মিশরীয় কবর চোরদের বিস্ময়কর ইতিহাস জানতে দেখুন আমাদের ভিডিও
আর্টিকেল পড়ুন
মিশরের কথা আসলেই আমার মাথায় কেবল পিরামিড আর মমির কথা ঘুরপাক খেতে থাকে। সেই সাথে কিছু অমীমাংসিত রহস্য আর প্রাচীন অভিশাপের কথাও মনের জানালায় উঁকি দিয়ে যায়। আপনাদেরও কি একই দশা হয়?
প্রাচীন মিশরে কবরে চুরিচামারি বেশ সাধারণ এক ঘটনাই ছিল। সেসময়ের কোনো সমাধিস্তম্ভ আপনি খুঁজে পেয়েছেন, অথচ সেখানে শত-সহস্র বছর আগে চোরের পা পড়েনি, এমন কবরের সংখ্যা হাতে গোণা।
ঠিক কবে থেকে যে মিশরে কবর লুটেরাদের দৌরাত্ম্য শুরু হলো, তা একেবারে সঠিক করে বলা মুশকিল। তবে অনুমান করা হয়, ৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে, অর্থাৎ প্রায় ৫,২০০ বছর আগে তাদের চুরিচামারি শাসকগোষ্ঠীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রকম পদক্ষেপই নিতে শুরু করে রাজপরিবার আর অভিজাত সম্প্রদায়ের মৃতের পরিবারের লোকজন। যার মাঝে আছে কবরে পাথরের চাই রেখে দেয়া, কাঠের বিম রেখে আসা ইত্যাদি। এর পাশাপাশি পিরামিডের অভ্যন্তরে নানা জায়গায় সতর্কবাণী ও অভিশাপও লিখে রাখা হয়েছিল।
তবে এসব পাত্তা দিতে বয়েই গিয়েছিল চোরদের! তাদের দরকার ছিল চুরি করা সম্পদের বিনিময়ে জীবিকার্জন করা। তাই এসব বাধা আর অভিশাপের মেকি বাণী পেরিয়ে তারা ঠিকই নিজেদের কাজ করে যেত। তাই তো পরবর্তীকালে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ যখন পিরামিডগুলোতে অভিযান চালাতে যেতেন, তখন মৃতদের সাথে দেয়া অধিকাংশ সম্পদের হদিসই তারা পেতেন না, হাওয়া হয়ে যেত কফিনগুলো, এমনকি অনেক সময় মিলত না খোদ মমির দেখাও।
প্রায় সময়ই দেখা যেত, কাউকে কবর দেয়ার সপ্তাহখানেকের ভেতর সেখানে চোরেরা কাজ সেরে চলে গেছে। কখনও আবার চোরেরা এতটাই অ্যাডভান্সড হতো যে সমাধিস্থল যখন বানানো হচ্ছে, তখনই সেখানে হানা দিয়ে আসত তারা! অর্থাৎ মৃতদেহ জায়গামতো রাখবার আগেই চোরের দল কাজ সেরে আসত। এসময় এই চোরেরা যেমন কবর ও মমির ব্যান্ডেজ খুলে তার গা থেকে মূল্যবান নানা দ্রব্য চুরি করে নিয়ে যেত, তেমনই মমির গায়ে আগুনও ধরিয়ে দিত, যেন মৃত ব্যক্তির আত্মা বা তার দেয়া অভিশাপ তাদের কোনো ক্ষতির কারণ না হয়!
এই কবর লুটেরাদের থামানোর জন্য যে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, বিষয়টা তা না। বরং যত কিছুই করা হচ্ছিল না কেন, কোনোভাবেই চোরের দলকে ঠেকানো যাচ্ছিল না।
অবশেষে ফেরাউন ১ম আমেনহোতেপ কার্যকর এক আইডিয়া নিয়ে আসেন। তিনি প্রস্তাব দেন, পিরামিডগুলো এমন দূরবর্তী ও দুর্গম স্থানে বানাতে হবে যাতে সেখানে যাতায়াতে চোরেদের বেশ বেগ পেতে হয়।
এই চিন্তা থেকেই মিশরের রাজপরিবারের সদস্য ও অভিজাত সম্প্রদায়ের সদস্যদের মরুভূমির বুকে কবর দেয়ার আদেশ দেন তিনি। তিনি যে জায়গাগুলো বেছে নিয়েছিলেন, সেসব পরিচিতি পায় Valley of the Kings এবং Valley of the Queens নামে। এর পাশাপাশি এই পিরামিডগুলো যারা বানাবে, সেই নির্মাণশ্রমিকদের জন্যও একটি গ্রাম গড়ে তোলা হয়, নাম দাইর আল-মদিনা।
আমেনহোতেপের পরিকল্পনা ছিল- যেহেতু এই শ্রমিকদের জীবিকা এই পিরামিডগুলোকে ঘিরেই আবর্তিত হবে, তাই তারা এর রক্ষণাবেক্ষণে, এবং এখানে যেন চোরেরা কোনোরকম ঝামেলা করতে না পারে, সেই ব্যাপারে সদা সতর্ক ভূমিকা রাখবে।
ফেরাউনের চিন্তা হয়তো ভালই ছিল, তবে ভাল ছিল না এই শ্রমিকেরা। তারা যেখানে পিরামিডগুলোর অবস্থান জানে, এর ভেতরের নাড়িনক্ষত্র যেখানে তাদের নখদর্পণে, সেখানে বাইরের চোরের আবার কী দরকার! দাইর আল-মদিনার নির্মাণশ্রমিকরাই তাই সেখানকার পিরামিডগুলো লুটের মূল কারিগর হয়ে ওঠে। সহজ বাংলায়- রক্ষক যখন ভক্ষক।
সিনেমায় যেমনটা দেখানো হয় যে পিরামিড থেকে চোরেরা অনেক দামী দামী জিনিস লুট করে নেবার আশায় হাজির হতো, বাস্তবে ঠিক এমনটা ছিল না। বরং কম দামী জিনিস নিয়েও প্রায় সময়ই সন্তুষ্ট থাকত তারা। যেহেতু সেসময় মুদ্রাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না, তাই বিনিময় প্রথাই ছিল একমাত্র ভরসা। চুরি করা জিনিসের সাথে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস বিনিময় করত।
কবর লুটেরাদের এত কিছু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে আবার ভাবতে যাবেন না যে তাদের কোনো শাস্তি হতো না। ধরা পড়লে শাস্তির মুখোমুখি তাদেরও হতে হতো। সেটা পায়ের তলদেশে প্যাদানি, হাত কিংবা নাক কেটে দেয়া থেকে শুরু করে গুরুতর অপরাধের বেলায় মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়া হতো।
তবে যুগে যুগে আইন যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনই আইনের রক্ষকদের ঘুষ দিয়ে এর ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাবার ঘটনাও ঘটেছে। ব্যতিক্রম ছিল না প্রাচীন মিশরও। সেখানকার ধরা পড়া চোররাও প্রায়ই পুলিশকে সন্তুষ্ট করে নিজেদের মুক্ত করে আবার আগের পেশায় ফেরত যেত।
ইন্টারনেটে ঘুরলে আপনি ফেরাউন তুতেনখামুনের সমাধিস্থল থেকে মূল্যবান নানা সামগ্রী পাবার ব্যাপারে জানতে পারবেন। সেখানে কি কবর চোরেরা হানা দেয়নি? অবশ্যই দিয়েছিল। আনুমানিক দুবার। তবে অল্প বয়সেই মারা যাওয়া এই ফেরাউনের লাশের কপাল ভাল ছিল। ষষ্ঠ রামেসিসের জন্য সমাধিস্থল নির্মাণকালে শ্রমিকরা ভুলে তুতেনখামুনের সমাধিস্থলের পুরোটাই মাটিচাপা দিয়ে দেয়। এর ফলেই মূলত তার মমিসহ সেখানে থাকা মূল্যবান নানা সামগ্রী রক্ষা পেয়েছে।
যে মমিগুলো চুরি করে নিয়ে যেত চোরেরা, সেসব পরবর্তীতে নানা রকমের বিচিত্র কাজে ব্যবহার করা হতো। এমনকি, মমি চূর্ণ করে তা খাওয়ার নজির পর্যন্ত আছে!