উসমানী থাপ্পড় নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
শক্তিশালী বহুজাতিক ও বহুভাষিক সাম্রাজ্যের কথা বললে ইতিহাসের পাঠকমাত্রই দুটি সাম্রাজের দিকে ইঙ্গিত করেন। তার প্রথমটি অবশ্যই উসমানীয় সালতানাত, আর দ্বিতীয়টি ভারতবর্ষের মোগল সাম্রাজ্য। ভৌগোলিক বিস্তৃতি হিসাব করতে গেলে দক্ষিণ-পূর্ব সীমায় ইউরোপ, উত্তরে রাশিয়া আর কৃষ্ণ সাগর, পশ্চিম এশিয়া, ককেসাস, উত্তর আফ্রিকা থেকে হর্ন অব আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আরব অঞ্চলে বিস্তৃত বিশাল সাম্রাজ্য ছিল উসমানীয়দের।
মার্ভ থেকে আনাতোলিয়া কতটা পথ? প্রথম উসমানের বাবা আর্তুরুল গাজি বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে সেলজুকদের সাহায্য করার জন্য ৪০০ ঘোড়সওয়ার নিয়ে এসেছিলেন এ পথেই। সঙ্গে নিয়ে আসেন একবুক স্বপ্ন; তার স্বপ্ন সাম্রাজ্য বিস্তৃতির পাশাপাশি ডালপালা মেলে দিয়েছিল অনেক কিংবদন্তীরও। অনেকেই প্রশ্ন করেন- উসমানীয় থাপ্পড় তথা অটোম্যান স্ল্যাপ কি সেসব কিংবদন্তীরই কোনো একটা? নাকি বাস্তবেই দুর্দান্ত কোনো টেকনিক ছিল? এটা কি শাওলিন টেম্পলের মঙ্কদের ব্যবহৃত বিভিন্ন টেকনিকের মতোই জবরদস্ত কোনো বিষয় ছিল? নাকি আমাদের দেশে স্কুলশিক্ষকদের দেওয়া থাপ্পড়ের মতোই কোনো নিয়মিত ঘটনা?
জনপ্রিয় কাহিনি হচ্ছে- উসমানীয় সৈন্যরা, বিশেষ করে জেনিসারি বাহিনী এই টেকনিক ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত ছিল। তারা কোনো জায়গায় বিপদে পড়লে তো অবশ্যই, সেই সঙ্গে আক্রমণাত্মক টেকনিক হিসেবেও এই থাপ্পড়ের ব্যবহার করেছে (02:56) বলে কেউ কেউ দাবি করেন। এর আবার একটা গালভরা নামও দেওয়া হয়েছিল ওসমানলি তোকাদ (Osmanlı Tokad)। এটা ক্ষেত্রবিশেষে অনেকটা গালির মতোও ব্যবহার করা হয়েছিল। আর সেখানে হাতের পাঁচটি আঙুলকে বলা হতো পাঁচ ভাই তথা বেস কারদেশ (Bes Kardes)।
যা-ই হোক, থাপ্পড় নিয়ে কাহিনি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল কীভাবে? নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নাটকগুলো আমাদের মনে থাকার কথা। এক নাটকে আমরা দেখি একজন অভিনেতা কীভাবে ঠাস করে থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেন। তারপর ঐ দাঁত ফেলা নিয়ে গ্রামজুড়ে কত গল্প, কত কাহিনী, এমনকি তা নিয়ে গানও বেঁধে ফেলে বাউলেরা। অন্য নানা নাটকেও এর ব্যবহার ছিল বিচিত্র।
বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্র কিংবা নাটকেও আমরা কম-বেশি থাপ্পড়ের ব্যবহার দেখি। সংলাপের পাশাপাশি বিভিন্ন গালির ব্যবহার সহযোগেও সরাসরি থাপ্পড়ের কথা থাকে। কেউ কেউ বলেই বসেন, “থাপড়ায়ে তোর দাঁত ফেলায় দেবো।” কিংবা হাস্যরসাত্মক আক্রমণ হিসেবে এর ব্যবহার ক্ষেত্রবিশেষে ভয়াবহ। তাই বলে তুর্কি মার্শাল আর্ট কিংবা সেনাসদস্যদের প্রশিক্ষণে আসলেই কি এই থাপ্পড়ের অস্তিত্ব ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্রের দেখা মেলেনি।
প্রচলিত কাহিনিতে বলা হয়, উসমানীয় থাপ্পড় দেওয়ার ক্ষেত্রে হাতের দুই পাশ ব্যবহার করা হয়। খুব দ্রুতগতিতে হাতের দুই পাশ দিয়ে এই চড় মারা হতে পারে। ঘাড়ের পেছনে যুৎসই আঘাত পড়লে এই থাপ্পড় খেয়ে অনেকের মৃত্যুও হতে পারে। মনে করা হয়, উসমানীয় জেনিসারি সৈন্যরা যখন অস্ত্র বাদেই প্রশিক্ষণ নেয়, তখন এই থাপ্পড় শেখানো হতো তাদের। কিংবা তাদের হাতিয়ার ভেঙে যাওয়ার পর শেষরক্ষার প্রয়োজনে তারা এই থাপ্পড় মারার চেষ্টা করতো।
কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, উসমানীয়রা কাউকে অপমান করার জন্য তাকে থাপ্পড় দেওয়াটা পছন্দ করতো বেশি। তারা মনে করতো, ঘুষি মারা দুর্বল মনের পরিচয়। তেমনি, শত্রুপক্ষের কোনো যোদ্ধাকে দুর্বল এবং অদক্ষ প্রমাণ করার জন্য তারা তলোয়ারের ধারালো প্রান্তের বদলে উল্টো পিঠ দিয়ে আঘাত করত। উসমানীয় সৈন্যরা তাদের মহাশত্রুকে অপদস্ত করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হলেও এভাবে তলোয়ারের উল্টোপিঠ দিয়ে আঘাত করেছে।
অন্যদিকে, উসমানীয় সমাজে বড়দের কারও সঙ্গে বেয়াদবি করলে তার বিচার করতে গিয়েও এই থাপ্পড়ের ব্যবহার ছিল। সেখানে অপেক্ষাকৃত বর্ষীয়ান ব্যক্তি সশব্দে একটা থাপ্পড় দিয়ে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে ঐদিনের মতো বিচার শেষ। এরপর আর কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। তবে শত্রুপক্ষেকে ঘায়েল করার ক্ষেত্রে উসমানীয় সৈন্যরা বিশেষ টেকনিক হিসেবে এটা ব্যবহার করেছে অনেক ক্ষেত্রে। আর সেখান থেকেই এই কাহিনি নানাদিকে ডালপালা মেলতে থাকে।
এখান থেকে জানা গিয়েছে মজার তথ্য। দাবি করা হয়- উসমানীয় সৈন্যরা তাদের থাপ্পড়কে শক্তিশালী এবং ভয়ানক করে তুলতে অনেক প্রশিক্ষণ নিত। এজন্য তারা গাছের গুঁড়ির মধ্যে থাপড়া-থাপড়ি করত, মার্বেল পাথরের পিছলা পিঠে থাপড়ে থাপড়ে তাদের হাত শক্ত করত। অনেকে মুঠোর মধ্যে বালু নিয়ে হাতের শক্তিমত্তা বাড়াত। কেউ কেউ বালুভর্তি ছালার বস্তা তথা পাঞ্চিং ব্যাগের সেকেলে ভার্সনের উপর বক্সিং মেরে মেরেও হাতের দুই পিঠ শক্ত করত। তবে এসবের সত্যতা নিয়ে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হবার উপায় নেই। আর ইতিহাস হিসেবে যেটুকু পাওয়া যায়, সেখানে খালি হাতে আত্মরক্ষার বাইরে আর কিছুই নেই।