সিরিয়াল কিলার জাভেদ ইকবালকে নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
১৯৯৯ সালের ৯ জুলাই। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে পরিবারের সাথে থাকত বাচ্চা এক ছেলে, নাম তার ফয়সাল রাজ্জাক, বয়স ৯ বছর। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল না। তাই লাহোরের এক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় থাকত তারা। পরিবারে একটু বাড়তি আয়ের যোগান দিতে অল্প বয়সেই অর্থ উপার্জনে নামতে হয় ফয়সালকে। ঠোঙা বানাত সে।
সেদিনও সে একইভাবে কারখানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, প্রতিদিন কাজ শেষে ফিরে আসলেও সেদিন আর ফেরেনি ফয়সাল। ফেরেনি পরদিনও। তার দেখা আর কখনোই পায়নি তার বাবা-মা।
কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। ১৩ বছর বয়সী কিশোর শাকিল স্কুলে যাবার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু সেদিন সে স্কুলে যায়নি, স্কুলের সময় শেষে ফেরেনি বাড়িতেও। এটাই ছিল তার শেষ বিদায়।
ফারাজ খানও বাসা থেকে বেরিয়েছিল, উদ্দেশ্য বাসার অল্প দূরেই থাকা মুদি দোকান থেকে আটা কিনতে। তাকেও আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দিন গড়াতে থাকল। এই তালিকায় একে একে যুক্ত হতে থাকল লাহোরের আরও কিশোরের নাম- তসলিম উল্লাহ্ (১৪), আব্দুল মজিদ (১৬), জিশান নাজির (১৩), এবং দেলওয়ার হোসেন (১৫)। হারিয়ে যাওয়া এই কিশোরদের মাঝে মিল ছিল কেবলমাত্র একটাই- তারা সবাই ছিল দরিদ্র পরিবারের সন্তান।
মাসখানেক পর এই তালিকায় আরও এক কিশোরের নাম যুক্ত হয়- এজাজ মুহাম্মদ। পরিবারের লোকজন আদর করে তাকে ‘কাকা’ বলে ডাকত। কাকা আর তার বড় ভাই অদ্ভুত এক পেশায় যুক্ত ছিল। মানুষের গা মালিশ করে দেয়াই ছিল তাদের কাজ। এজন্য লাহোরের রাস্তায় রঙিন বোতলে তেল নিয়ে ঘুরে বেড়াত তারা, এখানে-ওখানে চেয়ে চেয়ে খুঁজত খদ্দের। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পায়ে থাকত নুপুরও।
খদ্দের পেয়ে গেলে আচ্ছামতো তার ঘাড়, পিঠ, মাথা মালিশ করে দেয়াই ছিল তাদের পেশা। অবশ্য, মাঝে মাঝে বিকৃত রূচির কিছু খদ্দেরের দেখাও মিলত তাদের। সেসব ক্ষেত্রে সেই খদ্দেরদের শয্যাসঙ্গীও হতে হতো তাদের।
অক্টোবরের এক সকালে প্রতিদিনের মতোই দুই ভাই বেরিয়েছিল খদ্দেরের খোঁজে। এমন সময় তাদের দিকে এগিয়ে আসে দুই কিশোর, জানায়- তাদের বসের গা মালিশ করে দিলে মিলবে ডাবল পারিশ্রমিক। তবে এজন্য বসের বাসায় যেতে হবে তাদের। বাড়তি অর্থের হাতছানি সামলাতে পারেনি তারা। তাই যাবার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
কয়েক মিনিট হাঁটার পরই গন্তব্যস্থলে পৌঁছায় তারা চারজন। কাকা ভেতরে চলে যায়, দেখা হয় মাঝারি গড়নের, চশমা পরা এক লোকের সাথে; নাম জাভেদ ইকবাল। ওদিকে তার বড় ভাই যায় আরেক খদ্দেরের সন্ধানে। কে জানত যে দুই ভাইয়ের ওটাই হবে শেষ দেখা?
পরবর্তী কয়েক মাস জুড়ে আসলে পাকিস্তানে এভাবে একের পর এক ছেলেশিশু বা কিশোর নিখোঁজ হতে থাকে, আর সবার অগোচরে নিজের হত্যানামা বাড়িয়ে যেতে থাকে এক সিরিয়াল কিলার, নাম তার জাভেদ ইকবাল। অথচ, সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো- তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো পুরোপুরি প্রমাণ করা যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনই তার বাড়িতেই মিলেছিল নিখোঁজ হওয়া বিভিন্ন ছেলের দেহাবশেষ ও পোশাকের সন্ধান!
