বাওড়া মসজিদের ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
বীরকুটশা, নলডাঙ্গা, মালঞ্চি, মাঝগ্রাম, মাধনগর, আজিমনগর, আব্দুলপুর, বাসুদেবপুর, লোকমানপুর কিংবা ইয়াছিনপুর রেলস্টেশনের সবকটিতে এখনও কোনো ট্রেন নিয়মিত থামে কিনা বলা কঠিন, তবে নাটোরের কথা হতেই হঠাৎ থেমে যেতে হয় আমাদের। আমরা থামতে বাধ্য হই ইতিহাস আর সাহিত্যের পাতা ঝলমলে হয়ে থাকা একটি জেলার কথকতায়।
কবি জীবনানন্দ দাশের সেই বনলতা সেন, তাণ্ডব তোলা রাণী ভবানী কিংবা মুখরোচক কাঁচাগোল্লার গল্প পেরিয়ে যদি ইতিহাসের কথা বলতে হয়, তাহলে শুরুতেই আসে সুলতানি কালপর্ব। এখনও উল্লেখযোগ্য কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে সেভাবে উপযুক্ত বর্ণনা দেওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে মোগল যুগের নাটোর কতটা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল তার প্রমাণ মিলছে নানা ক্ষেত্রে। আর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মোগল মসজিদটি, স্থানীয়ভাবে সবাই যাকে বাওড়া মসজিদ নামে চেনে।
নাটোর জেলার চিরচেনা একটি থানা লালপুর। কম বৃষ্টিপাত, বেশি শীত আর হাপিত্যেশ তোলা গরমে অতিষ্ট জীবনের এই এলাকাটি আরও নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সেই গল্প আরেকদিন বলা যাবে। তবে এখানেই আছে মোগল আমলের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন বাওড়া মসজিদ।
এক কাতারের তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ তার বাইরের পলেস্তারা, গম্বুজের বিন্যাস আর সংখ্যা দিয়ে যেকোনো প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক কিংবা ইতিহাসবিদকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে, তার বয়স কমপক্ষে চারশত বছর তো হবেই।
আব্দুলপুর ও তার আশেপাশের মানুষ দীর্ঘদিন থেকেই গল্প করেন- এখানে একটি অনেক প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খনন, জরিপ কিংবা নিয়মতান্ত্রিক অনুসন্ধান সম্ভব হয়নি। আনুষাঙ্গিক গবেষণা না হওয়ার কারণেই হয়তো অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে মসজিদটি।
স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত গল্প আমাদের ইতিহাসের গল্প অনুসন্ধানী দলের সদস্য আহমেদ এস. সৈকতের কানে আসে। তার সাথে আলোচনা সাপেক্ষে গবেষক দলের মতামত আসে সরাসরি জরিপের। আহমেদ এস. সৈকতসহ গবেষক টিম স্থানীয় পর্যায়ে উপযুক্ত অনুসন্ধান শুরু করলে তারা স্থানীয় মুরুব্বিদের কাছ থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে মসজিদটি খুঁজে বের করেন।
গল্পে গল্পে অনেক জনপ্রিয় হলেও এই মসজিদটির কাছে পৌঁছানো খুব একটা সহজ ছিল না। স্থানীয় অনেক ব্যক্তি নানাভাবে সহায়তা করলেও ভাঙাচোরা রাস্তা পার হয়ে সেখানে যেতে অনেক বেগ পেতে হয়।
দীর্ঘ সময় ভ্রমণের পর যখন মসজিদের কাছাকাছি আমাদের গবেষক দল পৌঁছাতে সক্ষম হয়, তখন প্রায় সবার চক্ষু চড়কগাছ। ভুতুড়ে পরিবেশে চারপাশে ঘন জঙ্গল ছেয়ে আছে। মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি কবর। সেখানে লেখা লিপিমতে, “আব্দুল গনি মিয়ার কন্যা পেয়ারি খাতুনের সমাধি এটি। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর।”
এই কবরের আশেপাশে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন স্থানীয় মুরব্বিরা। তাদের মতে, “এই কবরসহ বাওড়া মসজিদ নাকি এক রাতে জ্বীনদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল। শুধু এই একটি নয়, নাটোর জেলায় সেই রাতে আরো দুটি স্থানসহ মোট তিনটি মসজিদ নির্মিত হয়।”
বাওড়া মসজিদের সঙ্গেই রয়েছে লাগোয়া আরেকটি নতুন মসজিদ। স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করেন, ঐ মসজিদটি যেহেতু জিনদের হাতে তৈরি, তাই সেটি ভেঙে নতুন মসজিদ তৈরি করা হলে জিনরা রেগে যেতে পারে।
অনুসন্ধানী দলের ভাষ্যমতে, “প্রচলিত গল্পটা আমাদেরকে আরো বেশি উৎসাহিত করেছে। বলা যায়, নানা ভয়মেশানো রোমাঞ্চকর কল্পকথা আমাদের আরও আগ্রহী করে তুলেছিল। আমরা যে সময় বাওড়া মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছালাম, সেটা ভরদুপুর বেলা হলেও তখন একজন মানুষকেও মসজিদের আশেপাশে পাইনি। কিন্তু মসজিদ থেকে সামান্য একটু দূরে অনেক বাড়িঘর। তারা অনেকটা ভয় থেকেই এই মসজিদের আশেপাশে আসেন না। এমনকি তারা গরু-ছাগল বাঁধার জন্যও এই মসজিদ আর কবর এলাকাটি এড়িয়ে চলেন।”
গাঠনিকভাবে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে- এই মসজিদ মোগল আমলে নির্মিত। অপেক্ষাকৃত পাতলা ইটের তৈরি এই মসজিদের কন্দাকৃতির ফিনিয়ালযুক্ত তিনটি গম্বুজ অনেকটাই সুস্পষ্ট মোগল ধাঁচের প্রতিনিধিত্ব করে। ইটের গাঁথুনিতে মর্টার হিসেবে চুন-সুড়কির ব্যবহার চিহ্নিত করা যায়।
নানারকম কারুকাজে সুদৃশ্য হয়ে ওঠা বাওড়া মসজিদ অনেকাংশে আয়তাকার ভূমি নকশায় নির্মিত। ১৩৮ শতাংশ জমিজুড়ে বিস্তৃত এই মসজিদে এক কাতারে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা ছিল। বাইরে উত্তর-দক্ষিণে লম্বায় ৩১ ফুট ৬ ইঞ্চি, পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থ ১৩ ফুট ৬ ইঞ্চি, এবং উচ্চতা ১১ ফুট ৬ ইঞ্চি।
মসজিদের নামাজকক্ষের ভেতরে উত্তর-দক্ষিণে লম্বায় ২৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও পূর্ব-পশ্চিমে ৭ ফুট ৬ ইঞ্চি। ৩ ফুট পুরু দেয়াল আছে। মসজিদের চার কোণায় চোখে পড়ে চারটি অক্টাগোনাল বুরুজ। মোগল স্থাপত্যের রীতি মেনে বুরুজগুলো কার্নিশ ছেড়ে বেশ খানিকটা উপরে উঠেছে।
কার্নিশ কিংবা ছাদ থেকে প্রতিটি ছত্রির উচ্চতা ৩ ফুট ৬ ইঞ্চির মতো হবে। প্রতিটি ছত্রির শীর্ষদেশে পদ্মফুলের নকশা আছে। মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত দুটি বৃহদাকৃতির খিলান রয়েছে। মসজিদটি এক কাতারের হলেও ৭ বর্গ ফুটের তিনটি আয়তাকার ‘বে’-দিয়ে ভাগ করা হয়েছে। এই মসজিদের প্রতিটি ‘বে’ দাঁড়িয়ে আছে আটকোণা স্তম্ভের উপর।
জঙ্গলে ঘেরা এই মসজিদ দীর্ঘদিন কোনো রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে আসেনি। তাই এর দেয়াল যেমন পিচ্ছিল, তেমনি এর ছাদজুড়ে রয়েছে প্রচুর শ্যাওলা, মস ও ফার্নজাতীয় উদ্ভিদ। ছাদে উঠে তিনটি গম্বুজের পরিমাপ নিয়ে দেখা গেছে যে এর প্রতিটির ব্যাস প্রায় ৮ ফুট।
ছাদের ওঠার পর কয়েকটি সরু মিনার তথা টারেটও চোখে পড়েছে। ওদিকে নামাজ গৃহের ভেতরে প্রবেশের জন্য পূর্ব দেয়ালে তিনটি অর্ধ-বৃত্তাকার খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ রয়েছে। মাঝখানের প্রবেশপথের দুই পাশে একটি করে আটকোণা সরু বুরুজ রয়েছে। বিভিন্ন অলঙ্কারে সজ্জিত এই বুরুজ ছাদের কিনারা থেকে উত্থিত ও ছত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত।
অন্যদিকে নামাজঘরের ভেতরে কিবলা প্রাচীরে প্রবেশপথ বরাবর কম গভীরতার আয়তকার ফ্রেম দ্বারা বেষ্টিত তিনটি অর্ধ-বৃত্তাকার মিহরাব দৃশ্যমান। মসজিদটির ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। বাইরে থেকে আলো ঢোকার সুযোগ কম থাকায় অপেক্ষাকৃত অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ।
এই মসজিদটি গাঠনিকভাবে বৈচিত্র্যের অধিকারী হলেও এখানে মাত্র একটি কাতারে ১৮-২০ জন মানুষ নামাজ আদায় করতে পারার কথা। তাই ২০১০ সালে এই মসজিদ সংলগ্ন পূর্বদিকে নতুনভাবে একতলা আরেকটি ভবন নির্মাণ করা হয়। নতুন স্থাপত্য মূল মসজিদের স্থাপত্যিক সৌন্দর্য নষ্ট করলেও এর বাইরে অন্য কিছু করার সুযোগ ছিল কম।
লালপুর উপজেলা পরিষদ অর্থাৎ গোপালপুর থেকে ২.৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নর্থ-বেঙ্গল সুগার মিলের কেন্দ্রীয় কবরস্থানের পাশে বাওড়া গ্রামে অবস্থিত ঐতিহ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘বাওড়া মসজিদ’ এক অর্থে ‘গোপালপুরের’ মানুষের আত্মপরিচয়কে ধারণ করে।
ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শণ হিসেবে মসজিদটি রক্ষায় স্থানীয়দের যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের উচিৎ যত দ্রুত সম্ভব একে সংরক্ষিত পুরাকীর্তির তালিকায় স্থান দিয়ে উপযুক্ত সংস্কারের চেষ্টা করা। নাহলে একসময় এই মসজিদও হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে।