ভারতবর্ষে প্লেগের তাণ্ডব নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
ভারতবর্ষে প্লেগ দমন করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার আর ভারতবাসী পুরোপুরি একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সন্দেহভাজন রোগীকে ধরে নিয়ে তার উপর নানারকম নির্যাতনমূলক পরীক্ষণ, মৃতদেহ সৎকারে দাহ করার মতো পদ্ধতির বিরোধিতা, রোগে মারা গেলে ময়নাতদন্তের নামে শবদেহ কাটাছেঁড়া- প্রভৃতি কারণে ব্রিটিশ চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর মানুষের বিতৃষ্ণা জন্মায়।
প্লেগে আক্রান্ত হলে শরীরের বিভিন্ন স্থান, বিশেষ করে বগল, কুঁচকি ও ঘাড়ে গুঁটি উঠতো। পুরুষ ডাক্তাররা যখন অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল হিন্দু কিংবা মুসলিম পরিবারের কোনো নারীর শরীরে হাত লাগিয়ে প্লেগ হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করতে চেয়েছে, সেটা নিয়েও সেই পরিবারগুলো বেশ প্রতিক্রিয়া দেখায়। নিজ পরিবারের নারীদের গায়ে পরপুরুষের হাত দেয়া তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি।
ভারতবর্ষে প্লেগের সংক্রমণ একটু অন্যভাবে ঘটেছিল। এখানে একাধারে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য দুটি বিষয়ের পর্যালোচনা করা যেতে পারে। ভারতের বাণিজ্যপ্রধান এলাকাগুলো বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় অপেক্ষাকৃত উন্নত ছিল। পক্ষান্তরে, বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগও ছিল তুলনামূলক বেশি। ফলে মহামারীর প্রাথমিক ধাক্কা যখন লাগে, এসব এলাকা আক্রান্ত হয় সবার আগে।
তারা বৈজ্ঞানিক নানা সুবিধার মধ্যে থাকলেও মহামারী প্রতিরোধে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি। অন্যদিকে, প্লেগের তৃতীয় মহামারী তথা থার্ড প্যানডেমিকের সময় অপেক্ষাকৃত গ্রামীণ পরিবেশে অনুন্নত জীবনের অধিকারী মানুষ বেশি নিরাপদ ছিল। তারা বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত না হয়ে, বাণিজ্য সুবিধা না পেয়ে সাদামাটা জীবনযাপন করলেও থার্ড প্যান্ডেমিকের মরণতাণ্ডব তাদের স্পর্শ করেনি।
তারা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ কিংবা বাণিজ্যসুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকার মতো মুক্ত থেকেছে মহামারীর ভয়াবহতা থেকেও। ১৮৯৬ সালের মুম্বাই যখন প্লেগের প্রথম ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন ভারতের বেশিরভাগ কৃষিপ্রধান অঞ্চল বেশ নিরাপদ ছিল। তারা কোনো ধরনের সংক্রমণের মুখোমুখি না হওয়ায় এ রোগের চিকিৎসা নিয়েও তাদের ভাবতে হয়নি।
অন্যদিকে, বিশ্বের নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জাহাজগুলোকে মহামারীমুক্ত রাখার জন্য ১৮৯৭ সালে কোম্পানি একটি আইন করেছিল, নাম 1897 Epidemic Diseases Act)। তারা এর আলোকে নানা দেশের সাগরে ভাসমান জাহাজকে পরীক্ষা করা, জনবিচ্ছিন্নকরণ, কিংবা ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করতে পারতো। তারপরও তারা প্লেগের সংক্রমণ প্রতিরোধে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
