গাঁজার ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেল পড়ুন
চিরচেনা নেশাদ্রব্য, চলতি বাক্যালাপের হেরফের, কিংবা একটু উদ্ভট কিছু সামনে আসতেই যে নামটি সবার আগে উচ্চারিত হয় তা হলো ‘গাঁজা’। নির্ঘুম রাত শেষে আপনার লাল লাল চোখ আর উষ্কোখুষ্কো চুল দেখে যে কেউই বলে উঠতে পারে, “কীরে! গাঁজা খাইছোস? তোর চোখ এমন ক্যা!” আর জনপ্রিয় ব্যান্ড সংগীতের লাইনটা তো আছেই!
নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বরাবরই বেশি। তাই গাঁজা নামটি শুনলে সবার চোখ কপালে ওঠা শুরু হয়েছে ১৯৯০ সালের দিক থেকে। মনে করা হয়, ১৯৮৭ সালে পশ্চিমা একটি সিগারেট কোম্পানির বাজার ধরা সহজ করতে বাংলাদেশে গাঁজাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
পাশাপাশি, আইন পাস করে গাঁজার বিরুদ্ধে সামাজিক অবস্থান তৈরির প্রচারণা চলতে থাকে। বছর দশেকের মধ্যে গাঁজার সামাজিক অবস্থান গিয়ে ঠেকে একদম তলানিতে। বলতে গেলে এর সোশ্যাল ক্রিমিনালাইজেশন প্রক্রিয়া এক অর্থে সফলতার দেখা পায়।
বাংলাদেশে অনেকে গাঁজাকেই সিদ্ধি বলে। তবে ভাং বা হাশিশকে গাঁজা বলে কেউ কেউ ভুল করে। ভাং হলো গাঁজা পাতা আর হাশিশ গাছের কষ থেকে উৎপাদিত বিশেষ ধরনের মাদক।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হলে গাঁজার পরিচয় মারিজুয়ানা, ঠিক এই কাজ সুতা তৈরিতে কাজে লাগলে তাকে বলা হেম্প।
প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস গবেষকদের ধারণা- মিসর, মেসোপটেমিয়া, আর চীনের মানুষ সবার আগে গাঁজার ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে গাঁজার বীজ নেশাদ্রব্য হিসেবে গ্রহণ করা শুরু হয়। তবে বিতর্ক রয়েছে এর উৎপাদন ও আদি নিবাস নিয়ে। চীনকে এর প্রাথমিক আবাস হিসেবে মনে করা হলেও অনেকে বাগড়া দিয়ে দাবি করেছেন মিসর আর মেসোপটেমিয়ার নাম। আবার সেখানে তারা নানা যুক্তিও তুলে ধরেছেন।
প্রাচীন মিশর
প্রাচীন মিশরীয়রা নানা প্রকার রোগের ওষুধ হিসেবে গাঁজার ব্যবহারকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। প্রায় ৩,৫০০ বছর আগে রচিত Ebers Papyrus থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন রোগ ও আঘাত থেকে সৃষ্ট ব্যথা ও জ্বালাপোড়া প্রশমনে মিশরে ওষুধ হিসেবে গাঁজার প্রচলন ছিল। বিষণ্নতাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যার পরিত্রাণে মিশরীয় নারীরা গাঁজার দ্বারস্থ হতেন।
যৌনতৃপ্তি আর সম্ভোগকে আরও উপভোগ্য আর দীর্ঘস্থায়ী করতে প্রাচীন মিশরের নারীরা তাদের যৌনাঙ্গে প্রয়োগ করতেন গাঁজা মেশানো মধু। উদ্দেশ্য ছিল ‘জরায়ু আর যোনিপথকে ঠাণ্ডা রাখা’।
যা-ই হোক, এখন থেকে আনুমানিক ৪,০০০ বছর আগে মিশরের চিকিৎসকরা গ্লুকোমা, ছানি, অর্শ, যোনিপথে রক্তপাত, এমনকি ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও এই গাঁজা ব্যবহার করতেন। আধুনিককালের গবেষকদের অভিমত হলো, ওষুধ হিসেবে গাঁজা এই রোগগুলো সারাতে না পারলেও উপসর্গ কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে পারত।
এখন থেকে প্রায় ৩২০০ বছর আগে মিশরে রাজত্ব করে গেছেন ফেরাউন ২য় রামেসিস, যিনি রামেসিস দ্য গ্রেট নামেই অধিক পরিচিত। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তার মমির সন্ধান পাবার পর পরীক্ষানিরীক্ষা করে বিজ্ঞানীদের চোখ কপালে উঠেছিল। কেন? কারণ তার সেই মমিতেও গাঁজার অবশিষ্টাংশের সন্ধান মিলেছিল। পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত আরও অনেক মমিতেই এর সন্ধান পাওয়া গেছে। এখান থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মনে করেন যে, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার এক উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল এই গাঁজা।
প্রাচীন মিশরে লেখালেখি, মাপজোখ, এবং সামগ্রিকভাবে জ্ঞানের দেবী হিসেবে মনে করা হতো সেশাতকে। তার মাথার উপর আপনি গাঁজার পাতার প্রতীক দেখতে পাবেন। বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের সময় পুরোহিতরা যে গাঁজায় সুখটান দিতেন, সেটারও প্রমাণ মিলেছে বিভিন্ন সময়।
প্রাচীন চীন
গাঁজা চাষ ও ব্যবহারে এককাঠি সরেস চীনারা। তারা নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি গাঁজা গাছ থেকে কাগজ উৎপাদনও শুরু করেছিল। পাশাপাশি, গাঁজার আঁশ থেকে তারা তৈরি করতো সুতা, পাকানোর মাধ্যমে সেই সুতলি থেকে দড়িও তৈরি করেছে তারা।
শল্যচিকিৎসার সময় অনুভূতিনাশক হিসেবে চীনে বহু আগে থেকেই মারিজুয়ানা ব্যবহার করা হচ্ছে। ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনা সম্রাট শেন নং লিখিত পেন সাও চিং নামক এক চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় চীনে। সেখানে এই অনুভূতিনাশের বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি ব্যথা ও জ্বালাপোড়া কমানো এবং ক্ষতস্থান দ্রুত সারিয়ে তোলার ব্যাপারেও এর ব্যবহারের কথা লেখা রয়েছে।
প্রাচীন ভারত
স্বর্গীয় অনুভূতি লাভের আশায়, দেবতার নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় প্রাচীন ভারতে অনেক আগে থেকেই ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নানা আচার-অনুষ্ঠানে মারিজুয়ানা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে কেবলমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেই নয়, এর পাশাপাশি চিকিৎসাক্ষেত্রেও এর ব্যবহার ছিল। বিভিন্ন রকমের ব্যথা, নিদ্রাহীনতা, এবং দুশ্চিন্তা নিরসনে বহু আগে থেকেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে এই অঞ্চলে।
প্রাচীন গ্রীস
চিকিৎসাক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনে প্রাচীন গ্রীসের লোকজন ইতিহাসে বেশ নামকরা। গ্রীক চিকিৎসক গ্যালেনের লেখা থেকে জানা যায় কীভাবে তারা মারিজুয়ানা ব্যবহার করে নাক থেকে রক্ত পড়ার চিকিৎসা করত। তবে, এই উদ্দেশ্যে কেবলমাত্র গ্রীকরাই না, বরং রোমান ও অন্যান্য সভ্যতার লোকেরাও মারিজুয়ানা ব্যবহার করেছে।
প্রাচীন রোম
প্রাচীন রোমের লোকজন গাঁজা দিয়ে চিকিৎসা যেমন করেছে, তেমনই এতে সুখটান দিয়ে নেশার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার কাজও তারা করেছে। রোমান প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্লিনি দ্য এল্ডারের লেখা থেকে কানের ব্যথা ও গেঁটেবাতের চিকিৎসায় গাঁজার ব্যবহারের কথা জানা যায়। ওদিকে, ঘুমের ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার ছিল এর। সেক্ষেত্রে অবশ্য একে অন্য আরও কিছু ঔষধি গাছের সাথে মিশিয়ে নেয়া হতো।
মধ্য এশিয়া
মধ্য এশিয়াতেও ধর্মীয় আচার পালন এবং নেশা উভয় উদ্দেশ্যে গাঁজা ব্যবহৃত হয়েছে।
সাইথিয়ানদের কথাই ধরা যাক। তারা ধর্মীয় আচার পালনের জন্য এই গাছের শুকনো পাতা ও ফুল চূর্ণ থেকে প্রাপ্ত ধোঁয়া টেনে নিত, যা তাদের নেশার জগতে নিয়ে যেত। তাদের বিশ্বাস ছিল- এর মাধ্যমে তারা আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করতে পারে। পাশাপাশি মাথাব্যথা, দাঁতব্যথা, এবং প্রসবকালীন ব্যথা প্রশমনেও তারা গাঁজা ব্যবহার করত।
সগডিয়ান সভ্যতার লোকেরা আবার ভিন্ন ধাঁচের কাজ করেছে। তারা ধর্মীয় আচার পালনের পাশাপাশি গাঁজাকে সরাসরি মুদ্রা হিসেবেও ব্যবহার করেছে। রেশম, মশলা ও বিভিন্ন মূল্যবান পাথরের জন্য তারা চীনা ও ভারতীয়দের সাথে গাঁজার মাধ্যমে বাণিজ্য করেছে। গেঁটেবাত, বাত, এবং শল্যচিকিৎসার সময় ব্যথা থেকে মুক্তির জন্য তারা গাঁজার দ্বারস্থ হতো। জানা যায় যে, তারাই এই গাছের নাম দিয়েছিল ‘ক্যানাবিস’, যার অর্থ ‘ব্যথা থেকে মুক্তির মাধ্যম’।
নেশা, ধর্ম, চিকিৎসার পাশাপাশি গাঁজার প্রভাব থেকে বাদ যায়নি যুদ্ধক্ষেত্রও। সাইথিয়ান আর সারমাশিয়ানরা ভাবত, যুদ্ধে যাবার আগে গাঁজা টানলে তাদের দেহে সুপারহিরোর মতো শক্তি ভর করবে, মন থেকে সব ভয় দূর হয়ে যাবে। ধর্মীয়ভাবেও তাদের কাছে এই চর্চার গুরুত্ব ছিল, কারণ তারা ভাবত যে এর মাধ্যমে যুদ্ধে যাবার আগে তারা দেব-দেবী আর পূর্বপুরুষদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে, তাদের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে পারবে। আপনি যদি ভেবে থাকেন যে শুধুমাত্র পুরুষরাই গাঁজা টানত, তাহলে নেহাত বোকার স্বর্গে বাস আপনার। নারী আর শিশুরাও বাদ যেত না এই সুখটান থেকে!
বাংলা
বাংলায় গাঁজার আবির্ভাব বেশ পরে। তবে অনেক মুনি-ঋষির দাবি, এই বিশেষ গাঁছটি নাকি ৬৫ ধরনের রোগের ওষুধ এবং যৌনশক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে।
বাংলায় গাঁজা চাষ এবং তার রমরমা ব্যবসার তথ্য আমরা পাই প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘যুক্তবঙ্গের স্মৃতি’ থেকে। তিনি এই গ্রন্থের ১০ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
“নওগাঁ মহকুমার সৃষ্টির মূলে গাঁজার চাষ। এটা আগে তিনটি জেলায় ছড়ানো ছিল, পরে প্রশাসনের সুবিধার জন্য একটিমাত্র জেলায় একটিমাত্র মহকুমায় নিবদ্ধ হয়। তারও তিনটিমাত্র থানায়। এমনভাবে গন্ডী দেওয়া হয় যাতে চোরাচালান না হয়। এককালে গাঁজার মণ নাকি ৪০০০ টাকা দামে বিক্রী হতো। কিন্তু সরকারী নিয়ন্ত্রণের দ্বারা তার দাম বেঁধে দেওয়া হয় ২৪০০ টাকা মণ। তার থেকে ২১০০ টাকা সোসাইটি ও সরকার ভাগাভাগি করে নেন। সোসাইটির সভ্য হিসাবে চাষীরাও মুনাফার অংশ পায়। গাঁজার মতো লাভ আর কোনো ফসলেই ছিল না। তাই গাঁজা মহালের চাষীদের মতো সম্পন্ন চাষীও আর কোনো চাষী ছিল না।”
এই ঘটনার সত্যতা মেলে ইতিহাসের পাতায়ও। কারণ ব্রিটিশরা বাংলায় শুধু নীল চাষ করেছিল এমন নয়, তারা প্রচুর গাঁজা নিয়ে গেছে এ অঞ্চল থেকে।
নওগাঁ শহরের স্থানীয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত বেশ বড় তিনতলা একটি ভবনকে এখনও গাঁজা সোসাইটি মার্কেট নামেই ডাকা হয়। লেখক ও গবেষক মো. খোসবর আলী লিখিত নওগাঁ জেলার ইতিহাস এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ শাসসুল আলমের এক প্রবন্ধ (রবীন্দ্র জার্নাল, সংখ্যা-১৫, ২০১৩) থেকে জানা গেছে, প্রধান দপ্তর ভবনসহ এই সমিতির নিজস্ব সম্পত্তির মধ্যে আছে ৪০ একর জমি। আছে ৪০টি দালানকোঠা, একটি হিমাগার, চারটি গোডাউন, একটি সরাইখানা, একটি মিটিং গ্রাউন্ড, তিনটি দাতব্য চিকিৎসালয়, ১১টি উচ্চ বিদ্যালয়, তিনটি মসজিদ, একটি মন্দির, সাতটি বড় পুকুর ও একটি লেক। নওগাঁ সদরের বিভিন্ন জায়গায় এসব সম্পদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে সমিতি বা সরকারি অন্য কোনো সূত্র থেকে সম্পদের পূর্ণ হিসাব পাওয়া যায়নি।
গবেষক শফিকুল ইসলাম জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছিলেন, “নওগাঁয় গাঁজা চাষ কখন, কীভাবে শুরু হয় তার কোনো সুস্পষ্ট দলিল নেই। জনশ্রুতি আছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে যশোর থেকে প্রথম গাঁজার বীজ এনে নওগাঁর তৎকালীন পাঁচুপুর থানায় (বর্তমানে আত্রাই ও রানীনগর পুলিশ স্টেশন) প্রথম গাঁজার চাষ শুরু হয়। গাঁজাকে পাক-ভারতের প্রাচীন কৃষিজাত দ্রব্য বলে মনে করা হয়।”
একসময় আসাম, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, চেন্নাই, এমনকি লন্ডনেও গাঁজা রপ্তানি করা হতো। ১৯১৮ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগপর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫৫ হাজার মণ গাঁজা উৎপাদন করা হতো। এ থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হতো প্রায় ৬৬ লক্ষ টাকা।
গাঁজা গাছ থেকে তৈরি সুতা ব্রিটিশরা নিয়ে গিয়েছে এদেশ থেকে। অন্যায় জুলুম করে অসহায় কৃষকদের তারা বাধ্য করতো গাঁজা চাষ করতে।