খেজুরের হাজার বছরের ইতিহাস জানতে দেখুন আমাদের ভিডিও
আর্টিকেল পড়ুন
রমজান মাসে ইফতারের সময় প্লেটে যে আইটেম না থাকলে ইফতারই অসম্পূর্ণ লাগে, সেটা খেজুর। ভাল মানের খেজুর মুখে দিয়ে চোখ বুজে এর স্বাদ অনুভবের যে কী মজা, তা সত্যিকারের খেজুরপ্রেমীমাত্রই অনুভব করতে পারবেন।
কিন্তু এই খেজুর কীভাবে আপনার প্লেটে এলো? এত মজা করে যে খেজুর গলাধঃকরণ করছেন, তার পেছনের ইতিহাস কি জানা আছে আপনার? এই ভিডিওতে সেই ইতিহাসই জানাব আপনাদের।
খেজুরের ইংরেজি নাম যে Date, সেটা তো সম্ভবত সকলেরই জানা। কিন্তু ফলটির এই নাম কেন হলো বলতে পারেন? Date শব্দটি এসেছে গ্রীক daktylos শব্দটি থেকে, যার অর্থ আঙুল। আসলে খেজুর যখন একটু বড়সড় হয়, তখন সেটা তো দেখতে আঙুলের মতো দেখায়। এটার সাথে সাদৃশ্য রেখেই খেজুর তার ইংরেজি নামটি পেয়েছে।
ওদিকে এই ফলটির বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix dactylifera। এই নামকরণের পেছনেও আছে ইতিহাস। মধ্যপ্রাচ্যের পূর্ব উপকূলীয় এলাকাকে একসময় বলা হতো Phoenicia। ধারণা করা হয়, গ্রীকরা যে একসময় খেজুরকে Phoenix নামে ডাকত, তা এসেছে এই Phoenicia থেকেই। ওদিকে Dactylifera মানে ‘The Finger-bearer’। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে এই ফলটি মধ্যপ্রাচ্যের যে অঞ্চল থেকে এসেছে, এবং এর গঠন কেমন তা-ই ফুটে উঠেছে খেজুরের বৈজ্ঞানিক নামকরণে।
মানুষ যে ঠিক কবে থেকে খেজুরকে ফল হিসেবে খাওয়া শুরু করেছে তার সঠিক সময় বলা দুষ্কর। তবে অনুমান করা হয়, এখন থেকে কমপক্ষে ৮-১০ হাজার বছর আগে থেকে এই চর্চার শুরু।
কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলকেও খেজুর চাষ শুরুর একক কৃতিত্ব দেয়ার উপায় নেই। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম ভারত- এই অঞ্চলগুলোতে হাজার হাজার বছর আগে থেকেই খেজুর চাষের ব্যাপারে জানা যায়। পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত মেহেরগড়ে আনুমানিক ৯,০০০ বছর পূর্বেও খেজুর চাষের প্রমাণ মিলেছে।
প্রাচীন ব্যাবিলন শহরের কথা তো বলাই হলো না! এখানেও অনেক অনেক দিন আগে থেকেই খেজুর চাষের ব্যাপারে জানা যায়। দজলা ও ফোরাতের তীর ধরে চাষ হতো সেসব গাছের। ১৭৫৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৩,৮০০ বছর আগে রচিত ব্যাবিলনিয়ান কোড অব হাম্মুরাবিতেও খেজুর বাগান করা নিয়ে চারটি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
এত জায়গার কথা বলা হলো, অথচ মিশরের কথাই বলা হবে না, তা কীভাবে সম্ভব? না, প্রাচীন এই সমৃদ্ধ জনপদের কথাও বাদ যাবে না। প্রাচীন মিশরের বেশ জনপ্রিয় খাদ্যই ছিল খেজুর। বিশেষত টলেমিক পিরিয়ডে খেজুর চাষ সেখানে বেশ বিস্তার লাভ করেছিল।
প্রাচীন মিশরীয় সৌরদেবতা রা-র কাছে খেজুর গাছ বেশ পবিত্র এক সত্ত্বা বলে মনে করত মিশরীয়রা। একে দেখা হতো জীবনের প্রতীক হিসেবেই।
বিভিন্নভাবেই খেজুর খেত মিশরীয়রা, যার মাঝে আছে একেবারে টাটকা খাওয়া, সংরক্ষণ করে খাওয়া, পিঠা তৈরির সময় এর মাঝে ঢুকিয়ে খাওয়া, কিংবা রুটি তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা। উটসহ অন্যান্য প্রাণীকেও খেজুর খাওয়াত তারা।
বিয়ারের স্বাদ বৃদ্ধিতেও খেজুর ব্যবহার করত মিশরীয়রা। এজন্য তারা খেজুর সিদ্ধ করে সেই পানিকে ভালভাবে গাঁজন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিত। ওয়াইনের স্বাদ বৃদ্ধিতেও একইভাবে এই পানি ব্যবহার করা হতো।
শুধু যে খাবার হিসেবে কিংবা মাতলামির উপকরণের স্বাদ বৃদ্ধিতে খেজুর ব্যবহার করা হয়েছে তা না, ঔষধি হিসেবেও ব্যবহার হয়ে এসেছে এই ফলটি। বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত করে জ্বরের প্রকোপ কমানো এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে খেজুরের ব্যবহারের কথা জানা যায়।
জরথ্রুস্টীয় ধর্মমতের প্রবর্তক জরথ্রুস্ট্রের মৃত্যু ও পুনরুত্থান উদযাপনে এককালে এই ধর্মের অনুসারীরা বিভিন্নভাবেই খেজুর খেত।
সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয়রা মনে করত, তাদের গাছগুলোতে ফুল ধরার ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে খেজুর গাছ। তাই তারা এই গাছকে বেশ পবিত্র মনে করত।
ইহুদীদের কথাই বা বাদ যাবে কেন? তারা খেজুর গাছকে দেখত স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসা আশির্বাদ হিসেবে, ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে। তারা একসময় স্রষ্টার সন্তুষ্টির নিমিত্তে খেজুর দিয়ে একপ্রকার ঘন রসও তৈরি করত।
মধ্যযুগে মাগরেব, আইবেরিয়ান উপদ্বীপ, সিসিলি ও মাল্টায় বসবাসরত মুসলিম অধিবাসীদের খ্রিস্টান ইউরোপীয়রা মুর নামে ডাকত। এই মুরদের হাত ধরেই উত্তর আফ্রিকা থেকে স্পেনে আগমন ঘটে খেজুরের।
১৮ শতকে স্প্যানিশ মিশনারীদের হাত ধরে খেজুর আসে আমেরিকার। তাদের থাকার জায়গার আশেপাশে বিভিন্ন খেজুর গাছ লাগায় তারা, কালক্রমে যা ছড়িয়ে পড়ে গোটা আমেরিকাতেই।
ওদিকে বিগত ৩০০ বছর ধরে দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের আরও অনেক এলাকাই জয় করে নিয়েছে আমাদের সবার পরিচিত ফল খেজুর; হয়ে উঠেছে সকলের আরও প্রিয়, আরও পছন্দের একটি ফল।