রোক্সানাকে নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
স্বামীর মৃত্যু তার ভেতরের খুনে সত্ত্বাকে বের করে এনেছিল। তাই তো বিশ্বজয়ী স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার জেনারেলরা যখন তাকে পেতে চাইল, সেই সুযোগে একে একে নিজের পথের কাঁটাদের সরিয়েছেন এই নারী।
নিজের গর্ভের সন্তানকে রাজা বানাতে চেয়েছিলেন। এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে তিনি পুরো রাজরক্ত শেষ করে দিতেও পিছপা হতেন না বলে অভিমত অনেক লেখকের।
কিন্তু কে এই নারী? কার এত খুনে মানসিকতার কথা বলছি আমরা? কেন তিনি এমন হয়ে উঠলেন? শেষ পর্যন্ত কি তিনি নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন? সেসবই জানানো হবে আমাদের এই ভিডিওতে, যার নাম ‘আলেকজান্ডারের রোক্সানা’।
গল্পগাথা ও কল্পকথার কথিত কুহকিনী, প্রাচীন গ্রিক উচ্চারণে নাম যা-ই হোক, সহজভাবে বলতে গেলে রোক্সানা ছিলেন ব্যাকট্রিয়ার রাজকুমারী এবং পরবর্তীকালে বিজেতা আলেকজান্ডারের স্ত্রী। ৩৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার জন্ম সগডিয়ায়। ব্যাকট্রিয়ান অভিজাত অক্সার্টেসের মেয়ে এই রাজকুমারী ৩১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩০ বছরেই পৃথিবী ছেড়ে গেছেন।
আকামেনীয় সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত এ ব্যাকট্রিয় নেতা জীবনভর লড়াই করে গেছেন পারস্যের বিরুদ্ধে। ম্যাসিডোনিয়ার নেতা আলেকজান্ডার একের পর এক ভূখণ্ড দখল করার পর বেসাস পর্যন্ত নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এ সময় রোক্সানার বাবা অক্সার্টেস পারস্যের যুদ্ধবাজ নেতা স্পিটামেনেসের সঙ্গে চুক্তি করে ম্যাসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
তবে আলেকজান্ডারের যুদ্ধকৌশলের সামনে তিনি বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি। সগডিয়ান রকের দুর্গে দিনের পর দিন লড়াই চালিয়ে অবশেষে হার মানতে হয় তাকে। বাইরে থেকে উপযুক্ত সিজ ইঞ্জিন স্থাপন করে আলেকজান্ডারের সৈন্যরা দুর্গের ভেতরে বড় বড় পাথর ও আগুন মাখানো তীর নিক্ষেপ করতে থাকে।
সগডিয়ান রকের দুর্গ দখলে আনতে আলেকজান্ডারের বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়। দুর্গ দখলের পর প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যান দুর্গাধিপতি অক্সার্টেসের মেয়ে রোক্সানার। তিনি তার প্রায় সব জেনারেল ও বন্ধুর নিষেধ উপেক্ষা করে বিয়ে করেন রোক্সানাকে।
ভারত উপমহাদেশের জন্য এ বিয়ের ঘটনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আলেকজান্ডার বিশ্বের নানা দেশ একের পর এক দখল করে গেলেও পাহাড়ি অঞ্চলে নানা ধরনের ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি সগডিয়ান রকের দখল যখন নেন, তখন তার ধ্যান-জ্ঞান সব আবর্তিত হয়েছে ভারত আক্রমণ নিয়ে।
এক্ষেত্রে দুর্গের নেতা ও পরবর্তীকালে তার স্ত্রীর বাবা অক্সার্টেসের প্রতিরোধযুদ্ধ তাকে অনেক আকৃষ্ট করে। তিনি জানতেন, ভারত আক্রমণ করতে গেলে মাত্র চারটি গিরিপথের বাইরে অন্য কোনো মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। পাশাপাশি বিভিন্ন দূতের কাছে তিনি জানতে পেরেছিলেন, আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতের বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা না গেলে কোনোভাবেই ভারতের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্তত খাইবার, বোলান, গোমাল কিংবা তোচির গিরিপথ দিয়েই ভারতে প্রবেশ করা সবচেয়ে সহজ ছিল।
আর এ পথগুলোর কোনো একটা ব্যবহার করতে হলে সবার আগে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হয় হিন্দুকুশ পার্বত্য এলাকার ওপর। তিনি রোক্সানাকে বিয়ের পর সগডিয়ান রকের অভিজ্ঞতা ও আত্মীয়তা দুটোই একসঙ্গে সামনে নিয়ে আসেন। ফলে তার ভারত আক্রমণকারী সেনাদলের অন্যতম নেতৃস্থানীয় পদে আসীন হন অক্সার্টেস। তিনি অক্সার্টেসকে হিন্দুকুশ অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত করেন।
বিয়ের পর স্ত্রীকে খুব বেশি দিন নিজের সঙ্গে রাখতে পারেননি আলেকজান্ডার। তিনি অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হন। এ সময় রোক্সানাকে সুসার একটি দুর্গে নিরাপদে রেখে আসেন তিনি। তারপর তিনি যখন সুসায় ফিরে যান, তখন রোক্সানার আরেক ভাইও আলেকজান্ডারের রাজকীয় সুসজ্জিত অশ্বারোহী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন।
৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনে আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যু একজন সাধারণ নারী রোক্সানার খুনে চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। স্টেফানি থ্রনটনের কল্পকথা থেকে শুরু করে আরও অনেক ইতিহাস গবেষক পর্যন্ত লিখে গেছেন আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর কীভাবে রোক্সানার জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছিল। তিনি এই হুমকি থেকে বাঁচতে গিয়ে তার প্রতিটি সতীনকে পথের কাঁটা ভেবেছেন।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সেনাদলের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, তা স্পর্শ করে রোক্সানাকেও। রোক্সানাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হন সেনাদলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন জেনারেল। এ পরিস্থিতিটা সুযোগ হিসেবে নেন রোক্সানা। তিনি শক্তিমত্তার পাশাপাশি কূটচাল ব্যবহার করে পথের কাঁটাদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। তার এ আক্রমণ থেকে নিস্তার পাননি আলেকজান্ডারের অন্য স্ত্রীদের প্রায় সবাই।
দ্বিতীয় স্টেটেরিয়া, তার বোন ড্রাইটেরিস ও তার জ্ঞাতি বোন তথা আলেকজান্ডারের তৃতীয় স্ত্রী প্রেস্টিসাটিস— এরা প্রত্যেকেই খুব সম্ভবত খুন হন রোক্সানার চক্রান্তে। বিশেষ করে স্বামীর মৃত্যুর পর রোক্সানার গর্ভে এক সন্তান জন্ম নেয়। তিনি চেয়েছিলেন উত্তরাধিকারী হিসেবে এ সন্তানের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না। আর এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতেই তিনি পুরো রাজরক্ত শেষ করে দিতে বদ্ধপরিকর হন বলে অনেকেই নিজ নিজ খেয়াল-খুশিমতো লিখে গেছেন।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার মা অলিম্পিয়াস পাশে দাঁড়ান রোক্সানার। তাই তিনি অন্য রানীদের থেকে আলাদা। তবে অলিম্পিয়াসের এ সহায়তা শেষ রক্ষা করতে পারেনি রোক্সানা কিংবা তার পুত্রকে। আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াসকে ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাণ দিতে হয় গুপ্তঘাতকদের হাতে। মনে করা হয়, সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে চলমান লড়াইয়ের অংশ হিসেবে গ্লসিয়াসের নির্দেশেই খুন হতে হয় তাকে।
এ হত্যাকাণ্ড ক্যাসান্ডারের পথ পরিষ্কার করে। সে সুযোগ বুঝে রোক্সানা ও তার ছেলেকে অ্যাম্ফিপোলিসের একটি দুর্গে বন্দি করে রাখে। এক্ষেত্রে আলেকজান্ডারের ছেলে যেহেতু তার পুরো সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিল, সেই হিসেবে তাকে বন্দি করতে পারলে পুরো রাজ্যের ওপর সহজ দখল নিশ্চিতকরণ সম্ভব হয় গ্লসিয়াস ও ক্যাসান্ডারের জন্য। তারা খ্রিস্টপূর্ব ৩১০ অব্দের দিকে ছেলেসহ রোক্সানাকে কারারুদ্ধ করলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
অনেকে দাবি করেন, রোক্সানার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কানের মধ্যে বিষ ঢেলে হত্যা করা হয়েছে। অনেকের ধারণা, খাবারে বিষ মিশিয়ে রাখায় ওই খাবার খেয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। কারো কারো ধারণা, ছুরিকাঘাত করে কোনো আততায়ী তাকে হত্যা করেছে।
বাস্তব জীবন খুব অল্প দিনের হলেও রোক্সানা ইতিহাসে মূলত বিখ্যাত হয়েছেন আলেকজান্ডারের প্রিয়তম স্ত্রী হিসেবে। রাজনৈতিক ইতিহাসে তাকে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে স্থান করে নিতে দেখা না গেলেও কল্পকথা ও গল্পগাথার পাতায় পাতায় তার বিচরণ।
১৯০৯ সালের দিকে রচিত মার্শাল কার্কম্যানের (Marshall Monroe Kirkman) বিখ্যাত প্রণয়োপাখ্যান ‘The Romance of Alexander and Roxana’-তে কেন্দ্রীয় চরিত্র রোক্সানা।
১৯৬৫ সালে অব্রে মেনন (Aubrey Menen) লিখে গেছেন নারী ষড়যন্ত্র শীর্ষক গ্রন্থ ‘A Conspiracy of Women’। আর সেখানেও রোক্সানার ঠাঁই মিলেছে। ১৯৭২ সালের দিকে রচিত মেরি রেনল্টের (Mary Renault) বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য পার্সিয়ান বয়’তেও (The Persian Boy) দেখা যায় রোক্সানার উপস্থিতি।
এক দশকের বিরতিতে ১৯৮১ সালের দিকে প্রকাশিত একই লেখকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি ফিউনেরাল গেমস (Funeral Games) থেকেও বাদ যাননি রোক্সানা। ২০০২ সালের দিকে নন্দিত লেখক ভ্যালেরিও মাসিমো ম্যানফ্রেডি (Valerio Massimo Manfredi) রচনা করেন আলেকজান্ডারের ওপর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Alexander: The Ends of the Earth’। এখানে আলেকজান্ডারের স্ত্রী হিসেবে স্বভাবতই এসেছে রোক্সানার নাম।
২০০৮ সালের দিকে তার চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে এ. জে. কেইভ (A. J. Cave) সরাসরি একটি উপন্যাসই রচনা করেন রোক্সানার নামে, যার নাম ‘Roxana Romance’। আরও আছে স্টেফানি থ্রনটনের (Stephanie Thornton) গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা- The Conqueror’s Wife। তিনি এখানে আলেকজান্ডারের স্ত্রী হিসেবে নানা বর্ণনা দিয়েছেন রোক্সানার।
হলিউড-বলিউডের কল্যাণে বর্তমান সময়ের মানুষ দুজন রোক্সানাকে দেখার সুযোগ পেয়েছে। হলিউডের আলেকজান্ডার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুবাদে প্রথম রোক্সানা চরিত্র হিসেবে বলতে হয় রোজারিও ডসনের নাম। আর একইভাবে ভারতের একটি নন্দিত টিভি সিরিয়াল পুরুতে অভিনয় করেছেন অপর্ণা দীক্ষিত। প্রথমোক্ত চলচ্চিত্র কিংবা দ্বিতীয়তে উল্লিখিত টিভি সিরিয়াল দুটির ক্ষেত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন ডসন কিংবা অপর্ণা।