আলেকজান্ডারের হারানো কবরের ব্যাপারে জানতে দেখুন আমাদের ভিডিও
আর্টিকেল পড়ুন
গ্রিক বীর আলেকজান্ডারকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। অল্প বয়সে সম্রাট হওয়ার পর একের পর এক যুদ্ধজয় তাকে করে তোলে অপ্রতিরোধ্য। পাশাপাশি, তার সম্পর্কে অনেক অমীমাংসিত রহস্যও রয়ে গিয়েছে। আর সেই রহস্য থেকেই বিভিন্ন গুজব ডালপালা মেলতে থাকে।
সম্প্রতি গ্রিসের উত্তরাঞ্চলের অ্যাম্ফিপোলিস শহরে একটি সমাধির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে৷ দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫৯০ মিটার বিস্তার পাওয়া এই সমাধিটি কার- সেই সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তাই একে নিয়ে দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়।
রহস্যাবৃত আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর কথা কম-বেশি সবাই জানে। তাই এখানেই গুজবের ডালপালা আস্তে আস্তে ঘিরে ধরছে ইতিহাসের সবটুকু রোদকে। কেউ কেউ দাবি করছেন, এই দীর্ঘ সমাধিই হয়তো প্রাচীন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সমরনায়ক ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’-এর।
সাধারণ মানুষের সব কৌতূহলে পানি ঢেলে গ্রিসের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় চলছে পুরোপুরি উল্টো পথে-উল্টো রথে। তারা বলছে, এটা কোনোভাবেই আলেকজান্ডারের সমাধি হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ তবে, প্রত্নতাত্ত্বিকদের হিসেব অনুযায়ী- এখন অবধি গ্রিসে যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাধি পাওয়া গেছে, তার মধ্যে এটাই সর্ববৃহৎ।
তবে ঐ সমাধি নিয়ে এখনই চূড়ান্ত মন্তব্য করা ঠিক হবে না। কারণ, বিশালাকৃতির সেই সমাধিতে এখনও খননের কাজ চলছে৷ প্রতিদিনের খননে নিত্যনতুন সব আবিষ্কার আমাদের ধারণা পাল্টে দিতেও পারে। তবে আলেকজান্ডারের সমাধি মনে করে জনমনে যে আগ্রহ, তা সরকারকেও ছুঁয়ে গিয়েছে। তাই তো প্রতিটি দিন নিয়ম করে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে খননের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানো হচ্ছে।
টেলিভিশনে প্রাপ্ত খবরে মন ভরছে না সাধারণ মানুষের। তারা দলবেঁধে গিয়ে জটলা তৈরি করছে খননের স্থানে। প্রতিদিন খননকাজ দেখতে এত বেশি সংখ্যক মানুষ গিয়ে হাজির হচ্ছেন যে, তাদের উৎপাতে স্বাভাবিক খনন ও গবেষণাকর্ম ব্যহত হচ্ছে। তাই বাধ্য হয় গ্রিস সরকার খননকাজের আশেপাশে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেছে।
৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩২ বছর বয়সে মারা যান মহাবীর আলেকজান্ডার৷ নিজের মতো করে পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দিতে চাওয়া এই যোদ্ধা ব্যাবিলনে মৃত্যুবরণ করেন৷ তবে তার সমাধি যে কোথায় আছে, প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে আজও সেটা অজানা৷ কেউ কেউ মনে করেন, মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরেই আলেকজান্ডারের সমাধি রয়েছে৷
