্মান বাহিনীর হাতে।
এটুকু শুনে মনে হতে পারে, এত পরিকল্পনা করে SOE-র এত কিছু করা বুঝি তাহলে সম্পূর্ণ বৃথা গেল। হ্যাঁ, শুরুতে এটুকু মনে হওয়া অস্বাভাবিক না। তবে বাস্তবতা হলো, এটা ছিল আসলে এই প্রজেক্টে SOE-র আসন্ন মহাবিজয়ের সূচনামাত্র! জ্বি, আপনি ঠিকই শুনছেন। শুধু SOE যেভাবে চেয়েছিল, বিজয়টা সেভাবে আসেনি, এই যা!
জার্মান সেনারা যখন দেখল যে এভাবে ইঁদুরের পেটে বিস্ফোরক পুরে তাদের দেশে পাঠানো হচ্ছে, সাথে সাথেই তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তারা উল্টো আগ বাড়িয়ে ভেবে বসল, এত দিনে বোধহয় তাহলে আরও অনেক বোমারু ইঁদুরই ঢুকে পড়েছে তাদের দেশে।
এই ভেবে নিজেদের দেশের মিলিটারি স্কুলগুলোতে বেশ গুরুত্ব সহকারে এই ইঁদুর দেখাতে শুরু করল তারা। সেই সাথে দেশের জায়গায় জায়গায় এই ধরনের ইঁদুর কিংবা এর কাছাকাছি অন্য কিছুর খোঁজে শুরু হলো তাদের চিরুনি অভিযান।
SOE হয়তো চেয়েছিল ধ্বংসের মাধ্যমে জার্মানদের ক্ষতিসাধন করতে। কিন্তু প্রথম ব্যাচের ইঁদুরের চালান ধরা পড়ার মাধ্যমে জার্মানরা মানসিকভাবে যেভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, এবং যেভাবে দেশব্যাপী সন্দেহজনক বিস্ফোরকের খোঁজে তল্লাশী চালাচ্ছিল, তাতেই সংস্থাটি তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। নিজেদের মিশন পুরোপুরি সাক্সেসফুল হয়েছে জানিয়ে ঘোষণা দেয়।