সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার, অবস্থান ও বিস্তৃতির ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
হরপ্পা নাকি মহেঞ্জোদারো- নামকেন্দ্রিক এই বিতর্কের আগে বড় হয়ে ওঠে সিন্ধু, শতদ্রু, রাভি ও ইরাবতী নদীর তীরে গড়ে ওঠা একটি সমৃদ্ধ নগরসভ্যতার গল্প। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় নাকি পণ্ডিত দয়া রাম সাহনি- কে এই সভ্যতার আবিষ্কারক এটা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে তা নিয়ে জেরবার হওয়ার আগে আমাদের আমলে নেওয়া উচিত যে, পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার খয়েরপুরে মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কারের জন্য কৃতিত্ব বর্তাবে পণ্ডিত দয়া রাম সাহনির ওপর।
পণ্ডিত দয়ারাম সাহনি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করছিলেন। এই সময়ে তিনি মহেঞ্জোদারো থেকে প্রায় সাড়ে ছয়শো কিলোমিটার দূরের একটি স্থানে খনন করছিলেন। অন্যদিকে, প্রখ্যাত বাঙালি ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় মহেঞ্জোদারোর প্রাচীন ঢিবিকে অনুমান করেছিলেন কোনো বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বলে। এই অনুমানের উপর ভিত্তি করে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি খননকার্য পরিচালনা করেন। এরপর তিনি সেখান থেকে বিস্তৃত এক সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন বলে জানা যায়।
আমরা জানি, পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর অধিকাংশই গড়ে উঠেছিল নদীর তীরে। একইভাবে ভারতেও নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল এক সভ্যতা। এর পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল।
নবোপলীয় যুগে খাদ্য ও ঘাসের অভাব দেখা দিলে ভারতের বিভিন্ন অংশের মানুষ নদীর তীরে বসতি নির্মাণ করতে শুরু করে। মানুষ নানা স্থানে বসতি নির্মাণ করলেও নিজেদের এবং পশুর খাদ্য যোগানোর জন্য নদীর তীরই ছিল উপযুক্ত জায়গা। এভাবে সিন্ধু নদীর তীরে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল ভারতের প্রাচীন সভ্যতা- সিন্ধু সভ্যতা।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর সম্মিলনে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতা আশেপাশের আরও বেশ কিছু অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ সিন্ধু সভ্যতাকে হরপ্পা সংস্কৃতি তথা Harappan Culture বলার পক্ষপাতী।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন এই সভ্যতাটি প্রথম হরপ্পা অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছিল বলেই এমন নামকরণ জনপ্রিয়তা পায়। সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া লিখিত দলিল পাঠ করা সম্ভব হয়নি। তাই এ সভ্যতার রাজনৈতিক ইতিহাস তেমনভাবে জানা যায় না। তবে ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া দ্রব্যসামগ্রী বিশ্লেষণ করে এ সভ্যতার অগ্রগতি সম্বন্ধে ধারণা লাভ করা যায়।
সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষগুলো প্রমাণ করে যে, প্রাচীনকালে এখানে উন্নত, পরিকল্পিত নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছিল। একইসঙ্গে এখানে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনেও পরিকল্পনার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। উত্থান, বিকাশ এবং পতন সভ্যতার অবধারিত নিয়ম। এই নিয়ম প্রযোজ্য হয় সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রেও। একসময়ের উজ্জ্বল এ সভ্যতাও একপর্যায়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যায়।
সবার আগে প্রশ্ন ওঠে, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর অবস্থান মূলত কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে, এককথায় দেওয়া কঠিন। তবে সিন্ধু নদের তীরে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে বিবেচনায় অনেক দিন থেকেই অনুসন্ধান চলছিল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম হরপ্পা অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন করা হয়। পশ্চিম পাঞ্জাবের মন্টোগোমারি জেলায় ইরাবতী নদীর পূর্ব উপকূলে হরপ্পার অবস্থান। পরের বছর উৎখনন করা হয় মহেঞ্জোদারো অঞ্চলে।
পাকিস্তানের অন্তর্গত সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার খয়েরপুরে মহেঞ্জোদারোর অবস্থান। এরপর থেকে ক্রমাগত খনন চলতে থাকে। ক্রমে ক্রমে বেরিয়ে আসে এই সভ্যতার চমৎকার সব নিদর্শন। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন প্রমাণ করতে থাকে যে সিন্ধু সভ্যতা শুধুমাত্র হরপ্পা আর মহেঞ্জোদারো নগর দুটোকে ঘিরে বেড়ে ওঠেনি। দূরবর্তী আরও অনেক অঞ্চলেও এর বিস্তার ঘটেছিল। ‘সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার’ প্রসঙ্গে খোঁজ নিতে গেলে এ বিষয়ের ধারণা মিলবে।
অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ তাঁর ‘বিশ্বসভ্যতা (প্রাচীন যুগ)’ গ্রন্থে লিখেছেন, “প্রত্নতাত্ত্বিকগণ বিশ শতকের তৃতীয় দশকের শুরুতে সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কার করেন। তবে এ অঞ্চলে পুরাকীর্তি প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল আরও প্রায় এক শতক আগে। আনুমানিক ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে চার্লস ম্যাসন (Charles Masson) পাঞ্জাবে মহারাজা রণজিৎ সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন।
তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের দিক থেকে একটি সম্ভাবনাময় ঢিবি দেখেছিলেন হরপ্পায়। অতঃপর ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান এবং ভারতে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার পথ প্রদর্শক মেজর জেনারেল কানিংহাম (Sir Alexander Cunningham) ১৮৫৩ থেকে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কয়েকবার জায়গাটি পরিদর্শন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি সচিত্র রিপোর্টও প্রকাশ করেন। রিপোর্টে সিন্ধু সভ্যতার সুপরিচিত সীলসহ কয়েকটি ছুরির ফলার ছবি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কানিংহামের এই প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান প্রথম পর্যায়ে গবেষকদের মাঝে তেমন আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। এই ঘটনার প্রায় অর্ধশত বৎসর পর মহেঞ্জোদারো অঞ্চলে আবার প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চলে। এখানেও পাওয়া যায় একই ধরনের সীল। এবার এই নিদর্শনসমূহ বিখ্যাত পত্রিকা ‘ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজে’ প্রকাশিত হয়। এতে সাড়া পড়ে যায় চারদিকে। প্রত্নতত্ত্বে উৎসাহী বিশেষজ্ঞগণ ছুটে আসেন ভারতে। ইতোমধ্যে মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া সীলসমূহ সবার নিকট পরিচিত হয়ে উঠেছিল। পণ্ডিতগণ হরপ্পা আর মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া সীলগুলোর সঙ্গে এর কিছুটা মিল খুঁজে পেলেন।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারে প্রথম ভূমিকা রাখেন বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বহুকাল আগেই মহেঞ্জোদারোর প্রাচীন ঢিবিকে তিনি অনুমান করেছিলেন কোনো বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বলে। এই অনুমানের উপর ভিত্তি করে তিনি খননকার্য পরিচালনা করেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু মাটির গভীর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মৃৎপাত্র আর পাথরের শিল্পকর্ম। তিনি সহজেই অনুমান করেন, সঠিক উৎখননকার্য চালাতে পারলে নিশ্চয়ই প্রাচীন কোনো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যাবে।
প্রায় একই সময় (১৯২১ খ্রিস্টাব্দে) মহেঞ্জোদারো থেকে প্রায় সাড়ে ছয়শো কিলোমিটার দূরে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননকার্য পরিচালনা করেছিলেন পণ্ডিত দয়ারাম সাহনি। এই অঞ্চল থেকেও একই প্রকার প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়। এবার ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এর গুরুত্ব বুঝতে পারে। এই বিভাগের প্রধান স্যার জন মার্শাল (Sir John Marshall) খননকার্য চালাতে থাকেন মহেঞ্জোদারোতে। কয়েক বছর পর আর্নেস্ট ম্যাকে (Ernest J. H. Mackay) তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দেন।
হরপ্পায় খননকার্য চালাতে থাকেন এম. এস. ভাট (M. S. Vat)। এ পর্যায়ে মহেঞ্জোদারোতে কাজ চলে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, আর হরপ্পাতে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র নতুন মহাপরিচালক স্যার মরটিমার হুইলার (Sir Mortimer Wheelir) দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি মহেঞ্জোদারোতে খননকার্য পরিচালনা করেন।
এভাবে অব্যাহত খননকার্যের ফলে মহেঞ্জোদারোতে কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্তরের সন্ধান মেলে। একেকটি স্তরে পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতার একেক পর্যায়ের সংস্কৃতির নিদর্শন। হরপ্পায় এম. এস. ভাট খননকার্য চালান ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে। পরে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে এখানেও যোগ দেন মরটিমার হুইলার। বোঝা যায়, মহেঞ্জোদারোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শনের ভাণ্ডার রয়েছে হরপ্পাতে। নিশ্চিত হওয়া যায়- মহেঞ্জোদারোর চেয়ে আরও প্রাচীন ছিল হরপ্পার সংস্কৃতি।”
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার দুটো নগরীতেই বিভিন্ন পর্যায়ে মনুষ্যবসতি হয়েছে। তাই মাটির বিভিন্ন স্তরে স্তরবিন্যাস স্পষ্ট। মহেঞ্জোদারোতে যে কয়টি স্তর উৎখনন করা হয়েছে সেসবের মধ্যে কালের ব্যবধান হচ্ছে মাত্র ৬০০ বৎসর। সবচেয়ে নীচের স্তরের বয়স খ্রিস্টপূর্ব ১৯৬৩ অব্দ, আর একেবারে উপরের স্তরের বয়স খ্রিস্টপূর্ব ১৬৫০ অব্দ। অন্যদিকে, হরপ্পা নগরীর সবচেয়ে নীচের স্তর গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টপূর্ব ২২৪৫ অব্দে। এই নগরীর একেবারে উপরের স্তরের বয়স খ্রিস্টপূর্ব ১৯৬০ অব্দ।
সার্বিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে স্যার জন মার্শাল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, সিন্ধু সভ্যতার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন অবস্থান ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩২৫০ থেকে ২৭৫০ অব্দের মধ্যে। মার্শালের এই পিছিয়ে যাবার প্রধান কারণ ভূতত্ত্ববিদগণের অনুমান। কারণ, তারা মনে করেন- প্রাপ্ত মাটির স্তরের নীচে আরও স্তর ছিল যাকে নিম্নস্তরের পানি গ্রাস করেছে। প্রাপ্ত অনেক প্রত্নবস্তু এই অনুমান সমর্থন করে।
সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিকগণের সাথে কাশীনাথ দীক্ষিত এবং ননীগোপাল মজুমদারের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিক আইভার লিজনার (Iver Lissner) তার The Living Past গ্রন্থে সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব ৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন। মরটিমার হুইলারের মতে, সিন্ধু সভ্যতার উৎসকাল ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।
যদি প্রশ্ন করা হয়, “সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি ছিল কতদূর?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের অনেকগুলো বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়। আবিষ্কারের শুরুর দিকে অনুমান করা হয়েছিল সিন্ধু উপত্যকাকে ঘিরেই সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। সে কারণেই এই সভ্যতার নামকরণ হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতা। কিন্তু ক্রমে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য বৃদ্ধি পেলে ধীরে ধীরে এ ধারণা পাল্টাতে থাকে। পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন অংশে উৎখননের ফলে আরও অনেক প্রত্নক্ষেত্রের সন্ধান মিলেছে। এ সমস্ত অঞ্চলের বস্তুসংস্কৃতি অনেক ক্ষেত্রে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর সংস্কৃতির সঙ্গে ছিল অভিন্ন। এ কারণে সিন্ধু সভ্যতার পরিধি ও বিস্তৃতি অনেক ব্যাপক হয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতা যে অনেক বিস্তৃত হতে পারে তা ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে স্যার জন মার্শাল অনুমান করেছিলেন। এরপর মরটিমার হুইলার ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রায় সাঁইত্রিশটি জায়গায় সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন প্রাপ্তির কথা জানিয়েছেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু সভ্যতার ব্যাপক বিস্তৃতির কথা বলেন প্রখ্যাত ইংরেজ ইতিহাসবিদ গর্ডন চাইল্ড। উৎখননের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কমপক্ষে ৭০টি অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার ছিল। মনে করা হয়, সিন্ধু সভ্যতা আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।
বেলুচিস্তানের মাকরান উপকূলে অবস্থিত সুতকাজেনদোর অঞ্চলের প্রত্নস্থল এর সাক্ষ্য দেয়। সিন্ধু ও পাঞ্জাব ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের আরও অনেক অঞ্চলেই সিন্ধু সভ্যতার অনুরূপ সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়ায় এ সমস্ত অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার ঘটেছিল বলে বর্তমানে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রত্নস্থলসমূহ হচ্ছে গুজরাটের লোথাল, দেশলপার, রাজস্থানের কালিবঙ্গান, শতদ্রু নদীর তীরে রূপার, উত্তর প্রদেশের মীরাট জেলায় অবস্থিত আলমগীরপুর, হরিয়ানার বানাওয়ালি, মিতথাল প্রভৃতি।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ছাড়া পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সরাইখোলা, গুমলা, মুন্ডিগাক, রানাঘুনতাই, ডাবরকোট, ডামরসাদাত, ভাবলপুর, কোটদিজি, চানহুদারো, কুল্লি, বালাকোট, আল্লাহদিন, আমরি, কোয়েটা, মেহের গড়, নওশাহরো, পিরক, দেরাওয়ার, ঝুকার ইত্যাদি।
সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃত অঞ্চলের অনেক জায়গায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল বেশ প্রাচীন। প্রাগৈতিহাসিক কালপর্ব থেকে এ সমস্ত অঞ্চলে মানববসতি ছিল, এবং সভ্যতা গড়ায় এ সমস্ত অঞ্চলের মানুষ ভূমিকা রেখেছে। এরকম আদি সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে বেলুচিস্তানের কিলিগুল মুহম্মদ নামক স্থানে। এখানে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শনসমূহ ৩৬৮৮ থেকে ৩৭১২ বছরের পুরনো। এই অঞ্চলের মানুষেরা রোদে শুকানো ইট দিয়ে ঘর বানাতো, এবং গরু, ছাগল ও মেষ পালন করতো। পাথরে তৈরি কিছু দ্রব্যাদিও পাওয়া গিয়েছে।
এ অঞ্চলের অধিবাসীরা হাতে তৈরি মৃৎপাত্র ব্যবহার করতো। পরবর্তী সময়ে কুমোরের চাকায় মসৃণ মৃৎপাত্র তৈরি করা হয় এবং এর উপরে লাল ও কালো রঙের জ্যামিতিক নকশা অঙ্কন করা হয়। ধারণা করা হয়, সিন্ধু সভ্যতার পত্তন ঘটার পূর্বে এখানে নবোপলীয় যুগের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল।
আমরি, কোটদিজি, হরপ্পা ও কালিবঙ্গানে সিন্ধু সভ্যতার প্রস্তুতি পর্বের সংস্কৃতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। আমরি অঞ্চলে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালান ননীগোপাল মজুমদার। এখানে নিম্নতম স্তরে পাওয়া গিয়েছে নানা আকারের মৃৎপাত্র, পাথরের তৈরি ছুরির ফলা এবং কিছু সংখ্যক তামা ও ব্রোঞ্জের টুকরো। উপরের দিকের স্তরে পাওয়া গিয়েছে রোদে শুকানো ইট ও পাথরে তৈরি ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। চাকায় তৈরি মসৃণ ও নকশা কাটা মৃৎপাত্রও পাওয়া গিয়েছে।
প্রাপ্ত নির্দশন থেকে জানা যায়, আমরি অঞ্চলের মানুষেরা পশুপালন ও কৃষিজীবনে অভ্যস্ত ছিল। আমরি থেকে দেড়শ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে কোটদিজির অবস্থান। এখানে ১৯৫৫-৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন করেন ড. এফ. এ. খান। আমরির মতোই সাংস্কৃতিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে এখানে। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২৬০৫ অব্দে এখানে মানববসতি ছিল। পরে এখানে একটি মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। দ্বিতীয়বার বসতি গড়ার পর খ্রিস্টপূর্ব ২০৯০ অব্দে এখানে পুনর্বার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল।
কোটদিজি থেকে প্রায় সাড়ে চারশত কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে কালিবঙ্গানের অবস্থান। এখানে উৎখনন করা হয় ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে। আমরি ও কোটদিজির মতো এখানেও পাকা ঘরবাড়ি পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছে বিভিন্ন ব্যবহার্য দ্রব্য এবং মাটির গুটিকায় তৈরি গলার হার। এখানে সংখ্যায় অল্প হলেও ধাতুর তৈরি অলঙ্কার ও কুঠার পাওয়া গিয়েছে। কালিবঙ্গানে কালো ও লাল রঙের অনেক মৃৎপাত্রের সন্ধান মিলেছে। কালিবঙ্গান সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের মধ্যে।