বেশ অদ্ভুত লাগছে, তাই না? আমাদের সিরিয়াল কিলার সিরিজের এই পর্বে আমরা পাকিস্তানী সিরিয়াল কিলার জাভেদ ইকবালকে নিয়েই জানব, যার হাতে নিহতের সংখ্যা শতাধিক। টার্গেটকে নানা ছলছুতোয় ডেকে এনে নির্যাতন করে সবশেষে শ্বাসরোধ করে হত্যা করত ইকবাল। এরপর সেই লাশের সন্ধান যেন কেউ না পায়, সেজন্য তা ডুবিয়ে রাখত এসিডভর্তি ড্রামে, যাতে লাশটা সেখানেই শেষ হয়ে যায়। সিরিয়াল কিলারদের তথ্য প্রদান করা বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ইকবালকে গত শতকের কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারদের শীর্ষস্থানেই রাখা হয়েছে।
পাকিস্তানের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে একটা চিত্র বেশ পরিচিত। প্রতি বছরই হাজার হাজার কিশোর তাদের পরিবার থেকে উধাও হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নানা রকম পারিবারিক কলহ এর পেছনে দায়ী থাকে।
এই কিশোরেরা রাস্তার পাশে নানা রকম ছুটা কাজ করে, সেখানেই থাকে, সেখানেই ঘুমোয়। সেই সাথে আরও একটা কাজেও জড়িয়ে যায় তারা- নেশার অন্ধকার জগতের স্থায়ী সদস্যের খাতায় খুব অল্প বয়সেই নাম লেখায় তারা।
পুলিশের কাছে গিয়েও যে এই হারানো ছেলেপেলেদের বাবা-মা খুব একটা সহায়তা পায়- তা-ও না। পুলিশেরও গৎবাঁধা উত্তর, “দেখেন গিয়া আত্মীয়স্বজনের বাসায় ঘুরতে গেছে! কয়েকদিন পর এমনেই ফিরে আসবে!” ফলে কয়েকদিন হাসপাতাল আর মর্গে ঘোরাঘুরির পর দরিদ্র এই বাবা-মায়েরাও ধীরে ধীরে নিয়তিকে মেনে নেয়।
১৯৯৯ সালটা পাকিস্তানের জন্য বেশ কঠিন এক সময়ই ছিল। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় সেই বছর আসেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। ওদিকে, পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষার দায়ে দেশটির অর্থনীতির উপর জেঁকে বসেছিল মার্কিন নানা নিষেধাজ্ঞা। এমন টালমাটাল পরিস্থিতিতে দরিদ্র পরিবারগুলোর হারিয়ে যাওয়া ছেলেদের নিয়ে ভাববার ফুরসতই পাচ্ছিল না পুলিশ বাহিনী।
সেই বছরেরই নভেম্বর মাসে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। লাহোরের এক পুলিশ স্টেশনে এলো এক উড়ো চিঠি, যেখানে প্রেরক দাবি করে যে সে নাকি ঘরপালানো একশোরও বেশি ছেলেকে হত্যা করেছে!