তবে, গ্রিসের একটি স্থানে খননকাজ চলছিল বেশ কিছুদিন আগে। গ্রিক যোদ্ধা আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সেই শহরে চলে যান তার স্ত্রী ও সন্তান৷ তাতেও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। বিশ্বের নানা দেশের লাখো মানুষের মৃত্যুতাণ্ডব আর রক্তে যার নাম লেখা, তার পরিবারকে অত সহজে ছাড় দেওয়া হয়নি। যুদ্ধজয়ের নেশায় আলেকজান্ডার যেমন একের পর এক জনপদ ধ্বংস করেছেন, ঠিক তেমনি তার পরিবার একদিন এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে সেটা কে ভেবেছিল! বিদ্রোহীরা আলেকজান্ডারের মা, স্ত্রী, ছেলে, ভাই ও ভাবীকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। এর ফলে নতুন করে খুঁজে পাওয়া সমাধিটি তার পরিবারের বাকি সদস্যদেরও হতে পারে। নতুন খুঁজে পাওয়া সমাধি প্রসঙ্গে কেউ কেউ একটু অন্যরকম মন্তব্যও করেছেন। তাদের হিসেবেই- এই সমাধি আলেজান্ডারের কোনো ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারও হতে পারে।
আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে, ২০১২ সালে, খননকাজ শুরু হয়। তখনও সমাধিটি বড় বড় পাথর দিয়ে বেষ্টিত ছিল। তাই এর অভ্যন্তরের মূল্যবান নিদর্শনগুলো অরক্ষিতই থাকার কথা। কিন্ত বাস্তবতা ভিন্ন। সেখানকার মূল্যবান নিদর্শনের কথা আগে থেকে জেনে যায় স্থানীয় সিঁধেল চোরেরা। তারা মওকা বুঝে চৌকা মারতে শুরু করে। বিভিন্ন স্থানে শেয়ালের গর্তের মতো লম্বা সুড়ঙ্গ করে এসব চোরেরা অনেক মূল্যবান নিদর্শন হাতিয়ে নেয়।
আলেকজান্ডারের শেষ পরিণতি নিয়ে মত-দ্বিমত নতুন নয়। পুরু আর আলেকজান্ডারের গল্প কম বেশি শুনলেও এর ঐতিহাসিক ভিত্তি অনিশ্চিত। তবে, ভারতবর্ষ জয়ের উদ্দেশ্যে ঘোড়ায় চাপার আগেই জনৈক গ্রিক জ্যোতিষী এক নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তার মতে, ব্যাবিলনই আলেকজান্ডারের শেষ গন্তব্য হওয়ার কথা। তবে, ভারতবর্ষ থেকে ব্যাবিলনে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না আলেকজান্ডারের। তারপরও অজ্ঞাত কারণে অনেকটা ভাগ্যই তাকে সেখানে টেনে নেয়।
মনে করা হয়, ৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের আশেপাশে কোথাও মৃত্যু ঘটে প্রখ্যাত গ্রিক যোদ্ধা আলেকজান্ডারের। ইতিহাস যেখানে অস্পষ্ট, সেখানে কল্পকথা, গল্পগাথা আর গুজব ধীরে-সুস্থে ডালপালা মেলতে শুরু করে। আর আলেকজান্ডারের সমাধিকেন্দ্রিক গুজবেরও উৎস সেখানেই। তার সমাধি নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তির সংখ্যা এখন এত বেড়ে গিয়েছে যে, তার থেকে সত্য খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে।
আলেকজান্ডারের সমাধিকেন্দ্রিক গুজবের শুরু হেলিনিস্টিক যুগ থেকেই। প্রিয় শ্রোতা-দর্শক, এখন একটু করে বলে রাখা ভাল এই ‘হেলেনিক’ এবং ‘হেলিনিস্টিক’ শব্দ দুটো নিয়ে। ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে গ্রিস অঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন নগররাষ্ট্র। যেমন- মূল ভূখন্ডে ছিল এথেন্স, থিবস ও মেগারা; পেলোপনেসাস অঞ্চলে ছিল স্পার্টা এবং করিন্থ; এশিয়া মাইনরের তীরে ছিল মিলেটাস ইত্যাদি। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিল স্পার্টা ও এথেন্স। এদের একত্রে বলা হয় হেলেনীয় সভ্যতা।
