প্রাচীন মিসরে রূপচর্চার ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
নীলনদ আর পিরামিডের দেশ হিসেবে খ্যাত মিসর এককথায় যেমন সমৃদ্ধ সভ্যতার পীঠস্থান, তেমনি এর সম্পর্কে অনেক বিষয় এখনও অজানা রয়ে গেছে আমাদের। বিশেষ করে, মিসরের ইতিহাস বলতে আমরা যা পড়ি, তার অধিকাংশই রাজনৈতিক ইতিহাস কিংবা প্রাচীন শিল্প-সংস্কৃতির সাধারণ বিবরণ।
প্রাচীন মিসরে উৎসব উদযাপনকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হতো। বিশেষ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং তাদের পুরোহিত আর রাজার নির্দেশে আয়োজিত নানা ধরনের রাজকীয় আয়োজনে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল মানুষের। গণজমায়েতের মতো এমন সব অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়া মানুষগুলো যেমন তাদের পোশাকআশাক নিয়ে সচেতন ছিলেন, তেমনি তাদের সাজসজ্জাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
বিভিন্ন মিসরীয় পুরাণের রেফারেন্স সামনে এনে অনেকে দাবি করেন- তখনকার নারীদের চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ত না। পাশাপাশি, চামড়া কুঁচকে না যাওয়ায় অনেকে সুন্দরী থাকা অবস্থায়ই তারা মারা যেতেন। এজন্যই নেক্রোফিলিয়ায় আসক্ত গোরখুঁড়ে, রাজপরিবারের শত্রু কিংবা কুরুচিপূর্ণ লোকদের লালসা থেকে তাদের নিরাপদ রাখতে মৃত্যুর কয়েকদিন পর মমি তৈরি শুরু হতো। এই ব্যাপারে আরও জানতে মিশরীয় কবরচোরদের নিয়ে বানানো আমাদের ভিডিওটি দেখতে পারেন। লিংক দেয়া আছে ডেসক্রিপশনেই।
যা-ই হোক, মিসরীয় নারীরা তাদের জীবদ্দশায় রূপচর্চা ও সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে কোনো আপস করেনি। বিপরীতে, নানাবিধ প্রাকৃতিক উপাচারে সাজানো ছিল তাদের রূপচর্চার বিভিন্ন পদ্ধতি। এজন্যই মিসরের নারীরা পাঁচ হাজার বছর আগে রূপচর্চায় যেসব প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করেছিলেন, এখনও তার উপযোগ ফুরিয়ে যায়নি।
শুরুতেই কয়েকটি উপাদানের কথা বলে নেওয়া যেতে পারে, যেগুলো প্রাচীন মিসরীয় নারীরা তাদের রূপচর্চায় ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে তারা মুখের ত্বককে প্রাণবন্ত ও সজীব রাখতে ব্যবহার করেছিলেন মেথি, অ্যাভোকাডো এবং উটের দুধ। অন্যদিকে, শরীরের অপ্রয়োজনীয় লোম দূর করতে তারা ব্যবহার করেছেন চিনির মিশ্রণ। কেউ কেউ অ্যাভোকাডোর ভর্তা তৈরি করে পুরো মুখে লাগাতেন। পাশাপাশি অ্যাভোকাডো টুকরো করে কেটে চোখের নিচে রেখে দিয়ে চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতেন তারা।
ত্বকের উজ্জ্জ্বলতা ধরে রাখতে মিসরীয় নারীরা গোসলের পর বাদামের তেল ব্যবহার করতেন। বর্তমানে গবেষণায় দেখা গিয়েছে- বাদামের তেলে প্রচুর পরিমাণে উপকারী ফ্যাট এবং ভিটামিন-ই থাকে। এর প্রভাবে যেকোনো বয়সের নারীর ত্বকই নরম, টানটান এবং মসৃণ দেখায়। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এখনকার নারীরা বোটক্সের ব্যবহার যে উদ্দেশ্যে করেন, তখনকার মিসরীয়রা তার বিকল্প হিসেবে প্রতিদিনই শরীরে বাদামের তেল মাখতো।
অন্যদিকে, রানী ক্লিওপেট্রা নিয়মিত সামুদ্রিক লবণ দিয়ে গোসল করতেন। এই লবণ ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে, ত্বককে স্বাস্থ্যজ্জ্বল করার পাশাপাশি ত্বকের নানাবিধ সমস্যা দূর করতে সাহায্য করেছিল। সাধারণ রূপচর্চার পাশাপাশি তারা ব্যবহার করতেন বিভিন্ন প্রাকৃতিক সুগন্ধী ও মেহেদি। এই মেহেদি চুলের রং পরিবর্তনের পাশাপাশি অনেকটা কন্ডিশনার হিসেবেও কাজ করতো।
ডিয়ার ভিউয়ার্স, এতক্ষণ আপনারা যা শুনেছেন সেগুলো কি নিছক গল্প? অবশ্যই নয়। কারণ প্রাচীন মিসরের যেসব সমাধি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে, সেখানে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে তখনকার মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে জানা যায়। তবে যেসব সুরক্ষিত সমাধি পাওয়া গেছে, সেগুলো অপেক্ষাকৃত ধনী এবং রাজপরিবারের সদস্যদের। ফলে এসব সমাধি থেকে প্রাপ্ত নিদর্শন দেখে হুটহাট সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে মন্তব্য না করাই ভালো।
প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনুমান করা যায় যে তখনকার মানুষ ঝলমলে পোশাক পরত। এর বাইরে তারা ব্যবহার করত নানা রকম প্রসাধনী। তারা প্রায় প্রতিদিন গোসল করার অভ্যাস আয়ত্বে এনেছিল। অনেক মানুষ শুষ্ক পরিবেশে খুশকি থেকে বাঁচতে তাদের মাথা ন্যাড়া করত। পাশাপাশি উঁকুনের মতো ক্ষতিকর প্রাণী এবং মশা-মাছির উপদ্রব থেকে বাঁচতে তারা তৈরি করেছিলো বিশেষ প্রাকৃতিক মিশ্রণ। এগুলো বর্তমানে যেমন নানা কেমিক্যাল দিয়ে করা হয়ে থাকে, তেমনি তখনকার দিনে সরাসরি প্রাকৃতিক উপাদানের সহায়তা নেওয়া হতো।
বুক অব ডেড থেকেও অনেক ব্যক্তির এ ধরনের অভ্যাস থেকে জানা সম্ভব হয়েছে। এই বুক অব ডেডের স্পেল ১২৫ থেকে জানা যাচ্ছে, পবিত্র বাণী পাঠ করার আগে যে কাউকে— ‘পরিচ্ছন্ন হওয়ার পাশাপাশি সুন্দর পোশাক এবং সাদা রঙের চপ্পল পরতে হতো, চোখে কাজল দিতে হতো এবং শরীরে উদ্বর্তিত তেল মেখে নিতে হতো’। প্রখ্যাত গবেষক Jules B. Billard ১৯৭৮ সালের দিকে প্রকাশিত ‘Ancient Egypt: Discovering its Splendors’ শীর্ষক নিবন্ধে আরও জানিয়েছেন- এই নীতি না মেনে কারো পক্ষে নানা ধরনের ধর্মীয় আয়োজনে পৌরহিত্যের সুযোগ ছিলো না।
বিভিন্ন প্রাচীন সূত্র থেকে মিসরীয়দের উপাস্য সম্পর্কে জানা গিয়েছে। মিসরীয়দের প্রায় প্রত্যেক উপাস্যের চোখের জন্য নানা রকম প্রসাধনী ব্যবহার করতে দেখা যায়। বলা যেতে পারে, এগুলোই পরবর্তীকালে তাদের উপাসকদের অনুপ্রাণিত করেছিল। তারা নানা ধরনের প্রসাধনী যে শুধু ধর্মীয় কারণেই ব্যবহার করেছেন এমনটা নয়। এর বাইরে তারা সুস্থ, সুন্দর ও সবল থাকার কাজেও নানা ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রে নানা ধরনের মলম, ক্রিম ও তেল তারা শরীরে মাখত ত্বক মোলায়েম করতে, রোদের প্রকোপ থেকে বাঁচতে, কিংবা চোখের নানামুখী সমস্যা উপশমের জন্য। কারো কারো ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রসাধনী ব্যক্তিত্ব বৃদ্ধিতেও কাজে লেগেছে বলে অনেক গবেষক দাবি করেছেন।
প্রাচীন মিসরের গবেষক Andrew H. Gordon এবং Calvin W. Shwabe ২০০৪ সালের দিকে প্রকাশিত The Quick and the Dead: Biomedical Theory in Ancient Egypt শীর্ষক গ্রন্থের বিশেষ নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন মিসরের প্রসাধনী নিয়ে। Brill Academic Publishers থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থে জানা গিয়েছে, প্রাচীন মিসরে যারা এ ধরণের প্রসাধনী তৈরি করতেন তাঁরা নানাভাবে সমাজে ছিলেন সমাদৃত। অন্যদিকে তারা নিজেদের কাজকে অনেক পবিত্র মনে করতেন। বিশেষ করে, তাদের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পর এই কাজের জন্য তাদের সম্মান আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই তারা প্রসাধনী তৈরির কাজকে সম্মানিত করতে আন্তরিকতার সঙ্গে উপযুক্ত শ্রম দিয়ে গেছেন। তাই প্রসাধনী তৈরির ক্ষেত্রে তারা বেছে নিতেন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক উপাদান, যা থেকে উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি হয়েছে চমকপ্রদ সব প্রসাধনী।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে ২০০০ সালের দিকে Journal of Near Eastern Studies এ প্রকাশিত Robert K. Ritner এর Innovations and Adaptations in Ancient Egyptian Medicine শীর্ষক নিবন্ধেও অনেকগুলো তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত যে এখনকার দিনের নানা প্রসাধনীর সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম ছিল প্রাচীন মিসরে তৈরি উপকরণগুলো। তারা এখনকার ফেসওয়াশ, ডিওড্রান্ট, ব্রেদ মিন্ট কিংবা টুথপেস্টের মতো নানা উপকরণ শুধু ভেষজ উপাদান থেকে নিষ্কাশন করেছিলো। ফলে তাদের সুস্বাস্থ্য কিংবা রূপচর্চা নিয়ে কোনোরকম চিন্তা করতে হয়নি।
অক্সফোর্ড ডিকশনারি কেমিস্ট্রি তথা রসায়নের উৎপত্তি দাবি করছে ‘আলকেমি’ থেকে। এর সঙ্গে প্রাচীন মিসরের নামের অনেক মিল আছে। এর থেকে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মিসর গবেষক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দাবি করছেন রসায়নের উৎপত্তি প্রাচীন মিসরেই। বিশেষ করে ডা. সামাহ তাঁর মেডিসিন ইন অ্যানশেইন্ট ইজিপ্ট প্রবন্ধে এ বিষয়ে উপযুক্ত প্রমাণই দিয়ে গেছেন। তাঁর ভাষ্যে যদিও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা ছিল, তবে মিসরীয়রা তাদের দৈনন্দিন পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়নি। ফলে যা-ই হোক, অন্তত বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে বেঁচে থাকতে পেরেছে তারা। প্রতিদিন গোসল করার অভ্যাস থাকায় খোস-পাঁচড়াসহ নানা ধরনের চর্মরোগের সংক্রমণ থেকে মুক্ত ছিল তারা।
শারিরীক সুস্থতা থেকে শুরু করে যৌন সক্ষমতা বৃদ্ধির নানা উপকরণ সম্পর্কে ধারণা ছিল মিসরীয়দের। তারা পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি নিজেদের দর্শনীয়ভাবে উপস্থাপনের জন্য বেশিরভাগ প্রসাধনী ব্যবহার করেছে। তারা ধর্মকর্ম থেকে শুরু করে সামাজিক অনুষ্ঠান প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাজগোজ করেছে। এখনকার দিনে মেয়েরা যেমন প্রসাধনী ব্যবহার থেকে শুরু করে সব ধরনের সাজসজ্জায় অগ্রগামী, প্রাচীন মিসরে এক্ষেত্রে কোনো লিঙ্গভেদ ছিলো না। অর্থাৎ নারী-পুরুষ সবাই সাজ্জসজ্জাকে সমান গুরুত্ব দিয়েছে।
মিসরীয়রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যে তেল ব্যবহার করেছে তা বিশেষ ধরণের খেজুর (Balanites aegyptiaca) থেকে তেরি করা হয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরণের বাদাম, নারকেল, কাজু বাদাম প্রভৃতি থেকেও প্রসাধনী তৈরির তেল নিষ্কাশন করতে দেখা গেছে। এই তেল নিষ্কাশনে যারা নিয়োজিত ছিল অনেক সতর্কতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। বিশেষত, এই তেল তৈরির সময়ে তারা বাধ্যতামূলকভাবে সতর্ক থাকত। কারণ কোনো ধরণের নিম্নমানের উপকরণ সরবরাহে তাদের মৃতুদণ্ডের মতো শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
নানা প্রকারের সুদৃশ্য জারে মিসরীয়রা তাদের প্রসাধনী সংরক্ষণ করত। বিভিন্ন সমাধি থেকে এই ধরণের অনেক জার আবিষ্কার করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। ফলে তাদের ব্যবহৃত প্রসাধনীর পরিমাণ ও প্রকৃতি সম্পর্কেও এখন ধারণা করা সম্ভব হচ্ছে। নাক, চোখ, মুখমণ্ডল এমনকি হাত পায়ে মালিশ করার উপযোগী ক্রিম তৈরিতে হাতির দাঁত, শামুকের খোল চূর্ণ, নানা ফলের বীজ ও তেল ব্যবহৃত হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে এসব নিদর্শন থেকে।
পুরো মধ্যপ্রাচ্যে মিসরের সুগন্ধী বিখ্যাত ছিলো তার অনিন্দ্যসুন্দর সুবাসের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য। গোলাপ থেকে শুরু করে নানা ধরণের স্থলজ ও জলজ ফুল থেকে এই সুগন্ধী নিষ্কাশন করত তারা। পাশাপাশি এর দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণে তারা ফার্মেন্টেশনের মতো নানা উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলো। এক্ষেত্রে হেনা, দারুচিনি, তার্পিন, আইরিশ, লিলি, গোলাপ প্রভৃতি ফুলের পাশাপাশি কিছু ফলের বিচিকে পানি বা তেলে দ্রবীভূত করে সেখান থেকে সুগন্ধী নিষ্কাশন করতে দেখা গেছে।
সুগন্ধী তৈরির উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন ভেষজ উপকরণকে জ্বাল দেয়ার পর সেখান থেকে নানা ধরণের তরল সুগন্ধী বের করে এনেছে। তবে তারা যে ক্রিমগুলো তৈরি করেছে সেখানে নানা ধরণের উপাদান চূর্ণ করে তেল বা চর্বি দিয়ে সেগুলোর পেস্ট বানানো হত। এ ধরণের ক্রিম, পারফিউম কিংবা পাউডার জাতীয় প্রসাধনী তৈরি করতে অনেক ক্ষেত্রে প্রায় ২০টি উপাদানও লেগে যেত। Sindya N. Bhanoo অবশ্য মেকআপ ও প্রসাধনীর ব্যবহারে মিসরীয়দের নানা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারেও বর্ণনা করেছেন। তাঁর “Ancient Egypt’s Toxic Makeup Fought Infection, Researchers Say”. শীর্ষক নিবন্ধ থেকে এটা জানা গিয়েছে।
সরাসরি এখনকার মতো সাবান তৈরি করতে না পারলেও হাত, পা ও মুখমণ্ডল ধোয়ার উপযোগী নানা প্রসাধনী আবিষ্কার করেছিলো মিসরের রসায়নবিদরা। সুগন্ধীযুক্ত এই সব উপকরণ ত্বক মোলায়েম রাখার পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন অনুভূতি আনার ক্ষেত্রে বেশ সক্ষম ছিল। এই ধরণের উপাদান তারা খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ১৫০০ বছর আগে তৈরি করেছিলো বলে জানা গেছে। একইভাবে তারা পায়ের যত্ন নিতে নানা ধরণের উপাদান ব্যবহার করেছে। বিশেষ করে, মরুর দেশ মিসরের ধুলাবালি থেকে নিজেদের পা রক্ষা করতে এবং পা-ফাটা প্রতিরোধে তারা নানা ধরণের ক্রিম ব্যবহার করেছে।
হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে দেখা যাচ্ছে- প্রাচীন মিসরে অনেকগুলো লন্ড্রি ছিলো যেখানে কাপড় পরিষ্কার করা হতো। এখনকার সময়ের সোডা এবং ডিটারজেন্টের মতো নানা উপাদান তখনই ব্যবহার করতে শিখেছিলো মিসরীয়রা। চুলের গড়ন ও আকৃতি সুন্দর রাখতে নানা ধরণের তেল ব্যবহার করেছে মিসরীয়রা। পাশাপাশি কেশবিন্যাসে কাজে লাগিয়েছে নকশা করা অনিন্দ্যসুন্দর সব চিরুণী। অন্যদিকে খুশকি ও চর্মরোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে অনেকে মাথার পাশাপাশি পুরো শরীরের লোম পর্যন্ত কামিয়ে ফেলেছে এমন প্রমাণও রয়েছে। David P. Silverman এর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত প্রখ্যাত গ্রন্থ Ancient Egypt থেকে এই বিষয়গুলোর ধারণা পাওয়া গিয়েছে।
বিভিন্ন গবেষকের পাশাপাশি খোদ হেরোডোটাস তার ইতিবৃত্তে বর্ণণা করেছেন মিসরীয়রা কিভাবে হাত ও পায়ের নখের যত্ন নিয়েছে। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে- হাত ও পায়ের নখের যত্ন নিতে মিসরীয়রা আবিষ্কার করেছিলো বিভিন্ন রকম পদ্ধতি। নখ কেটে ছোট করা, মরা নখ তুলে ফেলা, নখের কোণায় বেদনাদায়ক রোগ দেখা দিলে সুন্দর করে কেটে পরিষ্কার করা এর সবাই তাদের আয়ত্বে ছিল।
বর্তমানে এসেও নারীদের পিরিয়ড চলাকালীন নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্ত অদ্ভুত ব্যাপার হলেও সত্য যে এই সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার পদ্ধতি আয়ত্ব করেছিলো মিসরীয়রা। মাসের যে নির্দিষ্ট সময় রজস্রাব নির্গত হত সে সময় পুরুষরা নারীসঙ্গ থেকে নিজেদের নিবৃত রাখতো। তাদের ধারণা ছিলো- এ সময়ের সঙ্গমে হিজড়া এবং বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিতে পারে। এদিক থেকে চিন্তা করে নারীরাও নিজেদের তাদের সঙ্গীদের থেকে দূরত্বে রাখতেন। অন্যদিকে, ধারাবাহিক হতে থাকা রজস্রাব থেকে পোশাককে পরিষ্কার রাখতে তারা অন্তর্বাসের মধ্যে তুলার তৈরি বিশেষ ধরণের প্যাড ব্যবহার করতেন। একে বর্তমানে বহুল প্রচলিত স্যানিটারি ন্যাপকিনের আদি সংস্করণ বলা যেতে পারে।
মিসরের বিভিন্ন গবেষকের প্রচেষ্টায় আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে নিউ কিংডমের লন্ড্রি লিস্ট। এখান থেকে যেহেতু স্যানিটারি টাওয়েলের উল্লেখ পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতে বলা যেতেই পারে, রজস্রাব প্রতিরোধে এগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে নারীরা লিলেনের ভাঁজ করা স্ট্রিপ তাদের পোশাকের নিচে পরতেন। এগুলো রজস্রাবের রক্তপাতে সিক্ত হওয়ার পর ধুয়ে রোদে শুকিয়ে আবার ব্যবহার করা হত। অন্তত Kahun Gynaecological Papyrus থেকে প্রাপ্ত তথ্য এর স্বপক্ষে আরও জোরালো প্রমাণ দিচ্ছে। এগুলোকে পরবর্তীকালে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে যখন ধোয়া হতো তখন বিশেষ তিতা পাতার রস ব্যবহার করা হতো।
এগুলো থেকে অনুমান করা যেতেই পারে- আধুনিক রূপচর্চার পথিকৃৎ ছিলেন প্রাচীন মিশরীয়রা। মিশরের রাজা-রানী, নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব সবাই কমবেশি রূপচর্চা করতেন। বিখ্যাত দুই রানি ক্লিওপেট্রা ও নেফারতিতির কথা আলাদাভাবে বলা যেতে পারে। রানি ক্লিওপেট্রার রূপের রহস্য নিয়ে আজও অনেকের সীমাহীন কৌতূহল। কিন্ত খ্রিস্টপূর্ব ২০৩০ থেকে ১৬৫০ সালের দিকেও ধনী মিশরীয় নারীরা যেভাবে প্রসাধনীর সর্বোচ্চ ব্যবহার করতেন তার থেকে এই রহস্য উন্মোচন সম্ভব। বিভিন্ন উপকথা থেকে জানা গিয়েছে, রানী ক্লিওপেট্রা দৈনিক ২০টির বেশি গাধার দুধ দিয়ে গোসল করতেন।
শুধু দুধে গোসল নয়, ক্লিওপেট্রার সময় অভিজাত নারীদের কাছে দুধ ও মধুর ফেসমাস্কও ছিল বেশ জনপ্রিয়। এর বাইরে তারা বগলের দুর্গন্ধ দূর করতে ব্যবহার করতেন সুগন্ধী ধুপ। আধুনিককালের ডিওডরেন্টের মতো বেশ কিছু উদ্বায়ী পদার্থ, যেমন- কর্পুর কিংবা নিশাদলের সঙ্গে ধূপ মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই ডিওডরেন্ট।
প্রাচীন মিসরের নারীরা তাদের ত্বক নরম ও কোমল করতে ব্যবহার করতেন বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও রাসায়নিকে তৈরি ময়েশ্চারাইজার। আর এক্ষেত্রে কেমিক্যালের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো ফুলের নির্যাস বা সুগন্ধি মশলাযুক্ত তেল। পাশাপাশি, শসার মতো ফল, ডাল বাটা আর গাঁজানো গাছের পাতা ও লতার নির্যাস বেশ গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করতেন তাঁরা।
ত্বকের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি অবাঞ্ছিত লোম দূর করার ব্যাপারেও বেশ সতর্ক ছিলেন মিসরের নারীরা। সাম্প্রতিককালে আবাঞ্ছিত লোম তুলে ফেলতে মূলত বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ও রেজার ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে বিশেষ ক্রিমসহ নানা পদ্ধতিও ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে প্রাকৃতিক মধু আর চিনি মিশ্রণ ব্যবহার করে লোম তুলতে বেশ জনপ্রিয় পদ্ধতির নাম ‘সুগারিং’। মনে করা হয়, রানী কিন্তু ক্লিওপেট্রার আমলেই মিসরীয়রা এই সুগারিং পদ্ধতিতে অভ্যস্থ ছিল। এখনও অনেকে শরীরের অবাঞ্চিত লোম উপড়ানোর জন্য ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক ওয়াক্সিং করেন যার তুলনায় প্রাচীন মিশরীয়দের সুগারিং পদ্ধতি অনেক কম যন্ত্রণার।
প্রাচীন মিসরের নারীরা মেকআপ ও রূপচর্চার যে উপাদান ব্যবহার করতেন সেগুলো রাখার পাত্র ছিল তাদের আভিজাত্যের পরিচয় বহনকারী। তাই মেকআপের উপাদান রাখার পাত্রগুলোও ছিল অনেক সৌখিন কারুকাজের পাশাপাশি মূল্যবান ধাতুর তৈরি। মূল্যবান খনিজ ও কাচ, স্বর্ণ কিংবা পাথরের পাত্রে চমৎকার নকশার মাধ্যমে এই মেকআপের বক্স তৈরি করা হতো। তবে সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী এসব পাত্রের উপাদান ও কারুকার্যের রকমফের হতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাদা, হলুদ, লাল, কমলা, নীল, সবুজ, বাদামী কিংবা ধূসর ক্যালসাইটের তৈরি পাত্রে রাখা হতো বিভিন্ন মেকআপ আর সুগন্ধি। অন্যদিকে কাজল ও আইশ্যাডো রাখতে ব্যবহৃত হতো সিলস্টোন প্যালেট। এগুলোর উপর বিভিন্ন প্রাণীর পাশাপাশি মিসরীয় দেবদেবীর প্রতিকৃতি খোদাই করা থাকতো।
সবুজাভ ম্যালাকাইটের গুঁড়ার সঙ্গে প্রাণীর চর্বি কিংবা অলিভ অয়েল মিশিয়ে তৈরি করা হয় আইশ্যাডো। অনেকক্ষেত্রে তারা ভলকানিক অ্যাশ, চুলার থেকে সংগ্রহ করা কালি কিংবা শিংয়ের গুঁড়োও ব্যবহার করতেন। অন্যদিকে অভিজাতরা পলিশ করা ব্রোঞ্জের আয়নার সামনে বসে রূপচর্চা করতেন। তারা হাতির দাঁতের তৈরি কাঠি দিয়ে প্রথমে চোখে কাজল দিয়ে নিতেন। এক্ষেত্রে কোনো দাসী তাদের সহায়তা করতো। তারপর দেয়া হতো সবুজ রঙের আইশ্যাডো। কিন্ত রানী ক্লিওপেট্রার আইশ্যাডো ছিল নীল রঙের। চোখের উপরে আর নিচের দিকে কালো কাজলের দাগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ পার্থক্য ছিল না।
সৌন্দর্যের পাশাপাশি মরুভূমির ভয়াবহ সূর্যালোক থেকে চোখকে রক্ষা করতে কাজলগুলো উপকারে আসতো। এসব উপাদান যেসব খনিজ থেকে সংগ্রহ করার হতো সেগুলো সীসাযুক্ত। ফলে চোখে কাজল লাগানোর পর আর্দ্রতার সংস্পর্শে সেটি ব্যাকটেরিয়ারোধী হিসেবে কাজ করতো। তবে ভয়াবহ ছিল মিসরীয়দের ঠোঁটসজ্জার লিপস্টিক। এরা লালচে মাটির সঙ্গে প্রাণীর চর্বি বা তেল মিশিয়ে তৈরি করতো লিপস্টিক। রানী ক্লিওপেট্রার লিপস্টিক ছিল নিখুঁত লাল। এজন্য উপযুক্ত রঙ পেতে লাল গুবরে পোকা আর পিঁপড়ার মৃতদেহ শুকিয়ে বানানো হতো বিশেষ পাউডার। এর সঙ্গে ক্লোরিন ও আয়োডিনের তৈরি রঙিন গুঁড়া মেশানোর ফলে তা অনেকসময় হয়ে উঠতো অত্যন্ত বিষাক্ত। এর প্রভাবে অনেক মিসরীয় নারী মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার পাশাপাশি মারা গিয়েছেন এমনও হয়েছে। ‘কিস অব ডেথ’ শীর্ষক জনপ্রিয় সাহিত্যিক শব্দটা খুব সম্ভবত এজন্যই প্রাচীন মিসর থেকেই এসেছিল।
ডিয়ার ভিউয়ার্স, আপনারা বুঝতেই পারছেন, প্রাচীন মিসরের মানুষ প্রসাধনী ব্যবহারের ক্ষেত্রে কতটা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছিলো। অন্তত নিজেদের সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণের পর তারা ত্বকের সৌকর্য বৃদ্ধিতে চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি Menstruation চলাকালে পরিচ্ছন্নতার ব্যপারেও সতর্ক খেয়াল ছিলো তাদের। তাদের বেশিরভাগ প্রসাধনী রাজ পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি উচ্চবিত্তরাই ব্যবহার করেছে। তবে প্রসাধনী ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রাচীন মিসরীয়রা নারী-পুরুষে তেমন ভেদাভেদ রাখেনি। শুধু প্রসাধনী তৈরি ও ব্যবহার নয়, সংরক্ষণ ও বিপণনের ক্ষেত্রেও উপযুক্ত সক্ষমতা অর্জন করেছিল তারা।