কফির ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
ক্লান্ত ঠোঁটে আলতো চায়ের চুমুকে যাদের ক্যাফেইনের সঙ্গে পরিচয়, তাদের হৃদয়, মন ও মননে একটু একটু করে সবটুকু জায়গা একসময় দখল করে নেয় অন্য একটি নাম। ঠিক চায়ের মতোই, তবে চা নয়। ক্যাফেইনের এই সর্বনাশা ভালবাসা যাকে ঘিরে তা হচ্ছে কফি।
শুধুই কি কাপে পান করা হয়? অনেকে খায়ও এই কফি। বীজকে আটার মতো গুঁড়িয়ে বানানো রুটি, চকলেট, বিস্কুট, কেক আর সস হিসেবে কফি খাওয়া মানুষের সংখ্যাটাও নেহায়েত কম নয়।
কফিকে ঠিক যখন থেকে মানুষ তার খাদ্য তালিকায় স্থান দিয়েছে, তখন থেকে এর জনপ্রিয় গল্পগুলো একপাশে রাখলে কফির ইতিহাস হওয়ার কথা আরও প্রাচীন। কারণ অনেক পাথর যুগের মানববসতির আশেপাশেও দেখা গিয়েছে কফি জাতীয় নানা উদ্ভিদ। শিকারী ও সংগ্রাহক জীবনে মানুষ অন্য সব ফলের মতো এই গাছের বীজও যে চেখে দেখেনি, সেটা হলফ করে বলতে পারবে সাধ্য কার!
কফি আবিষ্কারের জনপ্রিয় গল্প দুটির একটি এক রাখালের। প্রখ্যাত লেখক মার্ক পেন্ডারগ্রাস্ট (Mark Pendergrast) তার ‘Uncommon Grounds: The History of Coffee and How It Transformed Our World’ শীর্ষক গ্রন্থে কফি আবিষ্কারের একেবারে শুরুর গল্প থেকে অনেকগুলো বিষয় উল্লেখ করেছেন। সেখানেও খালদি নামের আবিসিনিয়ার সেই ভেড়া চরাতে যাওয়া রাখালের গল্পটি রয়েছে।
প্রচলিত গল্পটি অনেকটা এমন- ‘খ্রিস্টীয় নবম শতকের দিকে আবিসিনিয়া তথা ইথিওপিয়াতে বাস করত খালদি নামের এক রাখাল। সে তার ছাগলের পাল নিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশের চরাতে যেত। একদিন সে খেয়াল করল তার ছাগলগুলো অতিরিক্ত লাফালাফি করছে। অবিরাম ছোটাছুটির পরও সেগুলো তেমন ক্লান্ত হচ্ছে না।
পাহাড়ের ওপরে ওঠার ক্লান্তিতে অল্প সময় পর হাঁপিয়ে যাওয়ার কথা। সেখানে ছাগলগুলোর এই দুরন্তপনা তার মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। খুঁজতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে- অনেকটাই টকটকে পাকা জামের মতো একটা বিশেষ ফল খাচ্ছে তার ছাগলগুলো। সে বুঝতে পারে- ওদের এত লাফালাফির মূল কারণ এই ফলগুলো। এতে থাকা বিশেষ কোনো উপাদান ছাগলগুলোকে অদ্ভুত কোনো শক্তি দিচ্ছে যার ফলে তারা দিনভর লাফিয়েও ক্লান্ত হচ্ছে না।
ধার্মিক খালদি এই ফল স্রষ্টার আশির্বাদ নাকি শয়তানের ধোঁকা তা বুঝতে চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়ে সে এগুলো নিয়ে হাজির হয় স্থানীয় এক মসজিদের ইমামের কাছে। দেখতে লালচে হলেও ঐ ফলগুলো মানুষের পক্ষে কাঁচা চিবিয়ে খাওয়া সম্ভব ছিল না। ইমাম এগুলোকে শয়তানের ধোঁকা মনে করে আগুনে ছুড়ে মারেন। কিন্তু ফলগুলো আগুনে ফেলার পর সেখান থেকে দুর্দান্ত একটা সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। অবাক বিস্ময়ে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে “আলহামদুলিল্লাহ!” শব্দটি।
ইমাম সাহেব এবং তার আশেপাশে থাকা ছাত্ররা এবার একটু ভিন্ন চিন্তা করেছিলেন। তারা আগুনে নিক্ষেপের পর পুড়ে ওঠা কফির ফলগুলো গরম পানিতে সিদ্ধ করলেন। তারপর কয়েকজন সাহসে ভর দিয়ে সেই পানি পান করল। মনে করা হয়- এটাই পৃথিবীর প্রথম কফিপানের গল্প। কাফ্ফার পাহাড়ি এলাকায় হাজার বছর আগে থেকেই কফি গাছের অস্তিত্ব ছিল। তবে মানুষ সেই গাছের ফল সেখানে খাওয়ার চেষ্টা করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
রাখাল আর ছাগলের গল্পের বাইরে নতুন একটি তথ্য মিলেছে কফি পানের ইতিহাস নিয়ে। অনেকে দাবি করেন- ইয়েমেনের জনৈক সুফি ঘোতুল আব্দুল নুরুদ্দীন আবুল আল-হাসান আল-সাদিলি ইথিওপিয়ায় বেড়াতে গিয়ে কফি আবিষ্কার করেন। তিনি সেখানে একটি পাখিকে অজানা লাল রঙের ফল বেশ মজা করে খেতে দেখেছিলেন। তারপর নিজেও কৌতূহলী হয়ে খেয়ে দেখেন ঐ ফল। এরপরের সতেজ অনুভূতি তাকে এই ফলের প্রতি আকৃষ্ট করে।
ওদিকে ওমর নামে জনৈক ইয়েমেনি শায়খের নামও আসছে প্রথম কফি আবিষ্কারক হিসেবে। জন্মভূমি মোকা থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ওসাবের মরুভূমিতে। খিদের জ্বালায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি খুুঁজে পান কফিগাছ। তবে খাওয়ার জন্য মুখে দিতেই থুহ থুহ করে ফেলে দিতে হয় ফলগুলো।
একদিন আগুন জ্বালাতে গিয়ে ফলসহ কফির ডাল পুড়িয়ে ফেলেন অনেকগুলা। পরে সুন্দর গন্ধ থেকে পোড়া ফলগুলো পানিতে গুলিয়ে খান তিনি। নতুন ফল পোড়ানো পানীয় ওমর নামের এই সুফিকে চাঙ্গা করে তোলে। তিনি দেশে ফিরে উপাধি পান দরবেশ। আর কফিকে প্রাথমিকভাবে বলা হয় বিস্ময়কর পানীয়।
১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্তাম্বুল তথা তৎকালীন তুরস্কের কনস্টান্টিনোপলে পৃথিবীর প্রথম কফি হাউজের পত্তন ঘটে। মুসলিম সম্প্রদায়ের আবিষ্কার এই কফিকে অনেক মুসলমান রাষ্ট্র ভালভাবে নিতে পারেনি। ১৫১১ খ্রিস্টাব্দের দিকে ফতোয়া জারি করে মক্কায় কফি নিষিদ্ধ করা হয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় আলেমদের বিরাট সমর্থন ছিল।
তৎকালীন মক্কার গভর্নর খায়ের বেগের মনে ভয় জন্মেছিল যে কফিপানের ফলে চাঙ্গা হয়ে উঠবে সবাই। এতে জনগণের চাপা ক্ষোভ জেগে উঠলে তার অনৈতিক সরকারের পতন ঘটতে পারে। তাই আলেমদের কাজে লাগিয়ে জোর করে কফিকে হারাম ঘোষণা দেওয়া হয় তখন।
তখন উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিম ফতোয়া জারি করে কফি খাওয়াকে বৈধ ঘোষণা করেন। আলেমদের প্রভাবিত করে নিজের ধান্দা করায় খায়ের বেগকে গ্রেফতার করা হয়। অবৈধ কার্যকলাপের জন্য ফাঁসি দেওয়া হয় তার। ওদিকে ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতেও নিষিদ্ধ করা হয় কফি পান। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের সিংহভাগ কফিহাউজ।
ভিনদেশীদের কাছে ‘অ্যারাবিয়ান ওয়াইন’ নামে পরিচিত কফি ষোড়শ শতকের মধ্যে সিরিয়া, তুরস্ক, পারস্য আর মিশরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিল। ওদিকে পবিত্র নগরী মক্কায় হজ্জের উদ্দেশ্যে ফি বছর বিরাট সংখ্যক মুসলিমের আগমন ঘটতো। সুযোগ বুঝে ইথিওপিয়া থেকে কফির বীজ এনে বণিকেরা রমরমা ব্যবসা করেন মুসলমানদের কাছে।
ভাবছেন, কফি কীভাবে হজ্জের মতো সময়ে এত জনপ্রিয়তা পেল? এর মূল কারণ- ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা রাত জেগে ইবাদতের কাজ সহজ করতে চুমুক দিতেন কফিতে।