তখনকার গ্রিক নগর এথেন্সের সমৃদ্ধি প্রতিবেশী নগররাষ্ট্রগুলো ভাল ভাবে নেয়নি। একসময় দুর্যোগ নেমে আসে এথেন্সে। স্পার্টার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পেলোপনেসীয় লিগ ও এথেন্সের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ডেলিয়ান লিগের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ধুন্ধুমার লড়াই শুরু হয়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ থুকিডাইডিস ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন এই যুদ্ধ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েই। দীর্ঘ যুদ্ধে চুড়ান্তভাবে পতন ঘটে এথেন্সের।
যুদ্ধ শুরুর দুই বছরের মাথায় মহামারি প্লেগের মৃত্যুতাণ্ডব থেকে রক্ষা পায়নি এথেন্স। প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪২৯ খ্রিস্টাব্দে পটল তোলেন পেরিক্লিস। এথেন্সের ফুটবল মাঠে এই পেরিক্লিস ছিলেন অনেকটা গোলরক্ষকের মতো। মাঠ থেকে বিদায় বিপদ ডেকে আনে এথেন্সের জন্য। ৩৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স চলে যায় স্পার্টার অধীনে। আর দীর্ঘ যুদ্ধ ততদিনে সবগুলো শহরকে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। তারা যুদ্ধের ধকল সইতে না পেরে অনেকটা ভাঁড়ে মা ভবানীর অবস্থা লক্ষ্য করছে।
আলেকজান্ডারের সমাধির সন্ধান করতে গিয়ে এত কথা বলা নিরর্থক মনে হতে পারে। তবে, এসময় গ্রিক সভ্যতা যখন ভেঙে পড়ছে, ঠিক তখনই গ্রিসের উত্তর দিকে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল মেসিডোনিয়া। হেলেনীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় তারা ইতিহাসে পরিচিতি পায় হেলেনিস্টিক সভ্যতা নামে। যেহেতু ফিলিপ থেকে শুরু করে আলেকজান্ডার- দুজনেই এই যুগের কর্ণধার, তাই আলেকজান্ডারের সমাধিকেন্দ্রিক গুজবের সূত্রপাত ও ডালপালার বিস্তার ঘটে এই হেলেনিস্টিক যুগে এসেই।
আলেকজান্ডারের সমাধি নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয় গ্রেকো-রোমান যুগ থেকে। পরে খ্রিস্টান এবং আরব শাসনকালেও এ টানাহেঁচড়া চলতেই থাকে। এজন্যই গ্রিক এই যোদ্ধা কোথায় চিরতরে শুয়ে আছেন তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
সবচেয়ে জনপ্রিয় মত হচ্ছে- ব্যাবিলনে মৃত্যুর প্রায় দুই বছর পর তার মৃতদেহ মিসরে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলে। এই উদ্দেশ্যে দীর্ঘ এক শবযাত্রার আয়োজনও করা হয়। তার মৃতদেহ বহনের দায়িত্বে ছিলেন মেসিডোনিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপের ছেলে ফিলিপ আরিডেইয়্যুস। তবে গ্রিসে যাওয়ার আগেই চুরি হয়ে যায় আলেকজান্ডারের শববাহী কফিন। কেউ কেউ শবদেহ চুরির এই ঘটনা অস্বীকারও করেন।