মহামারী দমনের নামে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি বিশ্বের নানা স্থানে অন্যায় তাণ্ডব চালাতে শুরু করে। তারা রোগ সংক্রমণের মিথ্যা অভিযোগে অনেক সমৃদ্ধ জনপদ ধ্বংস করেছে। তারা বিপ্লবী ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা জনপদের মানুষকে দমন করতে গিয়ে রোগ ছড়ানোর মিথ্যা অভিযোগে তাদের বাড়িঘর কিংবা জাহাজে আগুন পর্যন্ত লাগিয়ে দিয়েছে।
অনেক সময় সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য যে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেগুলোতে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে- এমন অভিযোগ তোলা হয়েছে। তারপর জনপদ থেকে ঐ হাসপাতাল সরিয়ে দেওয়ায় নানারকম জনদুর্ভোগও দেখা দেয়।
এর বাইরে সন্দেহভাজন রোগীকে ধরে নিয়ে তাকে নানারকম নির্যাতনমূলক পরীক্ষণ, মৃতদেহ সৎকারে দাহ করার মতো পদ্ধতির বিরোধিতা, রোগে মারা গেলে ময়নাতদন্তের নামে শবদেহ কাটাছেঁড়া- প্রভৃতি কারণে ব্রিটিশ চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর মানুষের বিতৃষ্ণা জন্মায়। তারা উনিশ শতকে এসে ব্রিটিশদের চিকিৎসা ও ওষুধের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে।
ভারতের বিভিন্ন গ্রামে বসবাসকারী রোগীরা ব্রিটিশ ডাক্তারদের থেকে স্থানীয় কবিরাজ, হাকিম এবং ওঝাদের উপরেই আস্থা রাখেন। তারা অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ব্রিটিশদের চিকিৎসাকে পর্যন্ত বর্জন করে। অন্যদিকে দেখা গিয়েছে, অনেক গ্রাম থেকে আক্রান্ত সন্দেহে ধরে নিয়ে যাওয়া মানুষ হাসপাতালে গিয়ে অন্যদের সংস্পর্শে থেকে প্লেগে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু এরই বিপরীতে গ্রামে থেকে স্থানীয় কবিরাজদের ভেষজ চিকিৎসা ও বিচ্ছিন্নতার কারণে অনেকে সুস্থ হয়ে গিয়েছেন।
ফলে জনমনে ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়- ব্রিটিশরা মেডিকেল পরীক্ষার প্রয়োজনে মানুষকে তুলে নিয়ে হত্যা করছে। তারপর তাদের লাশ কাটাছেঁড়া করে ফেরত দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, পর্দাপ্রথার উপযুক্ত প্রচলন ছিল ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিম পরিবারগুলোতে। সেখানে আক্রান্ত সন্দেহে যেসব নারীকে জোরপূর্বক কোয়ারেন্টিন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের পরিবার বিপন্ন বোধ করতে থাকে। স্থানীয়ভাবে নেতৃস্থানীয় কিংবা জমিদার শ্রেণির পরিবার এই ধরনের কোয়ারেন্টিন ক্যাম্পের ঘোর বিরোধিতা করে। তারা একে ব্রিটিশদের ঘোরতর ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের ডাক দেয়।
প্লেগ প্রতিরোধের চেষ্টা করতে গিয়ে ভারতীয় জনগণ এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে ব্রিটিশরা মনে করতে থাকে- ভারতীয়রা নিয়ম না মানায় দলে দলে আক্রান্ত হচ্ছে, এবং মারা পড়ছে। পাশাপাশি তাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্রিটিশ প্রশাসন। এর বিপরীতে ভারতীয়রা মনে করে, গুজব ছড়িয়ে তাদের জোরপূর্বক তুলে নিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে ব্রিটিশ সরকার। এর বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি মসজিদের ইমাম ও আলেম সম্প্রদায় কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন।
