গ্রীক ফায়ার নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
এশিয়া আর ইউরোপের যোগসূত্র আজকের ইস্তাম্বুল। সেই রোমান আমলের শেষদিক থেকেই প্রসিদ্ধি লাভ করে এই শহর। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের প্রধান এই নগরীর তখন পরিচিত কন্সট্যান্টিনোপোল (Constantinople) নামে। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল, জৌলুষপূর্ণ ও ধনী নগরী হিসেবে পরিচিতি ছিল এই শহরের।
বসফরাসের ঠিক পাশে এই নগরীর কৌশলগত অবস্থানও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মাঝে হওয়ায় ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে কন্সট্যান্টিনোপোল ছিল আদর্শ। স্বাভাবিকভাবেই বাইজান্টাইনদের সমৃদ্ধ এই রাজধানীর প্রতি শ্যেনদৃষ্টি ছিল অনেকেরই।
ঠিক এ কারণেই কন্সট্যান্টিনোপোলকে নানা সময় প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই নগরীর প্রতিরক্ষার জন্য সদাসতর্ক থাকতে হতো বাইজান্টাইন সম্রাটদের। বিশাল আর দুর্ভেদ্য নগরপ্রাচীর তৈরি করা হয় রোমান সম্রাট কন্সট্যান্টাইনের সময়েই। তবে সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস পঞ্চম খ্রিষ্টাব্দে একে আরো শক্তপোক্ত করে তোলেন। তার নামে এর নাম হয়ে যায় থিওডোসিয়াসের দেয়াল (Theodosian Walls)।
তবে শত্রুদের অন্যতম আতঙ্ক ছিল বাইজান্টাইনদের অগ্নিগোলা। এর নাম গ্রীক ফায়ার (Greek Fire)। দাহ্য এই তরল বাতাসের সংস্পর্শে আসামাত্রই জ্বলে উঠতো আগুন। পানি দিয়ে এই আগুন নেভানো যেত না কিছুতেই। দরকার হতো বালি অথবা ভিনেগার। আশ্চর্য হলেও সত্যি- প্রস্রাব দিয়েও কাবু করা যেত এই আগুন!
ঠিক কীভাবে গ্রীক ফায়ার আবিষ্কৃত হলো তা আজও রহস্যাবৃত। দশম খ্রিষ্টাব্দের বাইজান্টাইন সম্রাট পরফাইরোজেনিটাস (Constantine VII Porphyrogenitus) একে দাবি করেছেন ঈশ্বরের উপহার হিসেবে। তার মতে, খ্রিষ্টান সম্রাট কন্সট্যান্টাইনকে (Constantine) দেবদূতেরা শিখিয়ে দেয় এর প্রস্তুতপ্রণালি। উদ্দেশ্য খ্রিষ্টধর্মের শত্রুদের বিরুদ্ধে যাতে জয়ী হতে পারেন তিনি।
বাইজান্টাইন ঐতিহাসিক থিওফ্যানেসের (Theophanes) মতে, গ্রীক ফায়ারের উদ্ভাবক এক গ্রীক। তার নাম কালিনিকোস (Kallinikos of Heliopolis)। কালিনিকোস থাকতেন সিরিয়ায়। তিনি বানান এক দাহ্য মিশ্রণ। এই মিশ্রণ জ্বলে উঠতো বাতাসের ছোঁয়ায়। সপ্তম শতকে সিরিয়া মুসলমানদের অধিকারে চলে যায়। তখন তিনি পালিয়ে আসেন কন্সট্যান্টিনোপোলে। এরপর সম্রাটের হাতে তুলে দেন তার উদ্ভাবন।
তবে আধুনিক গবেষকদের ধারণা, গ্রীক ফায়ারের প্রযুক্তি আরো আগে থেকেই ছিল। কালিনিকোস আসলে পূর্বে ব্যবহৃত প্রযুক্তির উন্নতিসাধন করেছেন মাত্র, নতুন কিছু আবিষ্কার করেননি। প্রথম খ্রিষ্টাব্দে এশিয়া মাইনরের রাজ্য পন্টাস আর রোমের মধ্যে যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে পাওয়া যায়- সেই লড়াইয়ে পন্টাস এই ধরনের দাহ্য তরল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।
আরেকদল গবেষক অবশ্য কালিনিকোসকে গ্রীক ফায়ারের সাথে সংশ্লিষ্ট মানতে রাজি নন। তারা মনে করেন- এর পেছনে ছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার বিখ্যাত বিদ্যালয়ের একদল রসায়নবিদ। তাদের অর্থায়ন করেছিল বাইজান্টাইনরা।
মজার ব্যাপার হলো- আধুনিক বিজ্ঞান আজঅবধি গ্রীক ফায়ারের প্রস্তুতপ্রণালী বের করতে পারেনি। বাইজান্টাইনরা পুরো পদ্ধতি খুব গোপন রেখেছিল। পুরো প্রক্রিয়া ভাগ করা হয় ছোট ছোট ধাপে। কারিগরেরা কেবল তাদের নিজেদের ধাপের কথাই জানতো। খুব অল্প সংখ্যক লোকই সবটা জানতেন। সমস্ত ধাপ জোড়া দিয়ে মূল অস্ত্র বানাত তারাই। কখনো এটা লিখে রাখা হয়নি। বরং বংশপরম্পরায় মুখে মুখে ধারাবাহিকভাবে চলে আসতো।
মার্কাস গ্রেসিয়াস (Marcus Graecis) নামে বিংশ শতাব্দীর এক গবেষক গ্রীক ফায়ারের উপকরণের একটি তালিকা প্রস্তাব করেছেন। এর অন্তর্ভুক্ত পেট্রোলিয়াম, নানারকম লবণ এবং আরো বেশ কিছু কেমিক্যাল। ব্রিটিশ রসায়নবিদ পার্টিংটন (J. R. Partington) দাবি করেছেন, প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত পেট্রোলিয়াম জ্বালানী বিশেষভাবে পরিশোধন করা হতো গ্রীক ফায়ারের জন্য। তবে এখনকার বিজ্ঞানীরা মনে করেন- এতটা উন্নত প্রযুক্তি বাইজান্টাইনদের ছিল না। অপরিশোধিত জ্বালানীই ব্যবহার করতো তারা।
তবে তৈরি করলেই তো হবে না। শত্রুর উপর প্রয়োগের উপযুক্ত ব্যবস্থাও তো করতে হবে। এজন্য বিশেষভাবে তৈরি পাইপ বা সাইফন (siphon) থাকতো। এর মাধ্যমে শত্রুদের উপর ছুড়ে দেয়া হতো ভয়াবহ এই আগুন।
প্রাথমিক যুগে গ্রীক ফায়ার ব্যবহার করা হতো জাহাজ থেকে। তাই সেখানেই বসানো থাকতো সাইফন। পরবর্তীতে নগরপ্রাচীরে যুক্ত হয় তা। Siege Engine-এর সাথেও যুক্ত করা হয় গ্রীক ফায়ার নিক্ষেপণ ব্যবস্থা। একপর্যায়ে নাকি হাতে বহনযোগ্য সাইফনও তৈরি করেছিলেন বাইজান্টাইন বিজ্ঞানীরা। একে আধুনিক ফ্লেমথ্রোয়ারের প্রাচীন রূপ ধরে নেয়া যায়।
কন্সট্যান্টিনোপোল দখলের চেষ্টা করে দুবার ব্যর্থ হয় উমাইয়ারা। ব্যর্থতার অন্যতম কারণ বলা হয় গ্রীক ফায়ারের কার্যকর ব্যবহার। ৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাইজান্টাইন রাজধানী অবরোধের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা কাছাকাছি নগরী সাইজিকাস (Cyzicus) দখল করেন। সাইজিকাসে জড়ো করা হয় অস্ত্র এবং রসদ। প্রস্তুতি নেয়া হয় এই ঘাঁটি থেকে লম্বা সময় অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার।
৬৭৪ খ্রিষ্টাব্দে আরম্ভ হয় প্রথম অবরোধ। প্রায় চার বছর প্রতিরক্ষামূলক লড়াই চালানোর পর সম্রাট চতুর্থ কন্সট্যান্টাইন আক্রমণে যান। জাহাজে করে তার সেনারা উপস্থিত হয় সাইজিকাসে। তীব্র লড়াই চলতে থাকে। ঠিক এই সময় বাইজান্টাইন নৌবাহিনী গ্রীক ফায়ার ব্যবহার করে জ্বালিয়ে দেয় আরব নৌবহর। বহু জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। আগুনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে সাগরে ঝাঁপিয়ে ডুবে মারা যান অনেক সৈনিক। যুদ্ধের মোড় এর ফলে ঘুরে যায় বাইজান্টাইনদের দিকে। পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয় আরব সেনারা।
৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় উমর প্রেরণ করেন বড় সেনাবাহিনী। প্রায় ৮০,০০০ সৈন্য আর ২০০ জাহাজের বিশাল বাহিনী রওনা হয়। কন্সট্যান্টিনোপলে ছিল ১৫,০০০ সৈনিক। দুর্ভেদ্য নগরপ্রাচীরের আড়ালে থেকে তীব্র প্রতিরোধ চালিয়ে যায় তারা। অবরোধ চলাকালীন বাইজান্টাইনদের জাহাজ উমাইয়া নৌবহরের সামনে এসে গ্রীক ফায়ার দিয়ে আক্রমণ চালায়। গতবারের মতো পরিণতি ঘটে এবারও।
গ্রীক ফায়ার অন্যান্য আক্রমণকারী বাহিনিকেও ভুগিয়েছে। ৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে কিয়েভ শহরের যুবরাজ ইগর (Igor) কয়েকশো জাহাজ নিয়ে কন্সট্যান্টিনোপোলে হামলা করেন। সময়টা ভালোই বেছে নিয়েছিলেন তিনি, কারণ মূল সেনা আর নৌবাহিনী তখন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অন্য প্রান্তে ব্যস্ত। তবে গ্রীক ফায়ারকে গোণায় ধরেননি ইগর।
মাত্র ১৫টি জাহাজ নিয়ে তার বহর ছত্রভঙ্গ করে দেয় বাইজান্টাইনরা। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে পুড়ে মরার থেকে সমুদ্রে ডুবে মারা যাওয়াকে শ্রেয় মনে করে বহু সৈনিক। বেঁচে ফেরা লোকেরা দেশে ফিরে ফেঁদে বসে নানা গালগপ্পো। দাবি করে- বাইজান্টাইনরা নাকি ছুঁড়ে মারছিলো ঈশ্বরের বজ্র!
বাইজান্টানইরা একাই যে যুদ্ধক্ষেত্রে এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতো তা নয়। পারসিক এবং আরব সেনাবাহিনীতেও এরকম অস্ত্রের প্রচলন ছিল। তবে গ্রীক ফায়ারই ছিল সবচেয়ে ভয়ানক। এর প্রধান কারণ পানি দিয়ে একে নেভাতে না পারা।
তবে দুর্বলতাও কিন্তু ছিল। বালি দিয়ে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত এই আগুন। আবার খোলা রণক্ষেত্রে সৈনিকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে আগুনের শিখাকে ফাঁকি দিতে পারতো। ফলে সরাসরি স্থলযুদ্ধ হলে খুব একটা কার্যকর হতো না গ্রীক ফায়ার। এজন্য নৌযুদ্ধেই প্রাথমিকভাবে সীমাবদ্ধ ছিল এর ব্যবহার।
যেহেতু কখনো লিখে রাখা হয়নি, তাই বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সাথে সাথে গ্রীক ফায়ারের প্রস্তুতপ্রণালী হারিয়ে যায়। ত্রয়োদশ শতকে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় খ্রিষ্টীয় বাহিনীর নিজেদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। ফলে নিজেদের দলের লোকেরাই কন্সট্যান্টিনোপোল তছনছ করে দেয়। সেই সম্ভবত শেষবার, যখন গ্রীক ফায়ারের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরপর ঐতিহাসিক নথিপত্র থেকে একরকম হারিয়েই যায় এই মারণাস্ত্র।