চায়ের ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
এক কাপ চা, কিন্ত তাকে নিয়ে বলা যাবে এক লক্ষ লাইন! কারও কাছে মাথাব্যথার টনিক, আবার কেউ কেউ একে মনে করেন মন খারাপের দাওয়াই। কেউ কেউ আড্ডাচ্ছলে কারণে-অকারণে একটা কাপ হাতে নিয়ে চুমুকের পর চুমুক দিতে দিতে উত্তপ্ত রাখেন চিবুক। আবার, এমন মানুষও আছে যাদের কাছে সূর্যাস্তে নয়, সন্ধ্যা নামে চায়ের কাপে। কোথাও মিটিং কিংবা সৌজন্য সাক্ষাতে গিয়েছেন, সব কিছুর সঙ্গে কিছু না হোক, দুটো বিস্কুট আর এক কাপ চা থাকবেই। ওদিকে চায়ের প্রতি অন্যরকম ভালো লাগাকে উপজীব্য করে তৈরি হয়েছে জনপ্রিয় বাংলা নাটকও।
কখনও কি ভেবে দেখেছেন- আমাদের দেশে চায়ের তুলনায় অনেক বেশি জন্মানো লেবুর শরবত, খেজুরের রস কিংবা আখের রস কেন এতটা জনপ্রিয় নয়! কিংবা, অন্য কোনো ফলের রসও চাইলে চায়ের জায়গা নিতে পারত! কিন্তু কেন এই চা? কবে থেকে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠলা চা পানে? তারপর কেন তাদের এক কাপ চা না হলে আর চলেই না?
শুরুটা সেই চীন দেশেই। চীনেই প্রথম ব্যবহার শুরু হয়ে থাকলেও গাছটি চীন ও জাপানে জন্মাত। ঐতিহাসিক আমল থেকে ভারতে চা গাছ জন্মালেও তার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। শুরুতে নানা ওষধি গুণের জন্য চা পাতা ব্যবহার হলেও গাছের প্রকৃত গুণাগুণ সম্পর্কে ভারতীয়দের তেমন ধারণা ছিল না। তাই অপেক্ষাকৃত জংলা গাছ হিসেবে সবার চোখের আড়ালে রয়ে যায় চা।
চীনে চায়ের ব্যবহার শুরু হয় আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে। তখন চীনের একজন রাজার নাম ছিল শেন নঙ। কিংবদন্তি বলছে, এক গ্রীষ্মের বিকালে খাবার তৈরির জন্য শেন নঙের চাকর বাকরেরা পানি গরম করছিল। তখন একটা গাছের তলায় বসে অলস সময় পার করছিলেন শেন নঙ।
অজ্ঞাতনামা কোনো এক গাছের কয়েকটা পাতা এসে পড়ে সেই গরম পানির মধ্যে। এই পাতা পড়ার ফলে মুহূর্তেই বদলে যায় পানির রঙ। ধীরে ধীরে লিকার ছড়িয়ে প্রায় বাদামি রুপ ধারণ করে পানিটি। বিশ্রামরত রাজার মনে ধরে যায় এই রঙ। শুধুমাত্র পানির রঙ দেখে আকৃষ্ট হয়ে তা পান করেন তিনি।
ইতিহাসের শুরুটা এখানেই। কয়েকদিন ধরে অপেক্ষাকৃত অবসাদে ভুগতে থাকা রাজা এই পাতা ফোটানো পানি পান করে অন্যরকম অনুভূতি লাভ করেন। তিনি শারীরিকভাবে বেশ চনমনে ও সতেজ হয়ে ওঠেন। তারপর থেকে ঐ গাছ চিহ্নিত করে তার পাতা ফুটিয়ে পান করতে থাকেন রাজা।
রাজার জন্য এই বিশেষ পানীয়টি তৈরি করতে আরও সক্রিয় হন তার বাবুর্চিরা। তারা এই পানীয়তে চা পাতার পাশাপাশি মিষ্টি ভাব আনতে চিনি যুক্ত করেন। সেই সঙ্গে নানারকম ফলের রস আর মসলাও যুক্ত হতে থাকে এতে। অনেকে নানা পরীক্ষাও চালাতে থাকে এই পানীয় নিয়ে।
