শয়তানের বাইবেল নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
আজ সারা রাত জাগতে হবে তাকে, যেভাবেই হোক মাত্র এক রাতের মাঝেই সুবিশাল এক কর্মযজ্ঞ শেষ করতেই হবে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা ধরে কাজ করেও মাত্র কয়েক পৃষ্ঠাই এগোনো সম্ভব হলো। শেষ পর্যন্ত তাই প্রার্থনায় বসে গেল লোকটি। “প্রভু, আমায় সাহায্য করুন” বলে হাত ওঠাল প্রার্থনার ভঙ্গিতে। না, সে সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেনি, বরং সাহায্য চেয়েছে বিতাড়িত শয়তানের কাছে! কিন্তু কেন? কী এমন কাজ করছিল সে যার জন্য এত খাটাখাটনি? এক রাতের মাঝে কোন মহা মিশনে নেমেছিল লোকটি? আর, এই লোকটিই বা কে?
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন যে- এমনও বই হয়, যার নামই ‘শয়তানের বাইবেল’। যেমন দশাসই ইয়া পেল্লাই তার সাইজ, তেমনি তার ওজন। যেকোনো একজন মানুষের পক্ষে এই বই বহন করা যেমন অসম্ভব, তেমনি এর ভুতুড়ে অলঙ্করণ জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। সেই সঙ্গে কন্সপিরেসি থিওরিস্টদের লাইনের পর লাইন লেখা আর ঘণ্টা ধরে বলার সুযোগ করে দিয়েছে এই বইটি।
আকৃতিগত দিক থেকে বিচার করেই হয়তো বইটির নাম ‘কোডেক্স গিগাস’। আসলে লাতিন শব্দ এই Codex Gigas; বাংলা করতে গেলে আমরা পাই ‘দৈত্যাকৃতির বই’। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস নিয়ে যাদের একটু পড়ালেখা আছে, তাঁরা একটু কষ্ট করে মনে করতে পারবেন একটি নাম ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা (Aṣṭasāhasrikā Prajñāpāramitā)’। নানা রকম চিত্রে চিত্রিত এই পুঁথির সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে মধ্যযুগে তৈরি অলংকৃত এই সুদর্শন পাণ্ডুলিপিটির।
শয়তানের বাইবেল নামে কুখ্যাত এই বই, তথা কোডেক্স গিগাসের আকৃতি ও ওজন নিয়ে প্রথমে চিন্তা করা যাক। দৈর্ঘ্য হিসাব করতে গেলে প্রায় ৯২ সেমি তথা ৩৬ ইঞ্চি, এর প্রস্থ প্রায় ২০ ইঞ্চি ছাড়িয়ে যায়। সুতরাং, প্রায় তিন ফুট দৈর্ঘের এই কোডেক্স গিগাসের প্রস্থও দেড় ফুটের বেশি। অন্তত, এদিক থেকে ধরতে গেলে তার ‘কোডেক্স গিগাস’ তথা ‘বৃহদাকার বই’ নামকরণ অনেকাংশে সার্থক।
বইটির বিশালতার কথা বোঝানো খুব একটা কঠিন নয়। এটা দেখতে যেমন বড়, তেমনি যাচ্ছেতাই রকমের ভারিও। গাধার চামড়া দিয়ে তৈরি মোট ৩১০টি পৃষ্ঠা কীভাবে কতটুকু ভারি হতে পারে তা কম-বেশি সবাই অনুমান করতে পারেন। তাই প্রায় ৩৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য আর ২০ ইঞ্চি পুরুত্বের বইটির ওজনও দশাসই, প্রায় ১৬৫ পাউন্ড অর্থাৎ ৭৫ কেজির মতো হবে। তাই কুস্তিগির তথা ব্যায়ামবীর বাদে অন্য কারও পক্ষে এই বই একা হাতে নড়াচড়া করাও বেশ কঠিন।
কোডেক্স গিগাসের নাম কীভাবে শয়তানের বাইবেল হয়ে উঠলো? সহজভাবে বলতে গেলে- পাণ্ডুলিপিটিতে প্রথাবিরুদ্ধভাবে শয়তানের বিরাট আকারের প্রতিকৃতি চিত্রিত হয়েছে। পাশাপাশি এর সৃষ্টি সম্পর্কিত কিংবদন্তিগুলোও কম-বেশি এজন্য দায়ী।
মনে করা হয়, খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে এই শয়তানের বাইবেল লেখা হয় বোহেমিয়ার বেনেডিক্টাইন পোডলাজাইস মঠে। ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে হিসাব করতে গেলে অঞ্চলটি বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের মধ্যে পড়বে।
বিশালাকৃতির ৩১০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের শেষদিকের অনেকগুলো পৃষ্ঠা পাওয়া যায় না। অনেকে ধারণা করেন, পৃষ্ঠাগুলো শয়তানে ছিড়ে ফেলেছে। তবে কে, কেন, কীভাবে ছিড়ে ফেলেছে; এই পাতাগুলো গায়েব করে দিতে পারলে কার লাভ কিংবা ক্ষতি তা স্পষ্ট করে বলা কঠিন।
প্রচলিত গল্পগাথা থেকে জানা গিয়েছে, তখন চেক প্রজাতন্ত্রের এক অত্যাচারী রাজার শাসন চলছিল। আনুমানিক ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ হবে। অত্যাচারী রাজার সাগরেদ এক সন্ন্যাসী করে বসে যাচ্ছেতাই এক আকাম। তারপর তাকে টেনেহিঁচড়ে রাজার কাছে ধরে নিয়ে আসা হয় বিচারের জন্য। খুব সম্ভবত পশুসঙ্গমের শাস্তি হিসেবে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
শয়তান সন্ন্যাসী মৃত্যুর আগে রাজার কাছে আজব এক আর্জি পেশ করে। শেষবারের মতো একটি সুযোগ প্রার্থনা করে সে। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান সংকলন করে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরির প্রতিশ্রুতি সে দেয় রাজাকে। তখন রাজা তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। তবে, মাত্র এক রাতের মধ্যে সেই কাজ করতে বলা হয় তাকে। তারপরও সন্ন্যাসী রাজার প্রস্তাবে না করেনি।
বদমাশ সন্ন্যাসী সাথে সাথেই কাজে লেগে পড়ে। দীর্ঘসময় টানা লেখার পরও সেই পাণ্ডুলিপি শেষ করতে পারেনি সে। বাধ্য হয়ে সন্ন্যাসী নরকের রাজপুত্র লুসিফারের সাহায্য প্রার্থনা করে। তার কুকর্মে উচ্ছ্বসিত লুসিফার সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। আর তার বিনিময়ে সন্ন্যাসী নিজ আত্মা উৎসর্গ করে দেয় লুসিফারের প্রতি। তারপরও সেই বদ সন্ন্যাসী মারা যায় এই বাইবেল শেষ না করেই।
নরকের রাজপুত্র লুসিফার কথা রেখেছিল। সে মুহূর্তের মধ্যে পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ করে দেয়। শিল্পীর তুলিতে আধেক কল্পনা আর আধেক শিল্পের মেলবন্ধনে নরকের রাজপুত্র লুসিফারকে দেখানো হয় নানাভাবে। তবে মনে করা হয়, কোডেক্স গিগাস শেষ করে ফিরে যাওয়ার আগে লুসিফার এই গ্রন্থের ২০৯ পৃষ্ঠায় তার স্বাক্ষরস্বরূপ এক কদাকার শয়তানের ছবি এঁকে গেছে। তাই সহজেই একে দাবি করা যায় ‘শয়তানের বাইবেল’ হিসেবে।
অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে- শয়তানের এই বাইবেলে লুসিফারের স্বাক্ষরের ঠিক বিপরীত পৃষ্ঠায় আঁকা হয়েছে স্বর্গীয় শহর জেরুজালেমের প্রতিকৃতি। ‘শয়তানের বাইবেল’ প্রকাশ হওয়ার আগে ঐ সময়ের শিল্পকর্মে শয়তানের প্রতিকৃতির ব্যবহার তেমন কম ছিল না। তখন প্রায়ই শয়তান এবং তার অভিশপ্ত শিষ্যদের ছবি আঁকা হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে। তবে কোডেক্স গিগাসের পাণ্ডুলিপিতে দৃশ্যমান শয়তানের প্রতিকৃতি ছিল একটু আলাদা।
বিভিন্ন গ্রন্থে আঁকা শয়তান নানা রকম বিকৃত অঙ্গভঙ্গি আর উদ্ভট প্রতিকৃতির হলেও কোডেক্স জিগাসের শয়তানের পরনে কোনো পোশাক নেই। সম্পূর্ণ একাকী এবং এহেন উলঙ্গ শয়তানের প্রতিকৃতি ঐ সময়ের হিসেবে একেবারেই বিরল। তাই শিল্প-ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবেও এই শয়তানের বাইবেলকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়।
ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে ১৫৯৪ সাল পর্যন্ত কোডেক্স গিগাস রাখা হয় চেক প্রজাতন্ত্রের শহর শ্রুদিমের এক সংগ্রহশালায়। দীর্ঘদিন সংরক্ষিত থাকার পর রাজা দ্বিতীয় রুডলফ সেখান থেকে বইটি ফেরত দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধার নিয়েছিলেন। তারপর তিনি সেটা নিয়ে যান প্রাগ শহরে।
তবে শয়তানের বাইবেল নিয়ে আসার পর তার উপরও শয়তানের আছর হয়। তিনি বেমালুম ভুলে যান সেই প্রতিশ্রুতির কথা। তারপর ১৬১৮ সালের দিকে চেক প্রজাতন্ত্রে যুদ্ধ বাধে। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয় আনুমানিক ত্রিশ বছর ধরে। এই সময় অনেক মানুষের প্রাণের পাশাপাশি চেকরা অনেক কিছুই হারিয়েছে, তাদের হাতছাড়া হয়েছিল শয়তানের বাইবেলও।
শয়তানের প্রতিকৃতির বিপরীত পৃষ্ঠায় আঁকা স্বর্গীয় শহর জেরুজালেম কোন বিশেষ ইঙ্গিত দেয় সেটা পরের প্রশ্ন। তবে ত্রিশ বছর ধরে চলা যুদ্ধের সুযোগে কোডেক্স গিগাসও কেড়ে নেয়া হয়েছিল চেকদের থেকে। ১৬৪৮ সালে যুদ্ধ শেষে সুইস সৈনিকরা গাধার চামড়ায় তৈরি এই বিশালাকৃতির পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে যায় স্টকহোম শহরে।
দীর্ঘদিন Royal Library of Stockholm-এ সংরক্ষণ করা হয়েছিল কোডেক্স গিগাস। তারপর সুইস গবেষকদের নজরে আসলে অনুসন্ধানের দেখা মেলে। দীর্ঘ গবেষণার পর বের হয়ে আসে এর রোমাঞ্চক সব মিথ এবং ইতিহাস। তাই অনেকটা ঐতিহাসিক মূল্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ২০০৭ সালে আবার প্রাগে ফিরিয়ে আনা হয় পাণ্ডুলিপিটি। তারপর সেখানকার জনসাধারণের দেখার জন্য প্রথমদিকে বইটি উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।
কথায় কথায় সবাই বাঙালিদের দোষ দেয়, কিন্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে গিয়ে তার ক্ষতিসাধনে পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষ কম যায় না। এই শয়তানের বাইবেল প্রথমদিকে সবার দেখার জন্য উন্মুক্ত করা হলে প্রত্যেকে খেয়াল-খুশিমতো এর পাতার মধ্যে খেলাল করতে শুরু করে। অনেকে বইয়ের পাতা খুলে পোজ দিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করে। অতি উৎসাহী এক দর্শক এই শয়তানের বাইবেল উঁচু করে মাথায় নেওয়ার চেষ্টাও করেছিল। তারপর বাধ্য হয়ে Royal Library of Stockholm উৎসাহী জনতার উৎপাত থেকে বাঁচতে বইটি দেখার সুযোগ বাতিল করে।
শয়তানের বাইবেল নিয়ে প্রচলিত গল্পের সত্যতা যাচাই করা বেশ কঠিন, এবং ক্ষেত্রবিশেষে গল্পগুলো হাস্যকরও বটে। কাহিনী অনুযায়ী, বইটি লিখতে সময় লাগে মাত্র এক রাত। তবে গবেষকদের ধারণা, একজন লেখক পুরো সপ্তাহ জুড়ে প্রতিদিন প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে লিখলেও বইটি শেষ করতে প্রায় ত্রিশ বছর লেগে যাওয়ার কথা। যত যা-ই হোক, একজন সন্ন্যাসীর পক্ষে প্রতিদিন নিয়ম মেনে ৬ ঘণ্টা কাজ করা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। তাই প্রশ্ন জেগেছে- বইটি সংকলন করতে তবে কি এক রাত না, প্রায় ত্রিশ বছরের মতো লেগেছিলো?
বিজ্ঞানের গবেষণা আর সাধারণ যুক্তি কোনোটাতেই মেনে নেওয়া যায় না যে, এই কোডেক্স গিগাস মাত্র একরাতে লেখা হয়েছিল। তবে সংকট তৈরি হয়েছে হাতের লেখা পরীক্ষা করে। আর সেখানেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে- পাণ্ডুলিপিটির লেখক মাত্র একজনই। শয়তানের বাইবেলে লেখার জন্য যে লাল, নীল, হলুদ এবং সবুজ রঙের কালি ব্যবহার করে হয়েছে, ঠিক সেই কালিতেই ছবিগুলোর আঁকা। তাই এর রচয়িতার বিষয়টি রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে যুগের পর যুগ।
ল্যাটিন ভাষায় লেখা এই পাণ্ডুলিপির শুরুতে যুক্ত করা হয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্ট। তারপর বাইবেল বাদেও ঠাঁই মিলেছে ফ্লেভিয়াস জোসেফাসের রচনা। তিনি তার কুখ্যাত ‘দ্য জুইশ ওয়ার অ্যান্ড জুইশ অ্যান্টিকুইটিজ’ গ্রন্থটিও এখানে জুড়ে দিয়েছিলেন।
সেইন্ট ইসিডোর রচিত একটি বিশ্বকোষও রয়েছে এখানে। পাশাপাশি, পাদরি কোমাক রচিত দ্য ক্রনিকল অব বোহেমিয়া এবং বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের অংশবিশেষ জুড়ে দেওয়া হয়েছে এই কথিত শয়তানের বাইবেলে। তবে, পুরো পাণ্ডুলিপিতে মাত্র দুটি ছবি পাওয়া যায়। নরকের রাজপুত্র লুসিফার এবং স্বর্গীয় শহর জেরুজালেম বাদে সেখানে আর কিছুই আঁকা নেই।
কোডেক্স গিগাসে আঁকা ছবিতে মনে হয়, নরকের রাজপুত্র লুসিফার একটুখানি সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। তার দিকে হঠাৎ দৃষ্টি দিলে মনে হবে, লুসিফার বুঝি বই থেকে বের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে যেকোনো সময়ে। খুব সম্ভবত সেই সময়ের চেক প্রজাতন্ত্রে প্রচুর চোরের উপদ্রব ছিল। তাই সেখানে চোর ধরার জন্য কার্যকর দুটি মন্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। জ্বিন ভূত, প্রেতাত্মা, শয়তানের উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়ার বিভিন্ন অদ্ভুত ধারণা পাওয়া যায় বইটিতে।
উদ্ভট কারণে স্বর্গীয় শহর জেরুজালেমের ছবিতে কোনো মানুষের ছবি আঁকা হয়নি। তারা শহরটিকে জনমানবশূন্য হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এক্ষেত্রে তাদের কল্পনার জেরুজালেম উদ্ধারের স্বপ্ন অন্যতম কারণ হতে পারে। এর বাইরে আরও অনেকগুলো বিষয় আছে যা পুরো বিষয়টিকে অনেক বেশি জটিল ও রহস্যঘেরা করে তুলেছে। তাই আকৃতির কথা বিবেচনা করে এর নামটি যেমন কোডেক্স গিগাস, তেমনই রহস্যময়তা আর উদ্ভট সব বর্ণনার কারণে একে ডাকা হয় শয়তানের বাইবেল হিসেবে। তবে বর্ণনার বাইরেও নরকের রাজপুত্র লুফিসারের সেই চিত্রটিও এর শয়তানের বাইবেল নামকরণের জন্য কম-বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত।