রোমানরা কেন প্রস্রাব দিয়ে দাঁত মাজত জানতে দেখুন আমাদের ভিডিও
আর্টিকেল পড়ুন
টাইম মেশিনে চড়ে আমরা যদি প্রাচীন রোমের কোনো এক রাস্তায়, কিংবা কোনো বাড়িতেই খুব সকালবেলা গিয়ে হাজির হতাম, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বেশ অদ্ভুত এক দৃশ্য নজরে আসতো।
প্রথমেই দেখতেন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই একটি তরল পদার্থ দিয়ে দাঁত মাজছে। গন্ধ শুঁকতে গেলে যার সাথে প্রস্রাবের শতভাগ মিল পাবেন।
ওদিকে টয়লেট থেকে যে-ই বেরিয়ে আসছে, সে-ই একটা পাত্রে কিছুটা তরল হাতে নিয়ে খুব সাবধানে বেরোচ্ছে, যেন নড়াচড়া লেগে ওটাও পড়ে না যায়! আপনি যদি প্রথমবারের মতো এবারও নিজের আগ্রহ দমিয়ে রাখতে না পারেন, তাহলে গিয়ে গন্ধ শুঁকতে পারেন। ওটা থেকেও শতভাগ প্রস্রাবের মতোই গন্ধ পাবেন।
আসলে ওটা কী? ওটা প্রস্রাবই! জ্বি, ভুল শোনেননি আপনি। প্রাচীনকালে রোমের লোকজন প্রস্রাব দিয়েই দাঁত মাজার কাজ চালাত! শুধু দাঁতের কথাই বা বলছি কেন? এর পাশাপাশি আরও অনেক কাজেই তারা এই প্রস্রাবের দ্বারস্থ হতো। আপনি-আমি যে প্রস্রাবকে টয়লেট ফ্লাশ করে কিংবা বদনা দিয়ে পানি ঢেলে পরিষ্কারভাবে নিয়ে বেরিয়ে আসছি, এককালে সেই প্রস্রাবই সংরক্ষণ করে হরেক রকম কাজে লাগাত রোমান নাগরিকরা।
কিন্তু কেন? আর এতে আসলে কতটা লাভ হতো? আসলেই কি এতে দাঁত কাজ হতো? এটা কতটা বিজ্ঞানসম্মত?
প্রাচীন রোমের নাগরিকদের প্রস্রাব দিয়ে দাঁত মাজার কথা বলার আগে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে যে ‘প্রাচীন রোম’ বলতে আমরা সাধারণত কোন সময়টাকে নির্দেশ করি।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকে রোম নগরীর গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে ৫ম শতকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য অর্থাৎ Western Roman Empire এর পতন পর্যন্ত সময়কে ‘প্রাচীন রোম’ বলা যায়। অর্থাৎ এর মাঝে আছে প্রায় ১,৩০০ বছরের মতো সময়, যে সময়ের মাঝে চলে গেছে Roman Kingdom (753–509 BC), Roman Republic (509–27 BC), Roman Empire (27 BC–476 AD)।
একজন মানুষ প্রতিদিন কী পরিমাণ প্রস্রাব করে সেটা কি বলতে পারবেন? আপনি যদি দিনে ২ লিটারের মতো পানি পান করেন, তাহলে দৈনিক আপনার প্রস্রাবের পরিমাণ হবে ৮০০ থেকে ২০০০ মিলিলিটারের মতো। সেজন্য আপনাকে ৬-৮ বারের মতো টয়লেটে যাওয়া লাগবে।
আমাদের দেহ থেকে নির্গত হলুদাভ এই তরলে যে পানির পরিমাণই সবচেয়ে বেশি, তা তো না বললেও চলে। ৯১-৯৬ ভাগই হলো পানি। এছাড়া এতে দ্রবীভূত জৈব উপাদানসমূহের মাঝে আছে ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, ইউরিক এসিড প্রভৃতি। আর অজৈব আয়নসমূহের মাঝে রয়েছে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড, অ্যামোনিয়াম, ফসফেট প্রভৃতি।
প্রস্রাবের পরিমাণ আর গঠনগত আলাপ একপাশে রেখে এখন আবার প্রাচীন রোমে ফেরা যাক। সেই সময়কার রোমান নাগরিকরা মনে করত- প্রস্রাব, সেটা মানুষ কিংবা প্রাণী যেখান থেকেই আসুক না কেন, তাদের দাঁতকে পরিষ্কারের পাশাপাশি ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। তাই তো এটা দিয়ে তারা যেমন মাউথওয়াশের কাজ চালাত, তেমনই বিভিন্ন চূর্ণের সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দাঁতের মাজন হিসেবেও চালিয়ে দিত!
