আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের অমীমাংসিত মৃত্যুরহস্য নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট; ইতিহাসে অল্প যে কজন মানুষ দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে স্বীয় কর্মবলে অমরত্ব অর্জন করেছেন, তাদেরই একজন আলেকজান্ডার। তার মূল নাম অবশ্য Alexander the 3rd of Macedon অর্থাৎ ‘মেসিডনের ৩য় আলেকজান্ডার’।
প্রায় ২৪০০ বছর আগে জন্ম নেয়া আলেকজান্ডার সিংহাসনে বসেছিলেন মাত্র ২০ বছর বয়সে। এরপর তিনি নজর দেন রাজ্য জয়ের দিকে। একের পর এক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন পশ্চিম এশিয়া ও মিশরজুড়ে। ১০ বছর পর দেখা গেল, গ্রিস থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত এলাকা চলে এসেছে তার সাম্রাজ্যের অধীনে, যা কিনা মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ এক সাম্রাজ্য।
আপনি আরও আশ্চর্য হবেন, যখন জানতে পারবেন যে, এতদিন ধরে একের পর এক যুদ্ধ করে গেলেও হারের দাগ কখনও স্পর্শ করেনি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে। ইতিহাসের অল্প কিছু সমরনেতাই আছেন, যাদের লগ বুকে ‘Victory’ ছাড়া অন্য কোনো শব্দের ঠাই নেই। আলেকজান্ডারও তাদের মাঝেই একজন।
অল্প বয়সে তিনি যেমন তার বিজয়াভিযান শুরু করেছিলেন, তেমনই অল্প বয়সেই থেমে যায় তার জীবনঘড়ি। মাত্র ৩২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের। তবে, কিংবদন্তীতুল্য এই মানুষের পুরো জীবনের মতো আলোচনার কমতি নেই তার মৃত্যু নিয়েও। কেন? কারণ তার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি আজও।
বছরের পর বছর ধরে ইতিহাসবিদগণ সেই সময়ের মানুষজনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে নানা তত্ত্ব দিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা সেসব তত্ত্বের সাথে রোগের উপসর্গ মিলিয়ে নানা রোগের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন। এমনকি, উঠে এসেছে ষড়যন্ত্র করে বিষপ্রয়োগে হত্যার সম্ভাবনাও।
সামগ্রিকভাবে তাই আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ইতিহাসের গল্পের এই পর্বে আমরা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের অমীমাংসিত মৃত্যুরহস্যের নানা দিক নিয়েই জানব।
মূল আলাপে যাবার আগে বলে রাখি, নিয়মিত ইতিহাসের নানা সাম্রাজ্য, যুদ্ধবিগ্রহ, অমীমাংসিত রহস্য, বিচিত্র ইতিহাস, গোয়েন্দাগিরিসহ হরেক রকম বিষয়ে জানতে আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখুন। সেই সাথে বেল আইকনে ক্লিক করে অন করে রাখুন নোটিফিকেশনও।… যা-ই হোক, মূল আলাপে ফেরা যাক।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কারণ নিয়ে যদি আপনি বসতে চান, তাহলে একের পর এক কারণ শুনতে শুনতে আপনি নির্ঘাত আকাশ থেকে পড়বেন। অ্যালকোহলিক লিভার ডিজিজ, জ্বর, বিষপ্রয়োগসহ আছে আরও অনেক কিছুই।
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের স্কুল অব মেডিসিনের ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে টাইফয়েডের কথা বলা হয়েছে, যা সেসময়ের ব্যাবিলনে অসুস্থতাজনিত মৃত্যুর কারণগুলোর মাঝে ছিল অন্যতম।
এছাড়া ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্র থেকে তার রোগের যেসব লক্ষণের কথা বলা হয়েছে, যেমন- উচ্চমাত্রার জ্বর, জ্বর কমে গেলে শরীর বেশ ঠাণ্ডা হয়ে আসা, বেশ ঘাম হওয়া, নির্জীব হয়ে পড়ে থাকার মতো লক্ষণগুলো টাইফয়েডের মতো সংক্রামক রোগের সাথে সহজেই মিলে যায়।
দিগ্বিজয়ী এই বীরের মৃত্যুর কারণ হিসেবে এসেছে ম্যালেরিয়ার কথা। এমনকি ষড়যন্ত্র করে বিষপ্রয়োগে হত্যার সম্ভাবনাও দেখেছেন কেউ কেউ। কখনও কখনও এসেছে অসংক্রামক রোগের প্রস্তাবনাও।
ওদিকে, লেখক অ্যান্ড্রু চাগের ভাষ্যমতে, বন্যার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের সময় জলাভূমি অতিক্রম করছিলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। তখনই কোনো একসময় মশাবাহিত সংক্রামক রোগ ম্যালেরিয়া তার দেহে প্রবেশ করে।
আলেকজান্ডারের সেক্রেটারি ইউমেনেস অব কার্ডিয়ার দিনপঞ্জিকার সূত্র ধরে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এর পাশাপাশি গ্রীক ইতিহাসবিদ আরিয়ানের কাছ থেকে প্রাপ্ত আলেকজান্ডারের অসুস্থকালীন শারীরিক অবস্থার বর্ণনা থেকেও তিনি একে ম্যালেরিয়ার সাথে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ বলেই মনে করেন।
এরপর আসে বিষপ্রয়োগ করে হত্যার কথা। এই ব্যাপারে সন্দেহের তালিকা বেশ লম্বা, যাদের ভেতর আছে আলেকজান্ডারের এক স্ত্রী, তার জেনারেলরা, অবৈধ সৎভাই, কিংবা রাজসভার মদ পরিবেশক।
ইংরেজ ইতিহাসবিদ পল চার্লস ডোহার্টির মতে, আলেকজান্ডারকে আর্সেনিক প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করে থাকতে পারে তারই অবৈধ সৎভাই প্রথম টলেমি সোটার।
তবে এই দাবির সাথে একমত নন নিউজিল্যান্ডের ন্যাশনাল পয়জন্স সেন্টারের টক্সিকোলজিস্ট ড. লিও শেপ। তার মতে, আলেকজান্ডারকে White Hellebore নামক একপ্রকার বিষাক্ত গাছের রস প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। তার খাবার পানীয়র সাথে এটা মেশানো হয়েছিল বলেই মনে করেন তিনি।
বলা বাহুল্য, অসুস্থ আলেকজান্ডারকে যারা দেখেছিল, এবং তার শারীরিক অবস্থার যেসব বর্ণনা তারা দিয়েছিল, সেসবের সাথে এই গাছের বিষক্রিয়ারও বেশ মিল আছে। বিশেষত, প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস উল্লেখ করেছেন, বেশ বড় এক পাত্র ওয়াইন পানের পরই আলেকজান্ডার ব্যথায় কাতরাতে থাকেন। এ থেকে ড. শেপের বিষাক্ত গাছের রসের তত্ত্ব বেশ গুরুত্ব সহকারেই দেখা শুরু হয়।
ওদিকে এপিডেমিওলজিস্ট জন মার এবং চার্লস ক্যালিশার দাবি করেন, মশাবাহিত রোগে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়েছিল ঠিকই, তবে সেটা ম্যালেরিয়া না, বরং West Nile Fever। তারাও বিভিন্ন ঐতিহাসিক আলাপ টেনে নিজেদের দাবি সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করেন। তবে, পরবর্তীতে যখন গবেষণার মাধ্যমে জানা গেল যে এই রোগ ৮ম শতকের আগে কোনোভাবেই মানবজাতির মাঝে সংক্রমিত হয়নি, তখন তাদের দাবি আর ভিত্তি পায়নি।
আপনার কি মনে হচ্ছে যে, আলেকজান্ডারের মৃত্যুর ব্যাপারে মাত্র এই ক’টি রোগ বা উপায়ের কথাই উঠে এসেছে? না। আরও আছে:
- Acute pancreatitis
- Acute endocarditis
- Schistosomiasis
- Porphyria
- Guillain-Barré Syndrome
- Leukemia
- Influenza
বিখ্যাত এই সমরনায়কের মৃত্যু নিয়ে গবেষকদের মাঝে মতের অমিল এমন জায়গায় গিয়েছে যে, সামনের দিনে যদি নতুন কোনো রোগের সন্ধান মেলে, এবং পরবর্তীতে কেউ দাবি করে বসে যে হাজার হাজার বছর পূর্বে আসলে ঐ রোগেই আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়েছিল, তাহলেও বোধহয় আর অবাক হবার কিছু থাকবে না!
একজন মানুষ মারা গেলে স্বাভাবিকভাবেই কিছু সময়ের মাঝে তার দেহ ঠাণ্ডা হয়ে আসে, বর্ণ পরিবর্তন হতে শুরু করে, শক্ত হয়ে আসে হাত-পাও। কিন্তু, অদ্ভুত বিষয় হলো, আলেকজান্ডার মারা যাবার ছয় দিন পর্যন্ত তার দেহে এমন কোনো পরিবর্তনই দেখা যায়নি। এ থেকে মেসিডোনিয়ার মানুষজন মনে করতে শুরু করে, আলেকজান্ডার কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানুষের বেশধারী একজন দেবতা!
আপনি জেনে বেশ আশ্চর্য হবেন যে- এমন বেশ কিছু ঘটনার বিবরণ জানা যায়, যেখানে আলেকজান্ডারকে মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগেই সতর্ক করেছিল বিভিন্ন মানুষ। বিভিন্ন দৈববাণীর সূত্র ধরে তারা আলেকজান্ডারকে সাবধান করে দিয়েছিল।
৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে সৈন্যসামন্তসহ ব্যাবিলনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। গ্রীক ইতিহাসবিদ আরিয়ানের বর্ণনা থেকে জানা যায়, টাইগ্রিস নদী পেরোবার পর এই বাহিনীর সাথে চালদিয়ার কয়েকজন অধিবাসীর দেখা হয়।
তারা তাদের সতর্ক করে এই বলে যে, তাদের দেবতা বেল নাকি তাদের জানিয়েছেন, ঐ সময় ব্যাবিলনে গেলে তা আলেকজান্ডারের মৃত্যুর কারণ হবে। এর পাশাপাশি তারা আলেকজান্ডারকে পশ্চিমমুখী হয়ে যেতেও নিরুৎসাহিত করে। কেননা, এর ফলে অস্তায়মান সূর্যের দিকে তার সরাসরি নজর যাবে, যা নাকি তার পতনকে ত্বরান্বিত করবে!
তাদের প্রথম পরামর্শ না শুনলেও দ্বিতীয়টা ঠিকই শুনেছিলেন আলেকজান্ডার। তিনি ব্যাবিলনে যে গেট দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন তাতে তার মুখ পূর্ব দিকে ঘোরানো ছিল।
চালদিয়ার অধিবাসীরা যেখানে আলেকজান্ডারকে সতর্ক করেছিল, সেখান থেকে আরেকধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রাচীন ভারতের তক্ষশীলা থেকে আগত নাগাসন্ন্যাসী কালানোস। আলেকজান্ডারের অনুরোধে তার সাথে ভ্রমণ করলেও বয়সের ভারে ভ্রমণক্লান্তি পেয়ে বসে তাকে। শেষ পর্যন্ত কালানোস জ্বলন্ত চিতায় আত্মাহুতির সিদ্ধান্ত নেন।
আলেকজান্ডার তাকে এই সিদ্ধান্ত থেকে ফেরাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে ৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বর্তমান ইরানে অবস্থিত প্রাচীন সুসা নগরীতে কালানোসের জন্য চিতা প্রস্তুত করা হয়। সেখানেই আগুনের মাধ্যমে জীবনাবসান ঘটে তার। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, আগুনের উত্তাপ নাকি তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি। বরং চুপচাপ বসে ছিলেন তিনি। এই আগুনে বসবার আগে আলেকজান্ডারের উদ্দেশ্যে কালানোসের শেষ বক্তব্য ছিল, “ব্যাবিলনে দেখা হচ্ছে তাহলে!”
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, কালানোস যখন আলেকজান্ডারের উদ্দেশ্যে এই কথাটা বলেছিলেন, তখন পর্যন্ত আলেকজান্ডারের চিন্তাই ছিল না ব্যাবিলনে যাবার। ফলে উপস্থিত যারা এই কথা শুনেছিল, তাদের কেউই এর মর্মার্থ ধরতে পারেনি। কয়েক মাস পর যখন আলেকজান্ডার অসুস্থ হয়ে ব্যাবিলনেই মারা যান, তখনই সবার টনক নড়ে ওঠে, “আরে, কালানোস যে দেখা যায় আমাদের রাজার মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিল!”