অদ্ভুত রকম তিতা স্বাদের একটা পাতা হঠাৎ এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠবে- খোদ চীনেও তা কেউ ভাবতে পারেনি। যা-ই হোক, ইংরেজি ‘টি’ শব্দের উৎস মান্দারিন ভাষায়। তাদের ভাষায় তিতকুটে এই গুল্মকে বলা হতো ‘টেয়’, যার থেকে ইংরেজি শব্দটির উদ্ভব। জাপানিরা একে বলত ‘চিয়া; এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহৃত ‘চা’ শব্দের উদ্ভব এই ‘চিয়া’ থেকেই হয়ে থাকতে পারে। জনপ্রিয় গল্পগুলোর বাইরে আমাদের একটু খোঁজ করা দরকার গবেষকরা কী বলেছেন সেই প্রসঙ্গে। আর শুরুতেই বলতে হয় গৌতম ভদ্রের কথা।
ভারতের সাবঅলটার্ন ইতিহাস গবেষক দলের অন্যতম সদস্য গৌতম ভদ্র তাঁর ‘’From an Imperial Product to a National Drink Culture of Tea Consumption in Modern India’ শীর্ষক গ্রন্থে চায়ের ইতিহাস নিয়ে অনেক মজার তথ্য নথিভুক্ত করেছেন। তবে চায়ের ব্যবহার নিয়ে প্রথম বই ‘দুয়াকু’ লিখিত হয় যীশুখ্রিস্টের জন্মেরও আগে; ৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। চায়ের ভেষজ গুণাগুণ ও ব্যবহারবিধি নিয়ে চতুর্থ শতকে গ্রন্থ রচনা করেন কিয়েন লুঙ।
যা-ই হোক, শাং শাসনামলে (৬১৮-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) চা চীনের জনপ্রিয় পানীয় হিসেবে আবির্ভূত হয়। তখন লু ইয়ু চীনে চায়ের ইতিহাস, প্রস্তুতপ্রণালি, ব্যবহার নিয়ে একটি বড় কলেবরের বই লিখেছিলেন। তার মতে
চা বদমেজাজি আর ঘাউড়া লোকদের মনের অস্থিরতা দূর করে, শরীরের ক্লান্তি তাড়াতেও এটা কাজে দেয়। সেই সঙ্গে ঘুম ঘুম ঢুলু ঢুলু চোখ থেকে মুক্তি পেতেও এটা কার্যকর। কারণ চা পান করলে দ্রুত শরীরের ঝিমুনিভাব চলে যায়, শরীর হয়ে ওঠে চাঙ্গা, সতেজ ও কর্মক্ষম।
প্রথমবারের মতো চীন থেকে জাপানে যাওয়ার জন্য চায়ের অপেক্ষাপর্ব অনেক দিনের। আনুমানিক ১৪ শতকে বৌদ্ধ ভিক্ষু দেঙয়ো দাইশাই জাপানিদের চায়ের ব্যবহার শেখান। চীনারা পানীয় হিসেবে চায়ের ব্যবহার শিখে গেলেও জাপানিরা তাদের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাপ্ত চা গাছকে এর আগে কাজে লাগাতে পারেনি। তাই দেংয়ো দাইশাই আগে থেকে জাপানে জন্মানো চায়ের গাছগুলোর পাতা থেকেই তাদের চায়ের ব্যবহার শিখিয়ে থাকতে পারেন বলে মনে করা হয়।
ভারতে প্রথম চা প্রস্তুত করা হয় আনুমানিক ১৮৩৯ সালের দিকে। বাংলাদেশ তথা তখনকার পূর্ববঙ্গে প্রথম চা তৈরি হয় ১৮৫৪ সালে। সিলেটের মালনীছড়া টি এস্টেটে এই চা উৎপাদনেও কিন্ত ভারত থেকে পনের বছর বেশি সময় লেগে গিয়েছিল। তবে উনিশ শতকের চা শিল্প শুধু ব্রিটিশদের নিজেদের ব্যবহার ও বাণিজ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখন ভারতীয়দের মধ্যে যথেষ্ট পরিচিতি পায়নি চা।
ভারতের মানুষ চা পানে অভ্যস্ত হয় বিশ শতকের শেষাংশে। তখন ভারতীয়দের মধ্যে চা-কে জনপ্রিয় করায় ভূমিকা রাখে ‘ইন্ডিয়ান টি চেজ কমিটি’। তাদের অর্থযোগান জুটতো ভারতবর্ষের চা রপ্তানিতে আয়কৃত কর থেকে। তাদের মূল কাজ ছিল চা পানের সুফল সম্পর্কে মানুষকে বোঝানো।