তার বাইরে বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় নেতা ও মন্দিরের পুরোহিত একে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে তা রুখে দিতে তাদের সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশির পাশাপাশি রাস্তার মধ্যে ধরে ধরে নারীদের পরীক্ষা করার প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে পুনের জনগণ।
প্লেগের জন্য শরীরের বিভিন্ন স্থান, বিশেষ করে বগল, কুঁচকি ও ঘাড়ে যে গুঁটি উঠতো, সেটা পরীক্ষা করে দেখার তীব্র প্রতিবাদ জানায় তারা। বিশেষত, পুরুষ ডাক্তার যখন অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল হিন্দু কিংবা মুসলিম পরিবারের কোনো নারীর শরীরে হাত লাগিয়ে এই পরীক্ষা করেছে, তার পরিণতি ছিল ভয়াবহ। এই ঘটনাকে তারা পুরোপুরি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং শ্লীলতাহানী হিসেবে চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি প্রতিরোধের চেষ্টা করে।
প্রতিবাদের অংশ হিসেবে পুনেতে নিযুক্ত প্লেগ কমিশনার ডব্লিউ. সি. র্যান্ডকে ১৮৯৭ সালে হত্যা করা হয়। শুধু তা-ই নয়, র্যান্ডের হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধকারীদের মধ্যে অমিত সাহসের জন্ম দেয়। তারা সমগ্র ভারত, বিশেষত, দাক্ষিণাত্যে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের প্রতিরোধের মুখে ব্রিটিশদের জোরপূর্বক হাসপাতালে ভর্তি করা, সঙ্গনিরোধ তথা কোয়ারেন্টিন, কিংবা আইসোলেশন তথা বিচ্ছিন্নতা অসম্ভব হয়ে দেখা দেয়।
তারপরেও তারা নানাদিক থেকে জোর খাটাতে চেষ্টা করে। নানাভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তারা যখন সামরিক বাহিনী থেকে সহায়তা নিতে চেষ্টা করে, সেখানেও সফলতা আসেনি। উপরন্ত, যত দিন যায়, ব্রিটিশদের উপর জনগণের বিরক্তি একেবারে চরমে এসে পৌঁছায়। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ স্যানিটারি কমিশনার মানতে বাধ্য হন- যা কিছু মেডিক্যালি চিন্তা করতে গেলে কাঙ্খিত এবং গুরুত্বপূর্ণ, বাস্তবে তা অসম্ভব এবং রাজনৈতিক অবস্থা বিচারে ভয়ঙ্কর।
ভারতের নানা স্থানে প্লেগ দমন করতে গিয়ে ব্রিটিশ অফিসারদের সঙ্গে দূরত্ব থেকে এক ভয়াবহ শত্রুতার জন্ম নেয়। ১৯০০ সালে প্লেগ কমিশন যে প্রতিবেদন দেয়, সেখানে সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য বিচ্ছিন্নতার কোনো বিকল্প দেখা যায়নি। এর বিপরীতে ব্রিটিশদের চিকিৎসাপদ্ধতি আর চিকিৎসা কোনোটার উপরেই উপমহাদেশের মানুষের আস্থা তৈরি হয়নি। তারা নানাভাবে রোগে ভুগে মারা গেলেও স্থানীয় কবিরাজের বাইরে কারো চিকিৎসাকে মেনে নিতে পারেনি।
বিশ্বের নানা দেশে পশ্চিমের উপনিবেশগুলোতে যে ওষুধ ব্যবহৃত হতে দেখা যেত, তখনকার মানুষ এগুলো মানতে প্রস্তত ছিল না। বিশেষত, বিভিন্ন উপনিবেশে ইউরোপের দেশগুলোর নানামুখী লুণ্ঠন ও অত্যাচারের কারণে সাধারণ জনগণ বিরক্ত ও বিব্রত হয়।
উপনিবেশের মানুষ ফ্রান্স, ইংল্যান্ডে ও স্পেনের গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপকেই হঠকারি ও তাদের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করে। আফ্রিকা, আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ মানুষ মনে করে উপনিবেশ শক্তিশালী করার পাশাপাশি ঐ সব অঞ্চলের মানুষকে মেরে ফেলার জন্য প্লেগ কিংবা ফ্লু-র মতো রোগ ইচ্ছা করে বিস্তার ঘটিয়েছে ঔপনিবেশিক শক্তি।