সিআইএ-র গোয়েন্দা কবুতর নিয়ে জানতে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রতিটি সাম্রাজ্য নিজেদের সুরক্ষার জন্য গোয়েন্দাবাহিনী গড়ে তুলেছিল, যারা নিজ নিজ রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য প্রতিপক্ষ রাজ্যগুলোর বিভিন্ন খবরাখবর সংগ্রহ করত। সেসব খবরাখবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কখনও তারা ধরা পড়ে অবর্ণনীয় নির্যাতনের মুখে পড়েছে, কখনও মারা গিয়েছে, কখনও আবার জীবন বাজি রেখে করা এই কাজের মাধ্যমে তারা জাতীয় বীরের স্তরেও নিজেদের নিয়ে গেছে।
আজকের দিনেও গোয়েন্দারা আছে। তবে এর পাশাপাশি আরও বেশি পরিমাণে যা আছে তা হলো স্পাই টেক, অর্থাৎ গুপ্তচরবৃত্তি চালানোর মতো প্রযুক্তি।
তবে যন্ত্রকে গোয়েন্দাগিরিতে কাজে লাগানোর আগে মানুষ আরেকদিকেও নজর দিয়েছিল। তারা হলো প্রাণীজগত। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক জাতের প্রাণীর ব্যবহারই হয়েছে গত শত-সহস্র বছরে। গোয়েন্দাগিরির কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে বেশ কয়েক জাতের প্রাণী।
গত শতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর দুই সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লকের মাঝে চলা নানাবিধ প্রতিযোগিতা, টানাপোড়েন, Hot talk-কে আমরা এক শব্দে বলি ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ হিসেবে। ইংরেজিতে যা পরিচিত Cold War নামে।
এই স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে দুটো দেশই একে অপরের উপর সুতীক্ষ্মভাবে নজর রাখতে চেয়েছে, যাতে অপরপক্ষ কোনোক্রমেই এগিয়ে যেতে না পারে। এজন্য চালানো হয়েছে গোয়েন্দা কার্যক্রম। এই লক্ষ্যে মানুষ আর যন্ত্র যেমন ব্যবহার করা হয়েছে, তেমনই ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন প্রকার প্রাণী। কিন্তু প্রাণী কেন? কারণ আপনার চোখের সামনে বসে থাকা একটি কুকুর কিংবা আপনার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একটি দাঁড়কাক যদি আপনার উপর নজরদারি করে, তাহলে সেটা আপনি মোটেও ধরতে পারবেন না। কারণ আপনি এদের সন্দেহই করবেন না! ঠিক এই কারণেই বিভিন্ন প্রাণীকে গোয়েন্দা কার্যক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে সেই সময়।
Lockheed U-2, A-12 এর মতো প্লেন এবং করোনার মতো স্যাটেলাইট ব্যবহার করে সিআইএ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন টার্গেটের ছবি তুলতে পারছিল, সেসব ছবিকে বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন রকমের তথ্যও পাচ্ছিল। কিন্তু সমস্যা আসলে বাধে অন্য জায়গাতে। তখনকার দিনের ছবি তোলার প্রযুক্তি এখনের মতো এতটা উন্নত ছিল না। ফলে দূরে থেকে ছবি তোলা হলে সেটা এতটা ভাল হতো না। এরোপ্লেন বেশ উঁচু দিয়ে চলাচল করে, স্যাটেলাইট থাকে আরও উপরে। ফলে এদের সাহায্যে যে ছবিগুলো তোলা হচ্ছিল, তা সিআইএ-কে সেভাবে সন্তুষ্ট করতে পারছিল না। তাদের দরকার ছিল আরও ক্লিয়ার ছবি, টার্গেটের আরও নিখুঁত বিবরণ।
এই সমস্যার সমাধানেই তারা আশ্রয় নেয় প্রাণীজগতের। কারণ একটু আগেই বলেছি যে এদের যদি ঠিকঠাকমতো প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তাহলে এরা এমনভাবে গুপ্তচরবৃত্তি সেরে আসতে পারবে যে কেউই তাদের সন্দেহ করবে না। এই লক্ষেই সত্তরের দশকে সিআইএ হাতে নেয় গোপন এক প্রজেক্ট- নাম টাকানা। গোয়েন্দা কবুতরের মাধ্যমে লক্ষ্যস্থলের আরও নিখুঁত ছবি তোলাই ছিল প্রজেক্ট টাকানার মূল উদ্দেশ্য।
কবুতরের একটি চমৎকার গুণ হলো- এরা বেশ দক্ষতার সাথেই দূরের পথ পাড়ি দিয়ে নিজেদের ঘরে ফেরত আসতে সক্ষম। সিআইএ-র Office of Research & Development তাই এমন একধরনের ক্যামেরা বানাল, যা আকারে বেশ ছোট হলেও ভাল মানের ছবি তুলতে সক্ষম। ওদিকে ওজনে বেশ হালকা হবার ফলে ওটা কবুতরের গায়ে বেঁধে দিতেও কোনো সমস্যা হবে না। বলে রাখা ভাল, এই ক্যামেরাগুলোর ওজন ছিল মাত্র ৩৫ গ্রাম। অবশ্য এগুলোর দাম ছিল বেশ ভালই, প্রায় ২,০০০ ডলার!
গায়ে ক্যামেরা বাঁধা হয়ে গেলে কবুতরকে জায়গামতো ছেড়ে আসার ব্যবস্থা করা হতো। সেখান থেকে যখন সে ঘরের দিকে ফেরত আসতো, তখনই ক্যামেরার অটোমেটিক মেকানিজমের মাধ্যমে ছবি তোলা হতে থাকত।
কবুতরগুলোর সাহায্যে এই ছবিগুলো বড়জোর কয়েকশ ফুট উপর থেকে তোলা হতো। ওদিকে এই ভিডিওর শুরুতে যে প্লেনগুলোর কথা বললাম, সেগুলো ছবি তুলত প্রায় ১০ হাজার ফুট উপর থেকে। স্যাটেলাইট ছিল আরও উপরে। এজন্য দেখা গেল- কবুতরগুলো যেসব ছবি তুলে আনছে, সেসব বেশ পরিষ্কার, বিভিন্ন স্থাপনা বোঝাও যাচ্ছে সহজভাবে।
কবুতর ওড়া শুরুর সাথে সাথেই যেমন ক্যামেরা চালু করা যেত, তেমনই ওড়ার একটু পরও চালু করা যেত। ক্যামেরার ভেতরে থাকা ব্যাটারিচালিত মোটরের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নিয়মিত বিরতিতে ছবি উঠতে থাকত।
এক টেস্টে দেখা গিয়েছে, একটি ফিল্মে থাকা ১৪০টি ছবির মাঝে অর্ধেকের মতো ছবির কোয়ালিটি বেশ চমৎকার। সেসব ছবিতে নিচে থাকা মানুষ, পার্কিং করা গাড়ি ইত্যাদি বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে।
অবশ্য এই প্রজেক্টে জড়িতদের মনে একটি শঙ্কাও দেখা দিয়েছিল। যদি দুর্ঘটনাবশত কবুতরের গায়ে বাঁধা সেই ক্যামেরা কোনো মানুষের হাতে পড়ে যায়, তাহলেই পুরো প্রজেক্ট হুমকির সম্মুখীন হয়ে যাবে। আর এটা হওয়া মোটেও অসম্ভব কিছু ছিল না।
কবুতরগুলোকে কীভাবে টার্গেটের কাছাকাছি ছাড়া হবে, সেটা নিয়েও অনেক রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। বেশ কিছু উপায় নিয়েই চিন্তা করেছিল সিআইএ। প্রথমে কবুতরগুলো মস্কোতে নেয়া হবে জাহাজে করে। এরপর সেখানে থাকা সিআইএ-র সিক্রেট এজেন্টরা জায়গামতো গিয়ে কোটের নিচ থেকে কিংবা গাড়ির নিচে একটি অংশ খুলে সেখান থেকে কবুতর ছেড়ে দেবেন- এমনটাই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
আবার চলন্ত গাড়ি থেকে কবুতরকে ছেড়ে দিলে সে কেমন পারফর্ম করে এটা নিয়েও ভাবা হয়েছিল। এক্ষেত্রে একটি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার বেগে চলাকালে সেখান থেকে কবুতর ছাড়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল।
ঠিক কতগুলো কবুতর এই প্রজেক্টে অংশ নিয়েছিল, কতগুলো মিশনে তারা আকাশের বুকে উড়ে সিআইএ-র পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করেছিল, এবং সেসব মিশন থেকে সিআইএ কি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্থাৎ ছবি পেয়েছিল কিনা- এমন সব প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের জবাব অবশ্য পাওয়ার উপায় নেই। কারণ এই ব্যাপারে সিআইএ মুখ খোলেনি।
১৯৭৬ সালের এক মেমো থেকে এই মিশনের এক টার্গেট সম্পর্কে জানা যায়, যা ছিল লেনিনগ্রাদের এক শিপইয়ার্ড। সেখানেই তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাধুনিক সাবমেরিনগুলো বানানো হতো। বলে রাখা ভাল, সেই সময়ের লেনিনগ্রাদের নামই এখন সেইন্ট পিটার্সবার্গ।
সত্তরের দশকের শেষ নাগাদ প্রজেক্টটি বন্ধই করে দেয়া হয়। কারণ হিসেবে জানা গিয়েছে, সিআইএ-র কর্তাব্যক্তিদের কাছে কবুতরদের দিয়ে ছবি তোলানোর এই প্রজেক্ট একসময় বেশ অবাস্তব ঠেকতে শুরু করে। এর পাশাপাশি বেশ কিছু কবুতর যেমন দামি এই ক্যামেরাগুলোসহ উধাও হয়ে গিয়েছিল, তেমনই এক কবুতর আবার বাজপাখির কবলে পড়ে নিজের প্রাণটা হারায়। এভাবে ক্যামেরাগুলো ভুল হাতে পড়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেহাত হবার আশঙ্কাই এই প্রজেক্টের ইতি টানার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করা হয়।