গ্রামোফোনের রেকর্ড তৈরি করে বিজ্ঞাপন প্রচারের পাশাপাশি টি চেজ কমিটির কমিশনার ঘোষণা করেন, “ভারতবাসী চা পানের অভ্যাস গড়ে তুললে অসুখ-বিসুখ এবং মৃত্যুহার কমবে। তাদের কর্মক্ষমতা বেড়ে যাবে।” অন্যদিকে, চায়ের জন্য পানি ফোটানোর ফলে তা জীবাণুমুক্ত হয়ে যায় বলেও বিস্তৃত প্রচার-প্রচারণা চলে তখন।
তবে চায়ের উপকার বুঝিয়ে খুব একটা লাভ হয়নি। তাই ব্যবসার প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে ভারতজুড়ে বিভিন্ন বড় শহরে চায়ের দোকান বসানো হয়। আদতে দোকান হলেও তারা শুরুতে মুফতে চা বিলাতে থাকে। কিছুদিন ফ্রি চা খাওয়ার ফলে অনেকেই অভ্যস্ত হয়। তারপর তারা চায়ের নামমাত্র মূল্য নির্ধারণ করে।
এই নামমাত্র মূল্যে চা কিনে খাওয়ার লোকের অভাব ছিল না। পাশাপাশি শুরু হয় গান, সিনেমা, ইনডোর গেমস, আর গ্রামোফোন বাজিয়ে চা বিক্রি। টি চেজ কমিটির দাবি, ভারতে টি স্টল জনপ্রিয় করার জন্য তারা ৭০০ গ্রামোফোন, আট হাজার রেকর্ড, ২০০ হারমোনিয়াম ও ইনডোর গেমসের টেবিলকে কাজে লাগায়। বলতে গেলে এর প্রভাবে নানা স্থানে জায়গা করে নিতে থাকে চায়ের দোকান।
ব্যবসার ক্রমাগত প্রসার বিভিন্ন কৃষি বিপনন স্থান, কলকারখানা, খনি, বাজার কিংবা সেনাছাউনি প্রতিটি জায়গায় অনেক সহজলভ্য করে দেয় চায়ের সরবরাহ। এমনকি, পাটকল ও চিনিকলগুলোতে রাতে কাজ চলার সময় চায়ের দোকান খোলা থাকত। বিভিন্ন শিল্পকারখানা অঞ্চলের একটি চায়ের দোকানে সেই সময়েও মাসে কমবেশি প্রায় ১ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখেছে।
১৯২০-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারতের নানা স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন মার্ক থর্নহিল। তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে কলকারখানা ঘুরে দেখেন। তাঁর প্রখ্যাত ‘Haunts and Hobbies of an Indian Official’ শীর্ষক গ্রন্থে ‘ভারতীয় শ্রমিকদের নতুন অভ্যাস হিসেবে চা পান’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। তার মতে, অনেকের চায়ের দোকান সারা দিন, এমনকি রাতেও খোলা থাকে। সেখান থেকে শ্রমিকরা তাদের ইচ্ছামতো চা পান করতে পারে। শ্রমিকদের অতিরিক্ত চা আসক্তি থেকে নিবৃত করতে কিছু কারখানায় চায়ের দোকানে আসার সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে- অনেক কলকারখানায় চা পানের জন্য হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের অনুসারী শ্রমিকদের জন্য দুটি আলাদা ঘর ছিল। অন্যদিকে, রান্নাঘর এক হলেও সেখানে চা বানানোর জন্য একজন উচ্চবর্ণের হিন্দু ও একজন মুসলমান কাজ করতেন।
চা পানের ক্ষেত্রে ধর্ম ও জেন্ডারের বৈষম্য একটু অন্যরকম হয়ে দেখা দিয়েছিল। পুরুষরা দেদারসে চায়ের দোকানে গেলেও নারীরা সেই সুযোগ সেভাবে পেতেন না। অনেক নারী দোকানের মতো নিজ ঘরে চা প্রস্তুত শুরু করেন। তার প্রস্তুতকৃত চা পরিবারের সবাই, এমনকি শিশু-কিশোররাও পানের সুযোগ পায়। অন্যদিকে, পুরুষদের মতো কোনো নারী চায়ের দোকানে গিয়েছেন এমনটা জানাজানি হলে চরম অসম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হতো সেটা। চা পানের ধর্মীয় ইতিহাস হিসেবে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের চা পানে কিছুটা পার্থক্য ছিল।
বিশেষত, চায়ে গরম মশলা, লেবু কিংবা আদার ব্যবহার মুসলিম সম্প্রদায় বেশি করেছে। তবে তারা দুধ চা একেবারেই পছন্দ করতো না। অন্যদিকে, হিন্দুদের প্রথম পছন্দ ছিল দুধ কিংবা মালাই মেশানো সুস্বাদু চা। তারা যেমন কড়া লিকারে দুধ দিয়ে চা পান করতে পছন্দ করেছে, তার বিপরীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের পছন্দের শীর্ষে ছিল হালকা লিকার ও অল্প চিনির রং চা। সেখানে কেউ কেউ আদাসহ বিভিন্ন মশলা কিংবা লেবু ব্যবহার করেছে।
ওষুধ হিসেবে মধু, তুলসি, আদা এবং বাসকের রস মিশ্রিত চা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই পান করেছে। শুরুর দিকের ভারতে বর্ণপ্রথার প্রভাবে কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চা নিয়ে কিছু কুসংস্কার ছিল। তাই তারা বাদে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে চা দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়।
হিন্দুরাও একসময় ব্যাপকভাবে চা পান শুরু করেন নানা সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে। আর ঠিক তখনই চায়ে দুধ মিশিয়ে পান করার রীতি হিন্দুদের হাতেই জনপ্রিয়তা পায়। মানুষের আগ্রহ ও জনপ্রিয়তা আমলে নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনগুলোর যাত্রীছাউনিতে চায়ের দোকান গড়ে ওঠে অনেক। আর তারাই পুরো ভারতে চা পানের সংস্কৃতি বিকাশে ভূমিকা রাখে।
ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্যানশন বোর্ড ও টি চেজ কমিটি চা কোম্পানিগুলোকে রেলস্টেশনে চায়ের ক্যান্টিন স্থাপনের পরামর্শ দিলে তারা গুরুত্ব দিয়ে তা আমলে নেয়। প্রথমদিকে ট্রেনের যাত্রীদের এসব ক্যান্টিনে বিনামূল্যে চা পান করানো হয়। পাশাপাশি রেলস্টেশনে টাঙানো হয় সুদৃশ্য সব বিজ্ঞাপন।
এ সময় ফ্রিতে বিতরণ করা হয় চা তৈরির নির্দেশিকা। ফলে দোকানের বাইরে অনেকে এই চা নিজ বড়িতে তৈরি করেও পান করতে শুরু করে। তাই ১৯১৫ সালের দিকে যেখানে কলকাতায় চায়ের দোকানের সংখ্যা ছিল ৪৪৪টি, পরের বছরের শেষ নাগাদ দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১ হাজার ১২৪টি। এর পর ১৯১৭ সালের শেষে চায়ের দোকানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪২০টি। এই চিত্রের সঙ্গে মেলানো যায় ভারতের অন্যান্য বড় শহরকেও।