আরেকটি মতামত হচ্ছে- ‘আলেকজান্ডারের শবযাত্রা সিরিয়া পৌঁছালে টলেমি লগোস সিরিয়ান বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন। আলেকজান্ডারের বাহিনীরই সাবেক এক সেনাধ্যক্ষ ছিলেন টলেমি লগোস। তারা লাশবাহী কফিন সেখান থেকে কেড়ে নেয়। তারপর জোর করে সেটাকে মেসিডোনিয়ার দিকেই নিয়ে যায়। এই ঘটনার সত্যতা হিসেবে ছোটখাট একটি যুদ্ধ সম্পর্কে জানা গিয়েছে। তবে তার মূল কারণ যে কফিন ছিনতাই, সেই বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ এখনও অজ্ঞাত।
সিরিয়ার প্রান্তরে টলেমি লগোসের বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের পর আলেকজান্ডারের কফিনের গন্তব্য হয় মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া। তবে সেখানে ঠিক কবে আলেকজান্ডারের কফিন নিয়ে আসা হয়েছিল, সেই ব্যাপারে বিস্তৃত তথ্য পাওয়া যায়নি।
প্রাচীন লেখক হিসেবে স্ট্রাবো, প্লুটার্ক এবং আরো অনেকে দাবি করেছেন- আলেকজান্ডারকে আলেকজান্দ্রিয়াতেই সমাহিত করা হয়। আলেকজান্ডারের সমাধিকে ঘিরে ঐ সময়ে বানানো হয় এক সুসজ্জিত সমাধিমন্দির। তারা সেই সমাধিমন্দিরকে ডাকতো ‘সোমা’ অথবা ‘সেমা’ নামে। আদতে গ্রিক ভাষায় এই সেমা অর্থও হয় ‘সমাধি’।
বিভিন্ন সময়ে আলেকজান্ডারের সমাধি আবিষ্কারের গুজব উঠেছে। গ্রিক ভূতত্ত্ববিদরা সর্বশেষ গ্রিসের অ্যাম্ফিপোলিস প্রদেশে নতুন এক সমাধিমন্দিরের সন্ধান পান। তারপর নতুন মাত্রা পায় আলেকজান্ডারের সমাধি-রহস্য। তবে ঐ সমাধির সঙ্গে আলেকজান্ডারের সম্পর্ক আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই বিশ্ব গণমাধ্যম উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন সংবাদে।
নতুন খুঁজে পাওয়া সমাধি মন্দিরটি নির্মাণ করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫ থেকে ৩০০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। সমাধিমন্দিরটি আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াসেরও হতে পারে। এর ভেতর পাওয়া মার্বেলপাথর দিয়ে বানানো স্ত্রী-মূর্তিটি থেকে এমন ধারণা করা যেতে পারে। গ্রিক অভিজাত নারীদের অনেকের কবরেই পাওয়া গিয়েছে এমন প্রতিকৃতি। ফলে আলেকজান্ডারের সমাধির আসল অবস্থান রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।
গল্পগাথার সুবিস্তৃত ডালপালা থেকে দেখা যায়- শেষ জীবনে জিউসের সন্তান হিসেবে গ্রিসের আমন শহরের জিউসের মন্দিরে নিজের সমাধি তৈরির ইচ্ছাপোষণ করেন আলেকজান্ডার। তিনি বলে যান, তাকে এই মন্দিরে সমাধিস্থ করার কথা। প্লুটার্ক ও কোরিটিসের বর্ণনা বলছে- মৃত্যুর পর দিনছয়েক আলেকজান্ডারের সমাধির কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। নানামুখী শোক আর পরবর্তী সরকার গঠনের রাজনৈতিক জটিলতা তাদের সেই ফুরসত দেয়নি।
ওদিকে, রানী রোক্সানাও তখন অন্তঃসত্তা। সন্তানসম্ভবা রানীর পক্ষে তার সমাধি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব ছিল না। সন্তান প্রসবের আগপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেনাপতি পারডিকাস আর রানী রোক্সানার যৌথ দেশ পরিচালনার ব্যাপারে।
