বেগুনের ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
মূল্যগত দিক থেকে উত্থান-পতনের ডামাডোলে আর কোনো ফল কিংবা সবজি এতটা আলো ছড়াতে পারেনি। কারণ, ফি বছর রমজানের শুরুতেই একটা কথা লোকমুখে শোনা যাবেই, আর তা হচ্ছে- “বেগুনের দাম বেড়েছে!”
বাংলাদেশের বাস্তবতায় রমজানের সিয়াম সাধনা, ছোলাবুট, জিলাপি আর বেগুনি- এ যেন সমার্থক। তাই কেউ চাইলে সাহিত্যিক টান দিয়ে বলে বসতেই পারেন, “চাঁদ উঠুক আর না-ই উঠুক, বেগুনের দাম বেড়েছে, সুতরাং রমজান সমাগত!”
গণমানুষের প্রিয় সবজি, মাঝে মাঝে কারণে-অকারণে জনমনে বিভ্রান্তিও ছড়ায়। কারণ, এর নামটিই যে এমন! ‘বেগুন’ নামটি শোনার পর অনেকেই ভুল ভেবে বসতে পারেন- এই জিনিস মানুষ খায় কেন, যার নামই বেগুন! সুতরাং, এর তো গুণই নেই!
খাবার হিসেবে বেগুন সম্পর্কে খোঁজ করতে গেলে এর স্বাদের পাশাপাশি ঐতিহাসিক দিক সম্পর্কেও ধারণা রাখা জরুরি। সহজভাবে বললে- কোন সভ্যতার সময় থেকে মানুষ এই বেগুনকে তার খাদ্য তালিকায় স্থান দিয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করাটা জরুরি। আমাদের জন্মস্থান বাংলাদেশ হিসেবে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, “বাংলাদেশের মানুষ কতদিন আগে থেকে এই বেগুনকে তাদের পাতে ঠাঁই দিয়েছে?”
স্বাদে, সুগন্ধে, সাধে-আহলাদে বেগুন বাঙালিকে দিয়েছে এক অনির্বচনীয় আনন্দ। তবে আকৃতিগত ভিন্নতা নিয়ে মতদ্বৈততা দেখা দিতে পারে এর ব্যবহার নিয়ে। বিশ্বের অনেক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, আবেদন সৃষ্টিকারী ভাস্কর্য আর চিত্রকর্ম থেকে প্রমাণ মেলে বেগুনের সঙ্গে স্বমেহনের নানাবিধ মুখরোচক গল্পের সম্পর্কের।
বেগুনের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে অনেকগুলো মত সামনে আসে। কেউ দাবি করেন, প্রাচীন চীন থেকে এর সূত্রপাত। অনেক ঐতিহাসিক প্রাচীন গ্রিস, রোমান অঞ্চল, এমনকি নীল নদের তীরবর্তী মিসরেও প্রথম বেগুন চাষের সূচনা বলে দাবি করেন। মায়া ও ইনকা সভ্যতার বেগুন চাষকেও সম্পর্কিত করা হয়। তবে লিখিত সূত্র হিসেবে সবার আগে বেগুন চাষের সত্যতা মিলেছে ভারতবর্ষ থেকে।
বিভিন্ন সংস্কৃত তথ্যসূত্র বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে গিয়ে জানা যায়, ভারতবর্ষে বেগুন চাষ শুরু হযরত ইসা (আ)-এর জন্মেরও বহু বছর আগে। ভারতবর্ষে জংলি গাছ থেকে বেগুনকে চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের দিকে। সেখানে বেগুন সম্পর্কে নানাবিধ নাম ও উপমার ব্যবহার থেকে অনুমান করা যায়- একাধারে ওষুধ ও খাবার হিসেবে এই সবজি কতটা জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
সুদূর অতীতের ভারতবর্ষে বেগুনের প্রচলিত একটি নাম ছিল ‘রাজকুষ্মাণ্ড’। যাঁদের সংস্কৃত, এমনকি বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে একটু ধারণা আছে, তারা সহজেই বুঝতে পারবেন যে এর অর্থ রাজারা যে কুমড়া খেয়ে থাকেন। অর্থাৎ খুবই সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ একটি সবজি।
‘শাকাশ্রেষ্ঠাং’, অর্থাৎ সবজির মধ্যে শ্রেষ্ঠ- এটাও বেগুনের আরেকটি নাম। আর সেই দিক থেকে দেখতে গেলেও বেগুন মহাগুরুত্বের দাবিদার। ‘নীলফল’ অর্থাৎ যে ফলের বর্ণ নীল। ‘কন্টবৃন্তকী’ বিশেষ ধরনের বেগুন যার বোটার গোড়াতে কিছু কাঁটা থাকে। ‘কন্টলু’ এবং ‘কন্টপত্রিকা’ শীর্ষক নামেও অনেকে বেগুন সম্পর্কে জানিয়েছেন।
নিদ্রাহীনতার থেকে মুক্তি পেতে বেগুনের ভর্তা খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে অনেক তথ্যসূত্রে বেগুনকে বলা হয়েছে নিদ্রালু। আয়ুর্বেদে বেগুনকে ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেখানে সাদা বেগুনকে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় কার্যকর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি, এর শেকড়কে বলা হয়েছে শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তির দাওয়াই। তবে মার্কণ্ডেয় পুরাণের ভাষ্যে বেগুনকে একটা ফালতু খাবার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মূলত নিম্নজাতের মানুষেরা খায়।
কিমি ইয়াওশু নামের এক লিখিত সূত্র থেকে দাবি করা হচ্ছে- বেগুন সবার আগে চীনের মানুষ খাওয়া শুরু করেছে। তারপর বিশ্বের নানা দেশের মানুষ এই সবজিকে তাদের খাদ্য তালিকায় স্থান দিয়েছে। তবে এই তথ্যসূত্র আর তার বাস্তবতা নিয়েও মানুষের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
ঠিক একইভাবে একজন আরব ইতিহাসবিদও দাবি করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে বেগুনের প্রথম চাষাবাদ নিয়ে। তবে তার এই দাবির পক্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ সেভাবে মেলেনি। অবশ্য এই কথাও অস্বীকারের উপায় নেই যে মধ্যপ্রাচ্যে বেগুন ছড়িয়ে পড়ে ৭ম-৮ম শতকে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তারের মাধ্যমেই। পারস্য আর আরবের নাবিকদের হাত ধরে ৮ম শতকের দিকে এই সবজি চলে যায় পূর্ব আফ্রিকাতেও।
ভারতের বিভিন্ন প্রত্নস্থান, যেমন- চন্দ্রকেতুগড়, বানগড় তথা কোটিবর্ষ, তমলুক এবং সোমনাথপুর থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন প্রমাণ করে সেখানে সোলানাম তথা বেগুন জাতীয় উদ্ভিজের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল। তাই বেগুনের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে তার পুরোটাই ভারতীয় না হলেও ভারতীয়রাই বিশ্বে বেগুন চাষের অগ্রপথিক। বেদের ভাষ্য আর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অন্তত তা-ই বলছে।