সরাসরি চায়ের পাতা বিক্রি চায়ের ব্যবসায় নতুন জোয়ার আনে। ১৯১৮ সালের গোড়ার দিকে চায়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। ওদিকে, ১৯২০ সালের জুলাই নাগাদ ভারতজুড়ে সাড়ে সাত হাজার দোকানে প্যাকেটে চা বিক্রি শুরু হয়। তার সূত্র ধরে টি চেজ কমিটি ৭০ লাখ খামে ভরা প্যাকেট সরবরাহ করে। তাই একসময় কলকাতার কর্নওয়ালিস কিংবা হ্যারিসন রোডে হাঁটলে সবার আগে যা চোখে পড়তো তা হচ্ছে একটি টি স্টল।
সাবঅলটার্ন ইতিহাসের পুরোধা ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র মনে করেন, “চা পাতার ব্যবসা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরিচয়ে রূপান্তরিত হয়। এই চা তাদের ক্ষমতা, আধিপত্য ও সংস্কৃতিক জগতের মনোদৈহিক আধিপত্যবাদকে প্রকাশ করত।” তাই ১৯ শতকজুড়ে চায়ের প্রধান ক্রেতা ব্রিটিশরা হলেও ধীরে ধীরে জনগণ তাতে সম্পৃক্ত হয়েছিল। এ সময় বিখ্যাত হয়ে ওঠে দার্জিলিংয়ের ‘ডারলিংটন টি’। অন্যদিকে, আসামের কাছাড় অঞ্চলের সঙ্গে মিল রেখে ঐ অঞ্চলের চা পরিচিতি পায় ‘ক্যাচার টি’ নামে।
১৯২২ সালে লিপটন চা কোম্পানি প্রকাশ করে একটি ক্যালেন্ডার। সেখানে একজন ইংরেজ ডিউকের একটি রঙিন ছবি ছিল। তাকে যুদ্ধে যাওয়ার পোশাকে ঘোড়ার পিঠে চড়ে থাকা অবস্থায় দেখা যায়। তারপর চা হয়ে ওঠে আভিজাত্যের প্রতীক।
বিভিন্ন সিরামিক এবং মূল্যবান ধাতুর তৈরি চায়ের কাপ, টি-পট, কেটলি কেনা ও তৈরির ধুম পড়ে অভিজাত হওয়ার অভিপ্রায়ে আগ্রহী ভারতীয়দের মধ্যে। বিশেষত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর শোষক জমিদারদের আভিজাত্য আর বাহাদুরি প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে চায়ের সেট। তারা সোনার মতো মূল্যবান ধাতুর তৈরি কাপ ও কেটলি, মার্বেল পাথরের টেবিল ব্যবহারের চেষ্টা করে। কেউ কেউ চাপের কাপে মূল্যবান রত্নপাথর যুক্ত করে। সেই সঙ্গে তৈরি করা হতে থাকে মূল্যবান সব টি টেবিল এবং চেয়ার।
১৯২০ সালের দিকে লিপটন চায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নতুনভাবে চা বাজারে আনে ব্রুক বন্ড। তাদের চা তখন বাজারে আসে টিনের কৌটায় করে। লিপটনকে টেক্কা দিতে তারা ভারতজুড়ে প্রচারণা চালায়- চা ঠিক রাখার একমাত্র উপায় এমন টিনের কৌটা। তাদের প্রচারণা লিপটনের ব্যবসায় বেশ ক্ষতি করে।
মজার ব্যাপার হলো- তাদের থামাতে নতুন পথ বেছে নেয় লিপটন। তারা প্রচার করে, “আমরা চায়ের বিজ্ঞাপন দেই, টিনের পাত্র বিক্রি আমাদের কম্মো নয়।” কার বাজার কতটুকু এগিয়ে গেল সেটা বড় বিষয় নয়, তবে লিপটন আর ব্রুক বন্ডের দ্বৈরথ ভারতের চায়ের বাজার অনেক চাঙ্গা করে। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক বিজ্ঞাপনে অনেক এলাকা ছেয়ে যাওয়ায় মানুষ চায়ের ব্যাপারে নানা কিছু জানতে পারে।
ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রতীক হয়ে ওঠায় স্বদেশী আন্দোলনের সময় চা বিরোধী অবস্থান নিতে দেখা যায় অনেক বিপ্লবীকে। কারণ, চা বাগানের শ্রমিকদেরও ইংরেজরা নিপীড়ন করেছে নীলকরদের মতো। তাই ১৮৮০-এর দশকে চা বাগানে শ্রমিকদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে সেখানে সমর্থন যোগান প্রখ্যাত ডাক্তার সুন্দরীমোহন দাস (১৮৫৭-১৯৫০)। তার সঙ্গে যুক্ত হন জাতীয়তাবাদী নেতা কৃষ্ণ কুমার মিত্র (১৮৫২-১৯৩৬)। তারা চা-শ্রমিক নিপীড়নের প্রতিবাদে চা পান ত্যাগ করেন।
১৯৩০ সালে শুরু হয় তামিলদের বিশুদ্ধতাবাদী আন্দোলন। তারা স্থানীয় পানীয়ের পরিবর্তে চা পানকে নিরুৎসাহিত করে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় চা পানের ঘোরতর বিরোধিতা শুরু করেন। তিনি প্রচার করেন- চা পান মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করে। এতে ক্ষুধা নষ্ট হয়। তিনি একটি ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন ‘পাক্কা চা খোর’ নামে। পাক্কা চা-খোরের টেবিলে একটি বড় চায়ের মগ। তার হাতে এক কাপ চা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পায়ে ছেড়া-ফাটা জুতা, ছেড়া পোশাক, আর চারদিকে ছড়ানো অসংখ্য সিগারেটের খোসা। সব মিলিয়ে চায়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এবং কাঠবলদ কিছিমের লোকের প্রতিচ্ছবি সেই ‘পাক্কা চা খোর’।
প্রিয়-অপ্রিয় নানা কথার দোলাচলে চা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রতিচ্ছবি। একেকটি চা বাগান ছিল অত্যাচার-নিপীড়নের হিংস্র আদিমতাকে নতুন করে খাঁচায় পুরে প্রদর্শন করার মতো ডিসপ্লে সেন্টার। অধিক পরিশ্রমে কম মজুরি, শ্রমিক অধিকার হরণ করা থেকে শুরু করে নারী শ্রমিকদের যৌন নিগ্রহ- কী ঘটেনি এসব চা বাগানে! তবুও ধীরে ধীরে শতবর্ষ ব্যবধানে চা হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আর সব খাবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ আর জনপ্রিয়। আর প্রদীপের নিচের অন্ধকারটা সেখানেই। হয়তো সেজন্য এই একুশ শতকে এসেও চা বাগানের শ্রমিকরা আন্দোলন করছে শুধুমাত্র তিনবেলার ক্ষুধার অন্ন যোগাতে।
সুলেখক এবং ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার ‘ইকোনমিকস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন, “প্রতি পাঁচ বছরে চা পানকারীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে।” এই নিত্যনতুন চা খোরের উদ্ভব তাকে কতটুকু উপকৃত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা বলা কঠিন, তবে চা বাগানের মালিকদের ব্যবসা যে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল তা বলার অপেক্ষা অপেক্ষা রাখে না।