এমন চিঠি পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবার কথা, নেবার কথা কুইক অ্যাকশন। কিন্তু এর কিছুই হলো না। কারণ একটু আগেই বলা হয়েছে- দেশজুড়ে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা।
তারপরও দায়িত্ব পালনের খাতিরে কয়েকজন কনস্টেবলকে নিয়ে ডিএসপি তারিক কাম্বোহ গেলেন প্রেরকের ১৬-বি, রবি রোডের বাড়ির ঠিকানায়। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, সেদিন বাসায় গিয়ে তারা চিঠির প্রেরক জাভেদ ইকবালকে পেয়ে যায়। যখন তারা সেই চিঠি নিয়ে তার সাথে কথা বলতে শুরু করে, তখনই সে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আচরণ শুরু করে। একপর্যায়ে তো তার সাথে থাকা লাইসেন্স করা পিস্তল বের করে নিজেকে গুলি করার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে বসে।
বিষয়টা বেশ অদ্ভুত লাগলেও সত্য যে, পুলিশের লোকজন ভেবেছিল- লোকটির মাথার স্ক্রু বোধহয় কিছুটা ঢিলা! নাহলে পুলিশের সামনে কেউ বন্দুক বের করে আত্মহত্যার হুমকি দেয়? তারা তাই আর তাকে না ঘাটিয়ে চলে যায়। বাড়ির ভেতরে সার্চ পর্যন্ত তারা করেনি। যদি সেদিন তারা জাভেদ ইকবালের এই পাগলামি আর হুমকি উপেক্ষা করে বাড়ির ভেতর ঢুকত, তাহলে হয়তো ঘটনা পুরোই অন্যরকম হতে পারত।
এখানে অবশ্য একটা কথা বলে রাখা ভাল, এই জাভেদ ইকবালের নাম কিন্তু ইতোমধ্যেই স্থানীয় পুলিশের খাতায় উঠে গিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে কিশোরদের সাথে জোরপূর্বক যৌনসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টার কমপক্ষে দুটো অভিযোগ ইতোমধ্যেই থানায় জমা পড়েছিল। তাই তার মাথায় ছিট আছে ভেবেই সেদিন আর তাকে খুব একটা ঘাটায়নি পুলিশ সদস্যরা।
ওদিকে, পুলিশ সদস্যদের এমন আচরণ, তাকে এমন হালকাভাবে নেয়াটা মোটেও মেনে নিতে পারেনি ইকবাল। যে অ্যাটেনশন সিকিংয়ের উদ্দেশ্যে সে এমনটা করেছিল, তা পুরোপুরিই মাঠে মারা যাওয়ায় সে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। তাই তো সেই একই চিঠির পাশাপাশি ডজনখানেক কিশোরের ছবি, যাদের সে হত্যা করেছিল, সে পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় উর্দু দৈনিক পত্রিকা ‘জঙ’-এ। ভারি সেই এনভেলপ গিয়ে পড়ল পত্রিকার অপরাধ বিভাগের সম্পাদক জামিল চিশতির হাতে।
কী ছিল সেই চিঠিতে? সহজ করে বললে- নিজের পুরো অপরাধকর্মের বর্ণনা তুলে ধরেছিল সিরিয়াল কিলার জাভেদ ইকবাল। হতভাগ্য সেই কিশোরদের নাম, ঠিকানা, কীভাবে তাদের সে হত্যা করেছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, কীভাবে এসিডভর্তি ড্রামে ডুবিয়ে সে লাশগুলো গুম করে দিয়েছে, এসিড কিনতে কত খরচ হয়েছে, তার সাহায্যকারী হিসেবে কে কে ছিল- সবই সে উল্লেখ করে চিঠিতে।
এমন চিঠি আর একগাদা ছবির প্রমাণ পেয়ে জনাব চিশতির তো মাথায় হাত! তার মনে তখন একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, “হয় লোকটাকে কেউ ফাঁসাতে চাচ্ছে, নাহলে সে আসলেই এতগুলো খুনের সাথে জড়িত!”
সংবাদপত্রে এই খবর ছাপানোর আগে স্বচক্ষে যাচাইবাছাই করতে তাই এক সহকর্মীকে নিয়ে প্রেরকের ঠিকানায় চলে গেলেন চিশতি। সেদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। একটু আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকলেন তারা। বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরে খোলা জায়গায় বেশ কয়েকটা নীল রঙের ড্রাম রাখা ছিল, ছিল ছেলেদের জামাকাপড় আর জুতাও- ঠিক যেমনটা চিঠিতে লেখা হয়েছিল। ভেতরের বাতাসেও কেমন যেন একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল; বোটকা একধরনের গন্ধ।
খুব সাবধানে তারা একটা ড্রামের উপরের ঢাকনা সরাল। সাথে সাথেই পচা, রাসায়নিকযুক্ত এক গন্ধ তাদের যেন সজোরে ধাক্কা দিল। ভেতরে ছিল এক ছেলের অর্ধগলা লাশ! এটা দেখে তাদের দুজনেরই চোখ ছানাবড়া।
সাথে সাথেই ইকবালের দেয়া চিঠি থেকে ছেলে হারিয়েছে এমন কয়েকটি পরিবারের সাথে যোগাযোগ করল তারা। সেখান থেকেও ইকবালের দেয়া বর্ণনার সত্যতাই মিলল। ডেইলি জঙের দুই সাংবাদিক বুঝে গেলেন, তাদের হাতে থাকা খবরটা প্রকাশ পেলে তা সারা দেশে কী হইচই ফেলে দিতে পারে।
অবশেষে ডিসেম্বরের ৩ তারিখে জঙের প্রথম পৃষ্ঠায় এলো আত্মস্বীকৃত সিরিয়াল কিলার ইকবালের হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত খবর, যার শিরোনাম ছিল “শতাধিক শিশুকে খুনের স্বীকৃতি দিল হত্যাকারী”। এরপর যেন টনক নড়ল পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনীর। সারা দেশে শোরগোল ফেলে দিল জঙের এই রিপোর্ট।
মাঝে দিয়ে একটা কথা বলে রাখি। আপনি যদি সিরিয়াল কিলারদের অপরাধনামা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হোন, তাহলে আমাদের চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখুন। নিয়মিতই আমরা বিশ্বের কুখ্যাত সব সিরিয়াল কিলারের কাহিনি নিয়ে আসব আপনাদের কাছে। … যা-ই হোক, ইকবালের আলাপে আবার ফেরা যাক।
নিহতদের শনাক্তকরণের জন্য ইকবালের বাড়ি থেকে পাওয়া কাপড়চোপড়গুলো নিয়ে আসা হলো পুলিশ স্টেশনে। সেখানে যেন সন্তানহারা বাবা-মায়েদের ঢল নামলো। কাপড়চোপড় দেখে সেটা তাদের হারানো সন্তানের কিনা তা দেখতে লাগলেন অগণিত বাবা-মা। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য।
কয়েকটি প্লাস্টিকের ক্যান ভর্তি এসিড এবং দুটো নীল রঙের ড্রামও নিয়ে আসলো পুলিশ। সেই দুটো ড্রামেই ছিল মানবদেহের অবশিষ্টাংশ। দেহগুলো এতটাই পচে-গলে গিয়েছিল যে তা থেকে আলাদা করে আর নিহতদের শনাক্ত করা যায়নি। তবে বোঝা গিয়েছিল যে তাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মাঝে হবে।
আলোচিত এই ঘটনা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল, যার ফলে বিদেশি সাংবাদিকরাও এই সিরিয়াল কিলিংয়ের তথ্যানুসন্ধানের জন্য পাকিস্তানে ভিড় জমাতে শুরু করে। সরকারের একেবারে উপরমহল থেকে দ্রুত অপরাধীকে ধরবার জন্য চাপ দেয়া হতে থাকে। কিন্তু যাকে সবার সন্দেহ, সেই জাভেদ ইকবাল নিজে লাপাত্তা!
ইকবালকে পুলিশ খুঁজতে থাকুক, এই ফাঁকে চলুন আমরা তার অতীত থেকে একটু ঘুরে আসি।
উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান ছিল জাভেদ ইকবাল। তারা ছিল পাঁচ ভাই আর তিন বোন। বাবার ছিল স্টিল পাইপ তৈরির ব্যবসা। এলাকায় ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ পরিচিতি ছিল তার বাবার। জমিজমা, দোকানপাট, কয়েকটা বাড়ি- কী ছিল না তাদের! লাহোরের অনেকেই তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মুহাম্মদ আলী এন্ড সান্স’কে একনামে চিনত।
শৈশব থেকেই বেশ পড়ুয়া স্বভাবের ছিল ইকবাল। নিয়মিত বিভিন্ন ডায়েরি লিখত, লেখা পাঠাত বিভিন্ন ম্যাগাজিনেও। এমন পড়ুয়া স্বভাবের কথা শুনে যদি তাকে শান্তশিষ্ট ভেবে থাকেন, তাহলে ভুল করছেন আপনি। বরং বেশ গোলমাল পাকানো স্বভাবেরই ছিল সে। আশেপাশের ছেলেপেলের সাথে প্রায়ই মারামারিতে জড়িয়ে পড়ত। মাঝে মাঝে সে এমন সব কাজকারবার করত যা আসলে কোনো যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। ভাই-বোনেরা ভাবত, তাকে হয়তো জিনে ধরেছে।
দিন যেতে লাগল, বয়স বাড়তে লাগল ইকবালের। সেই সাথে একটা বিষয়ও পরিষ্কার হয়ে গেল ইকবালের নিজের কাছে, সেই সাথে তার পরিবারের সদস্যদের কাছেও- সে আসলে সমকামীতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এক পীর বাবা নাকি তার পরিবারের সদস্যদের এটা বলেও সতর্ক করে দিয়েছিল যে, যদি কোনো নারীর সাথে তাকে বিয়ে দেয়া হয়, তার ফল খুব একটা ভাল হবে না।
পরিবারের সদস্যরা ইকবালের এই বিকৃত যৌনকামনাকে মেনে নিতে পারেনি। ওদিকে, তার বয়স যখন বিশের কোঠায় গেল, তখন পাড়াপ্রতিবেশিরাও বুঝতে পারল যে, ইকবালের যৌনতা নিয়ে কোনো একটা বড় রকমের সমস্যা আছে। সদ্য কৈশোরে পা রাখা ছেলেদের প্রতি সে যে অন্য রকমের আচরণ করত- এটা অনেকের কাছেই ধরা পড়ল।
এলাকায় এই ব্যাপারে তার দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ছিল। পরিবারের কাছেও নিয়মিতই শিশু-কিশোরদের সাথে তার অন্যরকম আচরণ নিয়ে অভিযোগ আসতে লাগল। ওদিকে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ইকবালের একরোখা মনোভাব আরও বাড়ছিল। সে কারও তোয়াক্কা করছিল না। ১৯৯০ সালে তো মাত্র নয় বছর বয়সী এক বাচ্চা ছেলেকে ভুলিয়েভালিয়ে বাড়িতে এনে তার উপর নিজের বিকৃত কামনা চরিতার্থ করে সে। স্থানীয় থানায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলেও ঘুষ দিয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে নেয় সে।
এই ঘটনার পর ভাই-বোনদের সাথে ইকবালের সম্পর্ক একেবারেই তলানীতে গিয়ে ঠেকল। তারা কেউই আর তার সাথে থাকতে চাইল না। ফলে সম্পত্তির ভাগাভাগি হয়ে গেল। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ইকবাল নিজের একটা বাড়ি বানাল, আর আয়-রোজগারের জন্য চালু করল মেটাল ওয়ার্কসের ওয়ার্কশপ। তার সেই ওয়ার্কশপে সে কেবল বেছে বেছে সদ্য কৈশোরে পা রাখা ছেলেদেরই নিয়োগ দিত, যাদের সবাই আবার ছিল ঘরপালানো!
এই ছেলেগুলোর থাকা-খাওয়া-কাপড়চোপড় সব কিছুর ব্যবস্থাই করত ইকবাল। এমনকি বিনোদনের জন্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় তাদের ঘুরতেও নিয়ে যেত সে। এদের মাঝেই ছিল সাজিদ নামে একজন, যে পরবর্তীতে ইকবালের ডানহাত হয়ে ওঠে।
সমকামী, শিশুকামী এই স্বঘোষিত সিরিয়াল কিলার জীবনে দুটো বিয়েও করেছিল, যদিও কোনোটিই শেষপর্যন্ত টেকেনি। প্রথম ঘরে তার এক মেয়ে জন্ম নেয়, পরের ঘরে ছিল এক ছেলে। অবশ্য বলে রাখা ভাল, দুটো বিয়েই পরিবারের চাপে পড়ে করেছিল সে, স্বেচ্ছায় কখনোই না।
পরের কয়েক বছরের মাঝে ইকবালের বিরুদ্ধে কমপক্ষে দুটো অভিযোগ আসে ধর্ষণের; দরিদ্র পরিবারের দুটো ছেলেকে ধর্ষণ করেছিল সে। তবে ব্যাপারটা যেন পুলিশ পর্যন্ত না গড়াত, সেজন্য ছেলেদের বাবা-মায়ের হাতে কিছু রূপি গুঁজে দিয়ে মিটমাট করে নেয় সে।
১৯৯৮ সালে আবারও একই অভিযোগ আসে তার বিরুদ্ধে। এবার দুটো বাচ্চা ছেলেকে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেছিল ইকবাল। এবং এবারও পুলিশের হাতে কিছু অর্থ গুঁজে দিয়ে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয় সে।
এর কয়েক মাস পরে ঘটে যায় ইকবালের জীবনের মোড় বদলে দেয়া ঘটনা, যা তাকে নিয়ে যায় সিরিয়াল কিলিংয়ের দিকে। ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরকে শরীর টিপে দেয়ার জন্য বাড়িতে এনেছিল সে। সেই ছেলের উপরও যৌন নির্যাতন চালাতে গিয়েছিল সে। কিন্তু ছেলেটা প্রতিবাদ করে ওঠে। ধর্ষিত হবার পর সে ইকবালকে এমন পেটানো পেটায় যে তাতে তার খুলির হাড় ভেঙে যায়, স্থানচ্যুত হয় চোয়ালও। পরবর্তী ২০ দিন সে কোমায় ছিল। কয়েক মাস তো অন্যের সাহায্য ছাড়া সে হাঁটাচলাই করতে পারত না।
বড়সড় এক অপারেশন করতে হয়েছিল তার, যার ফলে ব্যাংক ব্যালেন্স নেমে আসে শূন্যের কোটায়। ব্যবসাতেও ধস নামে। তখনই সে তার মাকে নিয়ে ছোটখাট এক বাড়িতে গিয়ে ওঠে, যার কথা এই ভিডিওর শুরুতেই বলা হয়েছে। মা-ই অসুস্থ ইকবালের দেখাশোনা করত।
কয়েক মাস পর তার মা-ও মারা যায়। এরপরই পুরোপুরি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে ইকবাল। এতদিন তার জন্য তার মাকে কাঁদতে দেখেছে সে, এবার সে সিদ্ধান্ত নেয় অন্য সব মাকেও কাঁদানোর। সমকামী, শিশুকামী ইকবালের পুনর্জন্ম হলো সিরিয়াল কিলার জাভেদ ইকবাল হয়ে। তার ভাষায়, “যেদিন আমাকে ছেলেটা ওভাবে মারল, আমি তো সেদিনই মারা গেছি!”
১৯৯৯ সালের জুলাই থেকে শুরু হলো তার কিলিং মিশন। বিশ্বস্ত অনুচরদের মাধ্যমে পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানো দরিদ্র পরিবারের কিশোরদের নিজের বাড়িতে আনতো ইকবাল। এরপর তাদের উপর যৌন নির্যাতন করে শ্বাসরোধ করে হত্যা করত।
এই যে যেসব কিশোরকে আনা হতো, তাদের সবার নাম, পরিচয় একটা ডায়েরিতে লিখে রাখত ইকবাল; তুলে রাখত ছবিও। সেই সাথে তাদের নির্যাতনের প্রতিটি মুহূর্তের বর্ণনাও ডায়েরিতে লিখে রাখতে ভুলত না সে।
ইকবালের অতীতে ঘোরা হলো। শৈশব পেরিয়ে কীভাবে সে একজন সমকামী, শিশুকামী, এবং সিরিয়াল কিলারে বিবর্তিত হলো, তা আশা করি বুঝে গেছেন এতক্ষণে সবাই। এবার চলুন আবার সেই সময়ে ফিরে যাওয়া যাক, যখন সারা দেশের পুলিশ তাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ইকবাল তখন আত্মোগোপনে চলে গেছে। ইসলামাবাদের বাইরের বিভিন্ন মাজারে ফকিরদের মাঝেই ছদ্মবেশ ধারণ করে চলছিল সে। অবশেষে ২৯ ডিসেম্বর রাতের বেলায় সেই জঙ পত্রিকার অফিসেই মুখভর্তি আধাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ময়লা পোশাক আর ছেড়া স্যান্ডেলে হাজির হয় সে। রিসিপশনের সামনে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে, “আমি জাভেদ ইকবাল… ঐ যে যে লোকটা একশোর বেশি বাচ্চাকে খুন করেছে…”
রিসিপশনিস্ট যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল, শোরগোল পড়ে গেল পুরো অফিসেই; ওদিকে ইকবাল তখন নিস্পৃহ দৃষ্টিতে সব চেয়ে দেখছে। জঙের সাংবাদিকরা তার ইন্টারভিউ নিল। সে কীভাবে খুন করত, মৃতদেহ কীভাবে গুম করে দিত- সব কিছুই তারা রেকর্ড করে নেয়। অবশেষে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। আসলে ইকবালই চাইছিল তার সব কুকীর্তি মিডিয়ায় প্রচারের আলো পাক, এরপর সে পুলিশের কাছে যাক। এই রেকর্ড পরবর্তীতে আদালতে তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
সিরিয়াল কিলার জাভেদ ইকবালের বিচার নিয়ে মিডিয়াগুলোর আগ্রহের কোনো কমতি ছিল না। দেশের বিভিন্ন শহর থেকে বাবা-মায়েরা ছুটে আসছিলেন এই নরপশুকে একনজর দেখার জন্য, যাদের হাতে তাদের ছেলে নিহত হয়েছে বলে তারা ধারণা করছিলেন। ইকবালের উপর তাদের ক্ষোভ এতটাই টগবগ করে ফুটছিল যে তার নিরাপত্তায় এক ডজন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল।
পুলিশ সর্বমোট চারজনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনে। প্রথমেই ছিল জাভেদ ইকবাল। আরও ছিল তার তিন সহযোগী। এর মাঝে কেবলমাত্র সাজিদই ছিল প্রাপ্তবয়স্ক, বাকি দুজন অপ্রাপ্তবয়স্ক।
আদালতে পুলিশ ইকবালের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে তার নিজের দেয়া সাক্ষ্য, তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা জামাকাপড়, মানব দেহাবশেষ উপস্থাপন করে। পরবর্তী চার সপ্তাহ ধরে তার বিভিন্ন কুকর্মের সাক্ষী শতাধিক ব্যক্তি আদালতে হাজিরা দেয়। যে রিকশায় চড়ে ইকবালের সহযোগীরা এসিডের ড্রামে রাখা মানব দেহাবশেষ নদীতে নিয়ে ফেলেছিল, তাকেও খুঁজে বের করে পুলিশ। জমায়েত হওয়া বাবা-মায়েরাও তাদের সন্তানদের কাপড়চোপড় শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
ইকবালের পক্ষে লড়া আইনজীবীরা নিয়ে এসেছিল অদ্ভুত এক দাবী। তাদের মতে, যেসব ছেলে ঘর থেকে পালিয়ে যায়, তাদের ইস্যুকে সরকারের নজরে আনতেই এই নাটক সাজিয়েছে জাভেদ ইকবাল। যে জামাকাপড়গুলো তার বাসায় পাওয়া গেছে, সেসব নাকি আসলে সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট থেকে কেনা!
অবশেষে ২০০০ সালের ১৬ মার্চ প্রায় এক মাস বিচারকার্য চলার পর রায় হলো। বিচারক জানালেন, জাভেদ ইকবাল আর সাজিদকে জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। এরপর তাদের মৃতদেহ কেটে ১০০ টুকরা করে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সামনে এসিডে গলানো হবে!
দুজনকেই এরপর ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজনে স্থানান্তর করা হয়। ইকবাল অবশ্য বেশ নির্বিকার ছিল। সে বিশ্বাস করত, কোনো বিদেশী এনজিও তাকে ঠিকই উদ্ধার করবে। এমনকি সে এটাও মনে করত যে, স্রষ্টা তাকে এক বিশেষ উদ্দেশ্যেই বেছে নিয়েছেন!
রায় ঘোষণার এক বছর পর জাভেদ ইকবাল এবং সাবির নামে তার এক সহযোগী জেলখানাতেই আত্মহত্যা করে। পাশাপাশি সেলেই ছিল তারা। পরনের শার্টকেই দড়ির মতো পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ে তারা।
ইকবালের পরিবার ও তার আইনজীবীদের দাবি, পুলিশই ইকবালকে হত্যা করে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছে। কারণ, ইকবাল এমন কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার নাম ফাঁস করতে চেয়েছিল, যারা বিভিন্ন সময় তার দেয়া পার্টিতে অংশ নিয়েছিল, সেখানে লিপ্ত হয়েছিল শিশুকামেও।
আজ পর্যন্ত তারা বিশ্বাস করে, ইকবাল আসলে কোনো খুনই করেনি। বরং কুখ্যাতি ও প্রচারণা পাওয়ার লোভেই সে এই ঘটনাগুলোকে এমনভাবে সাজিয়েছিল, যা তাকে বিচারের কাঠগড়া পর্যন্ত নিয়ে যায়।