খতনার ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রেক্ষাপট বলে বোঝানো কঠিন। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কম-বেশি সবার অভিজ্ঞতা একই। সেই হাজাম, ধারালো বাঁশের চটা আর ভিন্ন অভিজ্ঞতার কিছু গল্প।
দিনের বেলাতেও চারদিক থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটু অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করা। পরিবারের বড়দের থেকে দুই-একজন এসে বাচ্চাটাকে শক্ত করে চেপে ধরে নড়াচড়া সীমিত করে। এরপর দোয়া-দরুদ পড়া শেষ হতেই ধারালো বাঁশের চটাতে হাজামের হ্যাঁচকা টান।
ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্ত জানান দেয়- শিশ্নশীর্ষ থেকে প্রিপিউস নামক অতিরিক্ত চামড়া কাটা পড়ার। যদি এই কথাগুলো বলার পরে লেখার কোনো শিরোনাম না-ও দেওয়া হয়, তাহলেও যে কেউ বুঝে নিতে পারবে আমরা কীসের গল্প বলতে চলেছি।
ইতিহাসে সবসময় এর প্রতি সবার নজর একইরকম ছিল না। ইতিহাসের গোড়ার দিকে রোমান সাম্রাজ্যে খৎনাকে একটি বর্বর প্রথা হিসেবে গণ্য করা হতো। তালমুদের বর্ণনা অনুযায়ী, রোমান সাম্রাজ্যের জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তি টাইটাস ফ্লাভিয়াস ক্লেমেন্স (Titus Flavius Clemens) নিজের খৎনা করে ইহুদী ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। রোমানরা তার এই অপরাধ ক্ষমা করেনি, উপরন্তু, তার অপরাধের শাস্তি হিসেবে রোমান সিনেট তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এই বিষয়টি আমরা জ্যাকব নেসনারের (Jacob Neusner) বর্ণনা (Approaches to Ancient Judaism, New Series: Religious and Theological Studies. Scholars Press. p. 149) থেকে পেয়েছি।
আপনি জেনে আশ্চর্য হবেন যে, আফ্রিকার নানা দেশে প্রচলিত রয়েছে নারীদের খৎনার মতো ভয়ানক কিছু সামাজিক কুপ্রথা, যা নারী হিসেবে জন্ম নেওয়াকেই অভিশপ্ত করে তোলে তাদের কাছে।
পুরুষদের খৎনা যেখানে তাদের ইউরিন ইনফেকশনসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মুক্তি দিতে পারে, এর বিপরীতে নারীদের খৎনা একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। বিবিসি এ ব্যাপারে জানাচ্ছে যে, জাতিসংঘের হিসেবে, বিশ্বের প্রতি ২০ জন মেয়েশিশু বা নারীর মধ্যে একজনের খৎনা করা হয়ে থাকে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় FGM বা ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন। বর্তমান বিশ্বে এরকম বিশ কোটির অধিক নারী রয়েছেন, যাদের আংশিক অথবা পুরো খৎনা অর্থাৎ যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা হয়েছে।
নারীদের এরকম যৌনাঙ্গ কর্তন বন্ধের আহবান জানিয়ে প্রতি বছরের ৬ই ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ দিবস হিসেবে পালন করে জাতিসংঘ। শৈশব থেকে শুরু করে বয়ঃসন্ধিকালের মাঝে এটি করা হয়। কিন্তু এর ফলে নারীদের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে তাদের সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হয়।
আবারও ফিরে আসা যাক বাংলাদেশের আলাপে। আগে এই দেশে হাজামরা তাদের কাজটা করতেন গোপনে। কেউ কেউ পরিচয় বিস্তৃতির জন্য ছাপানো কার্ড বিতরণ করতেন, কিংবা ফোন নম্বর সম্বলিত স্টিকার মেরে রাখতেন বিভিন্ন টি-স্টল কিংবা বাস স্টেশনে।
এখন দিন বদলে গেছে। হাজামদের অনেকে সরাসরি ফেসবুক পেইজ খুলেছেন। কেউ কেউ আবার ইউটিউব চ্যানেল খুলে বসেছেন। ব্যথামুক্ত খৎনা করায় ক্ষেত্রে স্ব স্ব সাফল্য নিয়ে তারা সেখানে নিয়মিত ভিডিও আপলোড করে যাচ্ছেন।
খৎনারও যে সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে সেটা ইতালীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন চিকিৎসক পিটার রেমন্ডিনো (Peter Charles Remondino) গোটা একটা বই লিখে ফেলার আগে কেউ অনুমান করতে পারেনি। তিনি তাঁর বইতে (History of Circumcision from the Earliest Times to the Present) দেখিয়েছেন খৎনার ঐতিহাসিকতা।
নামের মতোই বিশাল এই বইয়ের সারবস্তু। প্রায় সাড়ে তিনশত পৃষ্ঠার এই বইটি গুণে গুণে ২৫টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। আর সেখানে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় খৎনা সম্পর্কিত নানা বিষয় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ইতিহাসপ্রেমী চিকিৎসকের সুলেখনী আর অনুপম দক্ষতায়।
বইয়ের শুরুতেই মঁশিয়ে ভলতেয়ারের রেফারেন্সে (“Letters of Certain Jews to Monsieur Voltaire, Containing an Apology for their own People.” Pages 451-476. Translated by Dr. Lefann. Philadelphia, 1848.) পিটার রেমন্ডিনো আলোচনা করতে চেয়েছেন কতটা সময় আগে থেকে কীভাবে এই খৎনা মানব সভ্যতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে গিয়েছে। এখানে তিনি শুরুর গল্পটা বলতে চেয়েছেন এপিস্কোপ্যালিয়ান (Episcopalians) তথা এপিস্কোপ্যাল চার্চ (Episcopal Church) থেকে। এই চার্চের সঙ্গে সম্পর্কিত জনৈক ফ্রটিংহ্যামের (Frothingham) বর্ণনা সামনে রেখে তিনি উল্লেখ করেছেন- ফিনিশীয়রা প্রথম এই খৎনার প্রচলন ঘটিয়েছিল। তারপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিহাস ও সভ্যতার গল্পে খৎনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গিয়েছে।
মুসলিমরা বিশ্বাস করে- হযরত ইবরাহিম আঃ সর্বপ্রথম এই কাজ করেছিলেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইবরাহীম (আঃ) আশি বছরোর্দ্ধ বয়সে খতনা করেন। তিনি কাদূম নামক স্থানে খতনা করেন। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, ’কাদুম’ একটি জায়গার নাম।” (বুখারী, মুসলিম)
খ্রিস্টানরা হযরত ইবরাহিম আঃ-কে তাদের অন্যতম নেতা আব্রাহাম মনে করে। ওল্ড টেস্টামেন্ট তথা বাইবেলের আদিপুস্তকে খৎনাকে ঈশ্বরের সাথে আব্রাহামের একটি চুক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে (Gen 17:10)। ইসলামের নবী হযরত ইবরাহিম আঃ-এর সঙ্গে এই সূত্র মিলে যায়।
তবে বিবর্তনবাদী ইতিহাস গবেষকরা এই ঐতিহাসিক মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করেতে চেয়েছেন। কারণ তারা সৃষ্টিতত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে নিজেদের মতো করে নানাবিধ ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন। তাদের হিসেবে- আব্রাহাম বাইবেলীয় একটি চরিত্র ছাড়া আর কিছু নন।
গল্পে গল্পে ইতিহাস বলে বেড়ানো গ্রিক গল্পকথক হেরোডোটাস মনে করেন, “খৎনা প্রথা প্রথম চালু হয় মিশরীয়দের মধ্যে, তাদের দাসপ্রথা চালুর সময়ে।” তবে ১৯ শতকের একটি নৃতত্ত্ব ও ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় একটু অন্যরকম প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তারা দাবি করেছে, “অনেক সেমিটিক গোত্রসহ ইহুদি, আরব এবং ফিনিশীয় জাতির মধ্যে একটি সাধারণ প্রথা হিসেবে খৎনার প্রচলন ছিল।”
প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ (Pacific Archipelago) থেকে আমেরিকার নানা দেশে খৎনার প্রচলন হয় বলে অনেক গবেষক দাবি করেছেন। তাদের হিসেবে এসব অঞ্চলের মধ্যে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ (Solomon Islands), বিসমার্ক দ্বীপ (Bismarck Archipelago), হাওয়াই (Hawaiian Islands), মারিয়ানা (Mariana Islands), গালাপাগো (Galápagos Islands), মালয় (Malay Archipelago), ক্যারোলিন (Caroline Islands), জাপানি দ্বীপপুঞ্জ (Japanese archipelago), কিরিবাতি (Kiribati), জুয়ান ফার্নান্দেজ (Archipielago Juan Fernandez), কুরিল (Kuril Islands), মাইয়াকো (Miyako Islands), ঔসুমি (Ōsumi Islands), সুন্দ্রা (Sunda Islands), ওল্লাস্টন (Wollaston Islands), ইজু (Izu Islands), ভলকানো দ্বীপ (Volcano Islands), বনিন (Bonin Islands), কার্মাদেক (Kermadec Islands), আলেক্সান্ডার (Alexander Archipelago), সান জুয়ান (San Juan Islands), সান্তা ক্রুজ (Santa Cruz Islands), কোদিয়াক (Kodiak Archipelago) এবং লাইন আইল্যান্ড (Line Islands) এর পাশাপাশি সামেয়ার (Samoan Islands) নানা এলাকায় বেশ জনপ্রিয় ছিল খৎনা পদ্ধতি। তারা বিভিন্ন আদিবাসী রীতি নীতি মেনে এই খৎনাকে বছরের পর বছর পালন করে আসছিল।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় খৎনা করার পর লিঙ্গাগ্রভাগের ত্বকের ক্ষত শুকিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করা হয়। তারপর বিচিত্র আয়োজনে এক বিস্তৃত অনুষ্ঠান পালন করা হয়। ওখানকার পরিস্থিতিও ছিল অনেকটা অমন।
ইহুদি ধর্মবিশ্বাস এই খৎনাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। যদিও, ইহুদি ধর্ম ও ইসলামী ঐতিহ্য উভয় ক্ষেত্রেই খৎনাকে অন্য গোষ্ঠী থেকে নিজেদের আলাদা করে চেনার উপায় হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। বিশেষত, তাদের এক্সোডাসের মিশর অংশের (The Exodus) গণখৎনাকরণ কিংবা ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনীতে (Old Testament; Genesis 30:21; 34; 46:15) এর বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। তখনকার সামাজিক পরিস্থিতিতে কাউকে ইহুদি হিসেবে পরিচিতি পেতে এই খৎনা আবশ্যিক ছিল।
বাইবেলের আদিপুস্তকেও খৎনা সম্পর্কে নানা তথ্য সন্নিবিষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে, ইহুদিরা কোনো যুদ্ধে জিতে গেলে যুদ্ধ শেষে তারা শত্রুদের মৃতদেহ থেকে লিঙ্গের অগ্রভাগের চামড়া কেটে ফেলতো। তারা মৃতদেহের এমন খৎনা করানোর মূল কারণ শত্রুপক্ষের নিহত সৈন্যসংখ্যার হিসাব রাখা। পাশাপাশি, ইহুদীরা তাদের প্রতিটি পরিবারের সবার খৎনা করত। তারা তাদের অধীনে থাকা দাসদেরও খৎনা থেকে বাদ রাখেনি। তাদের এই অদ্ভুত অনুশীলন পরবর্তীকালে রোমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রচলিত আইনের সাথে তাদের বিরোধের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, তৎকালীন হেলেনীয়রা খৎনাকে সমর্থন করতে পারনি।