সেসময় রোমে দাঁত পরিষ্কারের জন্য যে প্রস্রাব ব্যবহার করা হতো, তার মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয়, এবং অবশ্যই দামী ছিল পর্তুগাল থেকে আমদানি করে আনা প্রস্রাব। এটাকে বেশ শক্তিশালী ও কার্যকর প্রস্রাব হিসেবে মনে করত মানুষজন। তাই তো দাঁত যাদের বেশি সাদা করার দরকার হতো, তারা পর্তুগিজ প্রস্রাবকেই বেছে নিত নিজেদের মাউথওয়াশ আর দাঁতের মাজন হিসেবে।
আচ্ছা, রোমানরা একসময় প্রস্রাব দিয়ে যে দাঁত মাজত, তা নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু এতে কি আসলেই কাজ হতো? এর পেছনে কি কোনো বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আছে? চলুন, এখন সেদিকেই যাওয়া যাক।
আমাদের বাসায় যে বিভিন্ন ধরনের ময়লা পরিষ্কারক পদার্থগুলো আছে, সেসবে আপনি একটি উপাদান বেশ ভালোভাবেই দেখতে পাবেন, তা হলো অ্যামোনিয়া। এটি একটি ক্ষারীয় উপাদান। ওদিকে ময়লা, চর্বি জাতীয় পদার্থগুলো হলো হালকা অম্লীয়। এই অম্লীয় উপাদানগুলো যখন ক্ষারের সংস্পর্শে আসে, তখন দুয়ের মধ্যকার প্রশমন বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে যায় ময়লা।
কিছুক্ষণ আগেই বলেছিলাম যে প্রস্রাবে থাকা উপাদানগুলোর মাঝে একটি হলো অ্যামোনিয়া। এখন কি তাহলে বুঝতে পারছেন যে- কেন রোমানরা একসময় দাঁত ও মুখের পরিষ্কারক হিসেবে প্রস্রাবকে বেছে নিয়েছিল?
বলে রাখা ভাল, রোমানদের এই প্রস্রাবপ্রীতি কিন্তু শুধুমাত্র দাঁতের পরিষ্কারের মাঝেই আটকে ছিল না, বরং আরও অনেক ক্ষেত্রেই তারা একে কাজে লাগাত। এত জনপ্রিয়তার জন্য একসময় তো সেখানে প্রস্রাবের উপর করও বসানো হয়েছিল! জ্বি, ঠিকই শুনছেন। রোমের পাবলিক টয়লেটগুলো থেকে প্রাপ্ত প্রস্রাবের উপর কর বসান সম্রাট নিরো ও ভেসপাসিয়ান।
রোমান এম্পায়ারের সময়কার কৃষিব্যবস্থা নিয়ে লেখালেখি করে বেশ জনপ্রিয় হয়ে আছেন রোমান লেখক কলুমেল্লা। তার লেখা থেকেই জানা যায় যে কৃষিকাজেও প্রস্রাব ব্যবহার করত রোমানরা। বিশেষত ডালিম ফল আরও রসালো ও সুস্বাদু করে তুলতে প্রস্রাব ছিল অতুলনীয় এক উপাদান। কীভাবে? প্রস্রাবের উপাদানসমূহের মাঝে আছে নাইট্রেট, ফসফরাস, এবং পটাসিয়াম। এগুলো গাছের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সেজন্যই কৃষিকাজে প্রস্রাবের এত চাহিদা ছিল রোমে।
কাপড়চোপড় পরিষ্কারের বেলাতেও প্রস্রাবের ব্যবহার ছিল। এজন্য তৎকালীন রোমের পাবলিক টয়লেটগুলোতে আলাদা বড় পাত্র রাখা হতো। লোকজন সেখানে ছোট প্রাকৃতিক কাজ সেরে খালাস হতো। আর ওদিকে এই পাত্র ভরে গেলে সেটা পাঠিয়ে দেয়া হতো লন্ড্রিগুলোতে। এরপর প্রস্রাবের সাথে পানি মিশিয়ে সেখানেই সরাসরি কাপড় চুবানো হতো। একজন কর্মী সেই কাপড় ভেজানো বড় পাত্রে নেমে বেশ ভালোভাবে সেগুলোকে পা দিয়ে দলাই-মলাই করতে থাকত। আর এভাবেই কাপড়চোপড় পরিষ্কার করা হতো প্রাচীন রোমে।
চর্মশিল্পেও ব্যবহার করা হতো প্রস্রাব। এখানে অবশ্য শুধু প্রস্রাবই না, এর পাশাপাশি মানুষ ও কুকুরের মলও কাজে লাগানো হতো। প্রাণীর চামড়া সংগ্রহের পর সেগুলোকে দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রস্রাবে চুবিয়ে রাখা হতো যেন চামড়ায় লেগে থাকা লোম সহজেই ছাড়ানো যায়।
পশুচিকিৎসার উদ্দেশ্যেও প্রাচীন রোমে প্রস্রাব ব্যবহার করা হয়েছে। কলুমেল্লার লেখা থেকে জানা যায়- যেসব ভেড়া হজমের সমস্যায় ভুগত, তাদের মানুষের প্রস্রাব পান করানো হতো। কোনো ভেড়া যদি ফুসফুসের রোগে ভুগত, তাহলে তার নাক দিয়ে মানুষের প্রস্রাব দেয়া হতো ওষুধ হিসেবে।
রোমান এম্পায়ারের শুরুর দিককার জনপ্রিয় এক লেখক ও প্রকৃতিবিজ্ঞানী ছিলেন গাইয়াস প্লিনিয়াস সেকান্ডাস, যিনি প্লিনি দ্য এল্ডার নামেই বেশি পরিচিত। তার লেখা বিশ্বকোষ ঘরানার গ্রন্থ Naturalis Historia পরবর্তীকালের বিশ্বকোষগুলোর জন্য চমৎকার এক মডেল হিসেবে কাজ করেছে। মলদ্বারে ঘা, জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যার জন্য তিনি সেখানে সদ্য বিসর্জন করা মূত্র লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন। ওদিকে বাচ্চাদের শরীরে ফুসকুড়ি হলে পুরাতন প্রস্রাব ছাইয়ের সাথে মিশিয়ে সেসব স্থানে লাগানোর পরামর্শ দিতেন তিনি।
হাজার বছর আগের রোম ছেড়ে এখন চলুন মাত্র কয়েকশ বছর আগের ইউরোপের দিকেই নজর দেয়া যাক। প্রস্রাব নিয়ে তারাও যে কতসব অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে গেছে আর জ্ঞানগর্ভ মতামত দিয়ে গেছে, সেসবও আপনাদের জানা দরকার।
ফরাসি চিকিৎসক আম্ব্রোয়াস প্যারে (Ambroise Paré) চোখের পাতায় চুলকানোর সমস্যা হলে রোগীকে পরামর্শ দিতেন তার নিজের প্রস্রাব দিয়েই চোখ ভালভাবে ধুয়ে নিতে। তবে শর্ত ছিল- সেই প্রস্রাব কমপক্ষে এক রাত একজন নাপিতের গামলায় আগে সংরক্ষণ করতে হবে! কিন্তু চোখে চুলকানোর সাথে প্রস্রাব আর নাপিতের গামলার কী সম্পর্ক? উত্তর জানা নেই।
অ্যানাটমি, নিউরোলজি আর সাইকিয়াট্রির দুনিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সপ্তদশ শতকের ইংরেজ চিকিৎসক থমাস উইলিস। তিনি বিখ্যাত রয়্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদেরও একজন। জানা যায়, গলার ভেতরে অতিরিক্ত চুলকানি বা অস্বস্তির ভাব দূর করতে একবার এক তরুণীকে তিনি নিজের প্রস্রাব গরম গরম গিলে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন!
ষোড়শ শতকে ইতালীর চিকিৎসক লিওনার্দো ফিওরাভান্তি একবার দেখলেন, তর্কাতর্কির একপর্যায়ে লেগে যাওয়া মারামারিতে এক লোকের নাক কাটা গেছে। সাথে সাথেই তিনি নাকে কেটে যাওয়া অংশে আগে প্রস্রাব করলেন যেন ওটা জীবাণুমুক্ত হয়। এরপর ওটাকে জায়গামতো বসিয়ে সেলাই করে দিলেন।
ইংরেজ রাজা ৮ম হেনরির চিকিৎসক ছিলেন থমাস ভিকারি। যুদ্ধাহত সৈন্যদের প্রতি তার পরামর্শ ছিল, যেকোনো ধরনের ক্ষতস্থান প্রথমেই প্রস্রাব দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। তাহলে সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এরপর অন্য যা চিকিৎসা দেয়ার সেটা দিতে হবে।
১৬৬৫-৬৬ সালে লন্ডনে দেখা দেয়া প্লেগ থেকে নিস্তার পেতে চিকিৎসক জর্জ থমসনও পরিষ্কারক হিসেবে প্রস্রাব ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন।
আজকাল আমরা রূপচর্চার জন্য প্রাকৃতিক, কৃত্রিম কত কিছুই তো ব্যবহার করি। এই যে প্রস্রাব নিয়ে এত আলোচনা, সেটাও একসময় ব্যবহার করা হয়েছে এই উদ্দেশ্যে। এখন চলুন সেই ইতিহাস জানানো যাক।
রানী প্রথম এলিজাবেথের সময় ইংল্যান্ডের এক চিকিৎসক ছিলেন উইলিয়াম বুলেইন। মুখের ময়লা পরিষ্কারের জন্য তিনি ভিনেগার, দুধ এবং বাচ্চা ছেলের প্রস্রাবের মিশ্রণ মুখে ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন। কিন্তু বাচ্চা ছেলের প্রশ্রাব কেন? কেন কোনো কিশোর, তরুণ, কিংবা মধ্যবয়সী পুরুষের না? এর উত্তর জানা নেই।
১৬৭৫ সালের সময়কার ইংরেজি বই ‘Accomplish’d Lady’s Delight in Preserving, Physic, Beautifying, and Cookery’-তে মুখ পরিষ্কার করা, একে আরও উজ্জ্বল করে তোলার জন্য নারীদের নিজ নিজ প্রস্রাব মুখে ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ভারতের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মোরার্জি রাঞ্চোদ্জি দেশাই, যিনি মোরার্জি দেশাই নামেই বেশি পরিচিত। জানা যায়, তিনি গো-মূত্র পান করতেন তরলটির ঔষধি গুণ আছে এই কথায় বিশ্বাস রেখে।