আলেকজান্ডারের শেষযাত্রার গল্প লিখে গেছেন ঐতিহাসিক ডিওডোরাস। ইতিহাসের থেকে গালগল্পে ভরা এই বর্ণনামতে, আলেকজান্ডারের শবযাত্রায় বিশাল এক সোনার শববাহী গাড়ি তৈরি করা হয়। সেখানে এক সোনার কফিনে তার মৃতদেহ রাখা হয়। তারপর দ্বিতীয় আরেকটি সোনার ক্যাসকেটে ভরে শবযাত্রা শুরু হয়।
বিভিন্ন হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্রসহ তার কফিনটি তোলা হয়েছিল শববাহী গাড়িতে। প্রায় দুই বছর সময় লাগিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া তার শবযাত্রার নেতৃত্ব দেন সেনাপতি পারডিকাস। এরপর শববাহী গাড়ি যাত্রা শুরু করে মেসিডোনিয়ার উদ্দেশ্যে। মনে করা হয়, মেসিডোনিয়ায় যাওয়ার পথে ঘটা এক দুর্ঘটনা থেকেই তৈরি হয়েছিল এক রহস্যময় ধাঁধা।
৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের শবযাত্রাকে বাধা দেন তারই ক্ষমতাশালী সেনাপতি প্রথম টলেমি সোটার। তার বাহিনী সমাধিবাহী গাড়ি ছিনতাই করে প্রথমে সিরিয়া নিয়ে যায়। তারপর মিশরের মেম্ফিসে নিয়ে আসা হয় আলেকজান্ডারকে। তবে, চুরির পেছনে হাত রয়েছে আলেকজান্ডারের রাজজ্যোতিষী অ্যারিস্টান্ডার কুখ্যাত সেই ভবিষ্যদ্বাণীর। সে বলেছিল, “যেখানে আলেকজান্ডারের সমাধি তৈরি করা হবে, সেই দেশ হবে সমৃদ্ধশালী, অপরাজেয়, এবং চিরশান্তির জনপদ।”
জ্যোতিষীর সেই ভবিষ্যদ্বাণী থেকে হয়তো টলেমির মাথায় কুবুদ্ধি চেপেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, কোনোভাবে আলেকজান্ডারের শবদেহ লুট করেও যদি মিশরে সমাহিত করা যায়, তবে মিসর হবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জনপদ। এরপর তিনি সেখানকার রাজা হয়ে বসলে কেউ তাকে টলাতে পারবে না। আলেকজান্ডারের লাশ চুরি আর সমাহিত করার গল্প কতটা সত্য তা বলা কঠিন। তবে টলেমীয় বংশ দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছিল মিসরে।
অনেক দাবি করেছেন, টলেমির ছিনতাই করে আনা আলেকজান্ডারের শবদেহ প্রথমে মিশরীয় রীতিতে মমি করা হয়। কারণ, এই টলেমি ছিলেন মিসরের ফেরাউন। তাদের রীতিতে মমি করে সেই শবদেহ কফিনের মধ্যে রাখা হয়েছিল। এরপর অনেকটা প্রায় মিসরীয় রীতিতেই সমাহিত করা হয়েছিল আলেকজান্ডারকে।
এখানে একটু বলে রাখা ভাল, আপনি যদি মিশরীয় ফেরাউনদের বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে দেখে নিন আমাদের ভিডিও ‘ফেরাউনদের আজব যত কাহিনি’। আবার, আপনি যদি মিশরীয় মমিদের বিচিত্র সব ব্যবহার নিয়েও জানতে চান, তাহলে দেখুন আরেকটি ভিডিও, নাম ‘মিশরীয় মমির বিচিত্র সব ব্যবহার’। দুটো ভিডিওর লিংকই দেয়া আছে ডেস্ক্রিপশনে। যা-ই হোক, আবার মূল আলাপে ফেরা যাক।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষ বা তৃতীয় শতকের শুরুর দিকে প্রথম টলেমি পটল তোলেন। এরপর তার ছেলে দ্বিতীয় টলেমি হন মিশরের রাজা। তিনি আরেক ধাপ এগিয়ে মেম্ফিস থেকে আলেকজান্ডারের সমাধি নিয়ে যান আলেকজান্দ্রিয়ায়। এবার তাকে নতুনভাবে আবার সমাধিস্থ করা হয়। কিছুদিন পর আলেকজান্ডারের প্রতি আরেকটু সম্মান জানাতে সমাধির উপর তৈরি করা হয় ‘সোমা’ বা ‘সেমা। এটা নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই বলা হয়েছে।
শবদেহ আর আলেকজান্দ্রিয়ার মন্দিরের রহস্য নিয়ে এটুকু জানা গিয়েছে। তাহলে আলেকজান্ডারের শববাহী সেই গাড়ি আর সোনার তৈরি কফিন গেল কোথায়? এখানে লোককথা বলছে ভিন্ন কথা। দাবি করা হচ্ছে- আলেকজান্ডারের সোনার কফিনের শেষ পরিণতি হয় মুদ্রায়। টলেমি বংশেরই এক উত্তরাধিকার ছিলেন নবম টলেমি। এই লোভী রাজা আলেকজান্ডারের সোনার কফিন পাল্টে প্রথমে তা তৈরি করেন ক্রিস্টাল দিয়ে। তারপর পুরনো সোনার কফিনটি গলিয়ে মুদ্রার রূপ দেন তিনি।
কফিনের যা-ই হোক, দীর্ঘদিন আলেকজান্দ্রিয়াতেই ছিল আলেকজান্ডারের শবদেহ। তার সমাধি দেখতে অগাস্টাস, ক্যালিগুলা, জুলিয়াস সিজারের মতো প্রতাপশালী সম্রাটরাও আসেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা তার সারকোফ্যাগাসের বুক থেকে বর্ম ছিড়ে নিয়ে যান স্মারক হিসেবে। অনেকটা মানুষের মতো দেখতে তৈরি শবাগারকে বলা হয় সারকোফ্যাগাস।
ওদিকে রাজা অগাস্টাস সমাধির উপরে পরম আগ্রহ আর সম্মান নিয়ে অনেক ফুলও ছড়িয়ে দেন। তারপর তিনি আলেকজান্ডারের মমির মাথায় মুকুট পরিয়ে দেন। অনেকের দাবি- অগাস্টাস সারকোফ্যাগাসের উপর ঝুঁকে সম্রাটকে চুমু খেতে গিয়ে তার নাকটা নাকি ভেঙে দেন। তবে তার এই উদ্ভট সম্মান জানানো কারও তেমন পছন্দ হয়নি তখন।
দীর্ঘ বিরতিতে (৩৭৯-৩৯৫ খ্রি.) আলেকজান্দ্রিয়া বিপাকে পড়ে। ১৫ শতকে এ শহরের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমে যায়। প্রায় পাঁচ দশক পরই হঠাৎ আলেকজান্ডারের সমাধি গায়েব করে দেওয়া হয়। তারপর থেকে সমাধির সেই দেহাবশেষ কোথায় রাখা আছে উত্তরটা সবার অজানা। তাই প্রায় ১৪০ বার অনুসন্ধান চালিয়েও মিসরের প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেই দেহাবশেষের হদিস দিতে পারেননি। তাই তো মাঝেমধ্যেই নিত্যনতুন গুজব ওঠে আবিষ্কারের।
প্রাচীন ম্যাসিডন যেখানে ছিল, সেখানে প্রাচীন শহর অ্যাম্ফিপোলিসের কাস্তা সমাধিক্ষেত্র। আর সেখানেই পাওয়া গিয়েছে মার্বেলে মোড়া এক রাজকীয় সমাধি। অনেকে ভাবতে শুরু করে- এখানেই শুয়ে আছেন যোদ্ধা আলেকজান্ডার। কেউ দাবি করে বসে- আলেকজান্ডারের বড় ভক্ত রোমান সম্রাট কারাকালা দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের দিকে তার মরদেহ নিয়ে এসে জন্মভূমি গ্রিসের মাটিতে দাফন করেছেন। তবে অপ্রতুল তথ্যসূত্রের কারণে তা অপ্রমাণিত অনুমান মাত্র।
অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, এই সমাধিটি আসলেই আলেকজান্ডারের জন্যই তৈরি করা। তবে টলেমি সোটার সম্রাটের শববাহী গাড়ি চুরি করে যত বিপত্তির জন্ম দেন। তারপর এই সমাধিক্ষেত্র আর ফেলে না রেখে রাজপরিবারে কাউকে দাফনের কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে রহস্যের শেষ এখানেই নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের নিত্যনতুন আবিষ্কারের সঙ্গে অপেক্ষা করছে আরও অনেক রহস্য। জানা যায় না কবে সমাধান হবে এই রহস্যের, আর কবে সবাই জানতে পারবে কোথায় শুয়ে আছেন জগৎ কাঁপানো গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট।