শতবর্ষের যুদ্ধ নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
শতবর্ষের যুদ্ধ প্রতিবেশী ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যকার একশো বছরের কিছু বেশি সময় ধরে চলা সংঘর্ষের পোশাকি নাম। উনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহাসিকেরা আলোচনার সুবিধার্থে এই নামের প্রবর্তন করেন।
অনেক কারণের মধ্যে প্রধান দুটি কারণ কাজ করে এই যুদ্ধের পেছনে: বিভিন্ন সময়ে ফ্রান্সের কিছু অঞ্চল ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের অধিকারে চলে আসে, যার ওপর ফরাসি রাজার শ্যেনদৃষ্টি ছিল। এছাড়া, ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ চার্লসের (Charles IV) পরিবারে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে ফরাসি সিংহাসনে তৈরি হয় ইংল্যান্ডের রাজাদের দাবি, যা হজম করা কষ্টকর হয়ে পড়ে ফরাসিদের পক্ষে।
আনুষ্ঠানিকভাবে ১৩৩৭ সালের ২৪ মে ফরাসি রাজা ষষ্ঠ ফিলিপ (Philip VI) ফ্রান্সের ভূখণ্ডে ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন গিয়েন (Guyenne) ডাচি দখলের মাধ্যমে সূচনা করেন লড়াইয়ের, যা চলতে থাকে ১৪৫৩ সাল অবধি। তবে জমিজমার দখল নিয়ে সংঘাত আসলে আরম্ভ হয় দ্বাদশ শতকেই।
কিন্তু ঠিক কী করে ইংল্যান্ডের রাজা ফ্রান্সের জমির দখল পেলেন? এজন্য ফিরে যেতে হবে ১০৬৬ খ্রিষ্টাব্দে। ইংল্যান্ডের সিংহাসনের দাবিতে হ্যাস্টিংসের (battle of hastings) পাহাড়ি এলাকায় নরম্যান্ডির ডিউক উইলিয়াম দ্য কংকারার (william the conqueror) মুখোমুখি হন অ্যাঙলো-স্যাক্সন রাজা হ্যারল্ডের (Harold Godwinson)। বিজয়ী উইলিয়াম ইংল্যান্ডের রাজা হলেন বটে, কিন্তু নরম্যান্ডির ডিউক হিসেবে ফরাসি রাজার প্রতি আনুগত্যের শর্ত জারি থাকলো তার ও তার বংশধরদের জন্য।
১১৫৪ সাল; ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হেনরি (Henry II) প্রতিষ্ঠা করেন প্ল্যান্টাজেনেট (House of Plantagenet) রাজবংশের। তার পূর্বপুরুষ ফ্রান্সের অ্যাঞ্জুর কাউন্টের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি পান ফ্রান্সের অ্যাকুয়াটাইনসহ বিশাল এলাকা, যার নাম অ্যাঙ্গেভিন সাম্রাজ্য (Angevin Empire)। তবে সাম্রাজ্য হলেও শাসকেরা ছিলেন ফরাসী সম্রাটের আজ্ঞাধীন কাউন্ট।
রাজা তৃতীয় হেনরি (Henry III) পরবর্তীতে ফরাসি রাজা নবম লুইয়ের (Louis IX) সাথে প্যারিস চুক্তি করে আপাতদৃষ্টিতে একটা সমাধান করে নেন, তবে তাকে মেনে নিতে হয় ফরাসী রাজার প্রতি আনুগত্যের শর্ত।
ফ্রান্সে প্ল্যান্টাজেনেটদের ভূসম্পত্তিতে ক্রমাগত ফরাসি হস্তক্ষেপ দু’পক্ষের মধ্যে সৃষ্টি করে উত্তেজনা। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয় ১৩২৮ সালে ফরাসি রাজা চতুর্থ চার্লসের মৃত্যুর পর। তার পুত্রসন্তানের অভাবে সিংহাসনের দাবি করেন ভাতিজা ইংল্যান্ডের তৃতীয় এডওয়ার্ড (Edward III), এবং ভ্যালোইসের কাউন্ট ফিলিপ। নিজেদের রাজা হিসেবে কোনো ইংরেজকে দেখতে অনিচ্ছুক ফরাসিরা ফিলিপকে (Philip VI) নির্বাচন করে রাজা হিসেবে। এতে দুই পক্ষের সম্পর্ক আরো খারাপ হয়।
১৩৩৭ সালে ফিলিপ ও এডওয়ার্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় ভাড়াটে নৌযোদ্ধা বা প্রাইভেটিয়ারদের মধ্যে লড়াই দিয়ে মূল সংঘাতের সূত্রপাত হয়। ১৩৩৮ সালে তৃতীয় এডওয়ার্ড ফ্রান্সের প্রতিবেশী ফ্ল্যান্ডার্সের সাথে মিত্রতা করেন, সেখানে ঘাঁটি গাড়েন ফিলিপের বিরুদ্ধে অভিযানের উদ্দেশ্যে। ফিলিপ ওদিকে কাস্টিল আর জেনোয়াকে দলে টেনে নেন। ১৩৪১ সালে ব্রিটানি ঘিরে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে সবাই, তবে দুই বছরের মাথায় পোপের হস্তক্ষেপে সমঝোতা হয়।
১৩৪৬ সালে ফ্রান্সের ক্রেসিতে (battle of crecy) এডওয়ার্ডের হাতে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় ফরাসি সেনাদল। সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেন তিনি। এরপর বড় আকারে দুই দলের সংঘর্ষ ঘটে ১৩৫৬ সালে, যখন পয়তিয়ের্সের (battle of poitiers) ময়দানে ইংল্যান্ডের যুবরাজ এডওয়ার্ড দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স (Edward the black prince) শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করেন ফরাসি রাজা জনের দলকে।
বন্দী হন জন। ১৩৫৯ সালে লন্ডনের দ্বিতীয় চুক্তির মাধ্যমে জন নিজের স্বাধীনতার বিনিময়ে সমর্পণ করে দেন ফরাসি অনেক ভূখণ্ড।
এরপর বেশ কয়েক দশক অভ্যন্তরীণ ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে দুই দল। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় রিচার্ড (Richard II) বিরোধিতার সম্মুখীন হন চাচা জন অব গন্টের (John of Gaunt) ল্যাঙ্কাস্টার (House of Lancaster) পরিবার থেকে। গন্টের ছেলে হেনরি (Henroy of Bollingbrook) ১৩৯৯ সালে তাকে উৎখাত করে চতুর্থ হেনরি নামে ক্ষমতা নেন। তার ছেলে পঞ্চম হেনরি (Henry V) ফরাসিদের সামনে দেখা দেন মুর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে।
এদিকে ১৪০৭ সালে ফরাসি সিংহাসনের দাবিদার লুই অব অর্লিয়েন্স (Louis of Orleans) নিহত হলে তার সমর্থক আর্মেনাকস (Armagnacs) আর প্রতিপক্ষ বারগ্যান্ডিয়ানদের (Burgundians) মধ্যে আরম্ভ হয় গৃহযুদ্ধ (The Armagnac–Burgundian Civil War)।
দুই পক্ষই ইংল্যান্ডের সাহায্য প্রার্থনা করে। এই বিভেদ কাজে লাগিয়ে পঞ্চম হেনরি ফ্রান্সে অভিযান চালান। ১৪১৫ সালে এজিনকোর্টে (Battle of Agincourt) বিধ্বস্ত হয় ফরাসিরা। হেনরির সুদক্ষ তীরন্দাজ, বা লংবোম্যানদের (Longbowmen) হাতে নাকাল হয় ফরাসি নাইটরা। মূলত এই লংবোম্যানদের সাহায্যে পরবর্তী বহু বছর ফরাসি সেনাদের নাকানিচুবানি খাইয়ে যায় ইংরেজরা।
১৪১৭ সালে হেনরি আবার ফিরে আসেন ফ্রান্সে, বিভক্ত ফরাসিদের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে দখল করে নিতে থাকেন একের পর এক শহর। এদিকে, ১৪১৯ সালে বারগ্যান্ডিয়ানদের নেতা জন দ্য ফিয়ারলেস (John the Fearless) প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হলে তার ছেলে ফিলিপ দ্য গুড (Philip the Good) প্রকাশ্যেই পঞ্চম হেনরির প্রতি সমর্থন দেন।
বাধ্য হয়ে ফরাসি রাজা ষষ্ঠ চার্লসের (Charles VI) পক্ষে রানী ইসাবেল (Isabeau of Bavaria) ১৪২০ সালে ট্রইসের চুক্তি (Treaty of Troyes) করেন। যুবরাজ চার্লসের পরিবর্তে হেনরি ও তার বংশধরেরা নির্বাচিত হন পরবর্তী ফরাসি রাজা হিসেবে, তিনি বিয়ে করে নেন রাজকন্যা ক্যাথেরিনকে (Catherine of Valois)। প্যারিসের দখল নেন তিনি। যুবরাজ ও তার আর্মেনাকস সমর্থকরা অবশ্য চুক্তির বিপক্ষে গিয়ে লড়াই জারি রাখেন।
হেনরি বেঁচে থাকলে সম্ভবত বিরোধিতা একেবারেই উৎপাটন করে ফেলতেন। তরুণ রাজা ফ্রান্সের ষষ্ঠ চার্লসের পর সিংহাসনে বসবেন এমনটাই আশা ছিল সবার।কিন্তু ১৪২২ সালে তিনি মারা গেলে হিসেবনিকেশ ওলটপালট হয়ে গেল। নাবালক রাজা ষষ্ঠ হেনরির হয়ে দায়িত্ব নেন চাচা ডিউক অব ব্র্যাডফোর্ড (Duke of Bradford)।
একই বছর ষষ্ঠ চার্লসের মৃত্যু হলে ফরাসি যুবরাজ নিজেকে সপ্তম চার্লস (Charles VII) হিসেবে ঘোষণা করেন। ব্র্যাডফোর্ডের সাথে আলোচনা ভেস্তে গেলে তার সৈন্যরা চার্লসের সমর্থকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। চার্লসের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা দ্রুত ছোট হয়ে আসতে থাকে। ১৪২৮ সালে ব্র্যাডফোর্ডের লোকেরা ঘিরে ফেলে অর্লিয়েন্স শহরে তার শক্ত ঘাঁটি। দীর্ঘ অবরোধে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে শহরবাসী।
ঠিক এই সময়েই ঘুরে যায় শতবর্ষের যুদ্ধের মোড়। ফ্রান্সের ছোট্ট এক গ্রাম ডমরেমির কৃষককন্যা জোয়ান (Joan of Arc) দাবি করেন- ঈশ্বর তাকে চার্লসের ন্যায্য উত্তরাধিকার ফিরিয়ে দিতে পাঠিয়েছেন। যেকোনোভাবেই হোক, স্বয়ং চার্লসের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সফল হন তিনি। তার অধীনে অর্লিয়েন্সে পাঠানো হয় নতুন সেনাদল। নতুন উদ্যমে চাঙ্গা হয়ে ওঠে ফরাসিরা। দলে দলে মানুষ সমবেত হয় চার্লসের পতাকাতলে।
অর্লিয়েন্সের অবরোধ ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর আরো বেশ কিছু পরাজয়ের পর পিছু হটে ইংল্যান্ডের সেনারা। রেইমস (Reims) শহর কব্জা করে সেখানে ঐতিহ্য অনুযায়ী চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন জোয়ান। ফরাসিদের চোখে তিনি তখন ত্রাতা, আর ইংরেজদের চোখে সাক্ষাৎ ডাইনি।
১৪৩০ সালে বারগ্যান্ডিয়ানদের হাতে ধরা পড়েন জোয়ান। সপ্তম চার্লস তার মুক্তিপণের উদ্যোগ নেননি। সেই অবসরে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ফিলিপ দ্য গুডের কাছ থেকে জোয়ানকে কিনে নেয় ইংরেজরা। তাদের ধর্মীয় আদালতে বিচার হয় জোয়ানের। ধর্মদ্রোহীতা এবং অন্যান্য নানা অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাকে। ১৪৩১ সালের ৩০ মে উনিশ বছরের জোয়ানকে নরম্যান্ডির রাজধানী রু-অ’তে (Rouen) জনসমক্ষে পুড়িয়ে মারা হয়। পরবর্তীতে ক্যাথলিক চার্চ তাকে সেইন্ট জোয়ান অব আর্ক নামে সম্মানিত করে।
তবে ফরাসিদের অগ্রযাত্রা বন্ধ করতে ব্যর্থ হন ব্র্যাডফোর্ড। হাওয়া কোনদিকে বইছে বুঝে বারগ্যান্ডিয়ান নেতা ফিলিপ দ্য গুড সপ্তম চার্লসের সাথে সন্ধি করে গৃহযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটান। ১৪৩৬ সালে প্যারিস তার দুয়ার খুলে দেয় চার্লসের সামনে।
১৪৪৪ সালে ষষ্ঠ হেনরি ফরাসিদের সাথে অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষর করেন। ফরাসি অভিজাত মার্গারেট অব অ্যাঞ্জুর (margaret of anjou) সাথে বিয়ের মাধ্যমে মেনে নেয়া হয় সাম্যাবস্থা। মেইন, ক্যালাইসসহ ফ্রান্সের বেশ কিছু অংশ ধরে রাখে ইংল্যান্ড। চার্লস অবশ্য বিরতির সুযোগে নিজের সৈন্যদল ঢেলে সাজান, উদ্দেশ্য ইংল্যান্ডকে হটিয়ে পুরো ফ্রান্সে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
দ্রুতই চুক্তি ভেঙ্গে নরম্যান্ডি আক্রমণ করে তারা। ব্রিটানির ডিউকের সহায়তায় ১৪৪৯ সালে পতন ঘটে রু-অ’র। ১৪৫০ সালে ব্যাটল অব ফর্মিওনি’র (battle of formigny) পর ফ্রান্সে ইংল্যান্ডের সেনাশক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসে। ১৪৫১ সালে বোর্দোর (Bordeaux) পতনের পর একদমই কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা।
তবে বোর্দোবাসী ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ১৪৫২ সালে ইংল্যান্ড থেকে সেনা নিয়ে আর্ল ট্যালবট (John Talbot, 1st Earl of Shrewsbury) চলে আসেন সেখানে, ফরাসিদের হটিয়ে পুনরুদ্ধার করেন শহর। তার মোকাবেলা করতে বড় একটি বাহিনী গঠন করেন চার্লস।
ততদিনে কামানের প্রযুক্তি বেশ উন্নত হয়েছে। ফরাসিরা নিজেদের সেনাদলে পর্যাপ্ত কামান সংযুক্ত করলেও ইংরেজ বাহিনী তখনও মূলত নির্ভরশীল তাদের লংবোম্যানদের উপর। ফলে ১৪৫৩ সালে ব্যাটল অব ক্যাস্টিলিয়নে (battle of castillon) কামানের গোলায় বিধ্বস্ত হলো তারা, মারা পড়লেন সেনাপতি ট্যালবট। মূলত এখানেই শেষ হয় শতবর্ষের যুদ্ধ।
ক্যালাইস ছাড়া ফ্রান্সের পুরোটাই এরপর চলে গেলো চার্লসের হাতে। ইংল্যান্ডে তখন চলছে বিবাদ, সিংহাসনের দাবিতে ইয়র্ক আর বিউফোর্ট (house of york and beaufort) পরিবার মুখোমুখি। কাজেই চূড়ান্ত কোনো চুক্তি হলো না। চার্লসও ক্যালাইস ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। তার ছেলে নবম লুই (Louis ix) ১৪৬৩ সালে অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষর করেন, পরবর্তীতে সেটা নবায়ন হতে থাকে। দুই পক্ষ আস্তে আস্তে নিজেদের মতৈক্য মিটিয়ে নেয় আলোচনার টেবিলে।
শতবর্ষের যুদ্ধের প্রভাব ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী। সামরিক কৌশলে নানা উন্নতি সাধিত হয় এ সময়। ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের পরবর্তী কয়েক শতাব্দীব্যাপী দ্বৈরথের সুচনাও হয় এখানে। মজার ব্যাপার হলো, যুদ্ধের শেষ থেকে আরো প্রায় দু’শতাব্দী ফ্রান্সের ক্যালাইস ছিলো ইংল্যান্ডের হাতে, সেই হিসেব কষলে কিন্তু যুদ্ধের সময়সীমা বেড়ে যায় আরো অনেক!