কফির ধর্মীয় বিতর্ক মূলত মুসলমান আর খ্রিস্টানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে তৈরি হয়েছিল। মুসলিমদের মাধ্যমে কফি আবিষ্কারের ইতিহাস কম-বেশি প্রায় সবাই জানে। ওদিকে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পানীয় রেড ওয়াইন ছিল মুসলমানের জন্য হারাম তথা নিষিদ্ধ। পাশাপাশি খ্রিস্টান সমাজেও অগোচরে ওয়াইনের জায়গা দখল করে নিতে থাকে কফি। এজন্যই কট্টর ক্যাথলিকরা কফিপান নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চালায়। তবে পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট এই জটিলতা নিরসনে মজা করে বলেন, “হোক না সেটা শয়তানের প্রিয় পানীয়! তাতে কী আসে-যায়? আমরা যদি এটাকেই ব্যাপ্টাইজ করতে পারি, তাহলে শয়তানও নিঃসন্দেহে ভ্যাজালে পড়বে!”
তখন ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টা-টিকটক আসেনি। ছিল না হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ চালাচালির সুযোগও। সে সময় ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জ্যাকব যখন প্রথম কফি হাউজ হিসেবে অক্সফোর্ডের দ্য অ্যাঞ্জেল ইন দ্য পেরিশ অব সেন্ট পিটার্সের ভবনে ‘দ্য গ্র্যান্ড ক্যাফে’ প্রতিষ্ঠা করেন, সেটার অন্য পরিচিতিও ছিল। একইভাবে পাসকোয়া রোজির মাধ্যমে লন্ডনের প্রথম কফিহাউজটি নির্মাণ শেষ হয় ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। সহজভাবে বললে, কফি হাউজই ছিল তখনকার সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয়তম মাধ্যম, এবং অপ্রয়োজনীয় আড্ডাবাজির সবচেয়ে সফল মাধ্যম।
পৃথিবীর নানা দেশে যে উদ্যম নিয়ে কফির প্রসারকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তার দ্বিগুণ গতিতে বেড়েছে এর জনপ্রিয়তা। বিশ্বজুড়ে কোনো পানীয়, এমনকি চা-কে অবধি কফির সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে বেগ পেতে হচ্ছে।
অল্প অল্প করে গল্পগুলো যখন গ্রাস করে নিচ্ছে কফিপানের ইতিহাসকে, তখন একটু পেছনে ফিরে তাকানো যেতেই পারে। মনে করা হয়, খ্রিস্ট্রীয় ১০০০ অব্দে যোদ্ধারা শক্তি সঞ্চয় করার জন্য পশুচর্বির সঙ্গে মিশিয়ে কফিফলের মিক্সার খাওয়া শুরু করেছিল। পোড়ানো কফি বীজের গুঁড়ো গরম পানিতে গুলিয়ে খাওয়া তখনও কেউ আয়ত্বে আনতে পারেনি।
ঘটনার উল্টোপিঠে গল্পটা একটু অন্যরকমও বটে। অনেকের দাবি, এই একই সময়ে, অর্থাৎ ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকেই আরবরা অন্য ফল ও ফসলের সঙ্গে কফির গৃহপালন তথা চাষাবাদ শুরু করে। তারা সিদ্ধ করে যে কফি পান শুরু করে তার নাম ছিল কাহওয়া।
মক্কায় যে একসময় কফি নিষিদ্ধ করা হয়, তা তো কিছুক্ষণ আগেই বলা হয়েছে। সেসময় আবার তুর্কিদের মধ্যে কফির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তাদের ভাষায় ভাষায় কফি হাউজগুলোকে ডাকা হতো ‘ক্বাহভেহ খানেহ’ নামে। কফির তুর্কি নাম ‘ক্বাহভেহ’ এসেছে আরবি ‘ক্বাহা’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘যে পানীয় ক্ষুধা মেরে দেয় ‘। পরে এই শব্দটি ইতালিয়ান ভাষায় গিয়ে রূপ নেয় ‘ক্যাফে’তে।
মার্কিন মুলুকে অবশ্য আরও অনেক পরে কফির প্রচলন ঘটে। ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে ক্যাপ্টেন জন স্মিথের মাধ্যমে ভার্জিনিয়ার জেমস টাউনের মানুষ কফির সঙ্গে পরিচিত হয়। ওদিকে, এর প্রায় চার দশক পরে ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতেও প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি কফিশপ। তারও প্রায় বছর সাতেক পরে অর্থাৎ ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডেও একটি কফি হাউজ তৈরি করা হয়।
আমেরিকার মানুষের কাছে তুষারপাতের দিনে একাধারে একটু উষ্ণতা আর চাঙ্গা ভাব নিয়ে আসার উৎস হয়ে দেখা দেয় কফি পান। ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে তাই নিউ ইয়র্ক নগরীর বেশিরভাগ মানুষের কাছে বিয়ারের থেকে কফি ছিল বেশ প্রিয় পানীয়।
ওদিকে ব্রিটিশরা কফিপানের এই জোয়ার থেকে পিছিয়ে ছিল না। ফলাফল হিসেবে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংল্যান্ডে নির্মিত কফি হাউজের সংখ্যা তিন হাজারের কোটা পার করে।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা, তবেই ফরাসিদের একটু পেছনে ফেলা। তাদের যে বড্ড দেরি হয়ে গেল! কবি সুনীলের সেই ‘ছবির দেশ, কবিতার দেশ’ প্যারিসের প্রথম কফিশপ চালু হতে হতে অপেক্ষার পালা গিয়ে ঠেকে ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে।
গুদামে আগুন লাগলে কেউ কেউ নাকি আলুপোড়া খায়। ঠিক তেমনি ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে কপাল খুলে যায় ফ্রাঞ্জ কোলঝিটকির (Franz Georg Kolschitzky)। সে বেশ ফয়দা লুটেছিল ভিয়েনা যুদ্ধ থেকে। যুদ্ধের শেষে তুর্কিদের ফেলে যাওয়া বস্তা বস্তা কফি কুড়িয়ে সে নিজেই একটা কফি বিক্রির দোকান দিয়ে বসে।
ওলন্দাজদের কফির সঙ্গে পরিচিতি ঘটে একটু অন্যভাবে। জলদস্যু হিসেবে বিশ্বব্যাপী ঘৃণিত ও ধিকৃত হলেও তারা কফি বীজ লুট করার পথ বেছে নেয়নি। উপরন্তু, ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের একটা সময়ে আরবের কোনো একটা এলাকা থেকে কফির চারা নিয়ে এসে তারা রোপণ করে নিজ দেশের মাটিতে।
উগ্র জাতীয়তাবাদ আর যুদ্ধবাজ নীতি অনেক বিষয়ের মতো কফির চুমুক থেকেও বঞ্চিত করেছিল জার্মানদের। তারা প্রথম কফির স্বাদ পায় ১৭২১ সালে এসে।
পেলে, রোনালদোর দেশ ব্রাজিলে কফি আসেছিল আরও পরে। সেলেসাওদের মাটিতে কফি প্রথমবারের মতো জায়গা পায় ফ্রেঞ্চ গায়ানার গভর্নরের স্ত্রীর পাঠানো ফুলের তোড়ায় ভর করে। তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফ্রান্সিসকো ডি মেলো পালেহটাকে (Francisco de Melo Palheta) পাঠানো ফুলের তোড়ার মধ্যে অনেকগুলো কফির চারা ও বীজ লুকিয়ে দিয়ে দেন।
১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের ব্রিটিশ উপনিবেশে চায়ের বিক্রিবাট্টার একতরফা বাজারদখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় বোস্টন টি পার্টি। তখন চায়ের স্থলে কফি পানকে একজন আমেরিকানের জন্য দেশেপ্রেমের নিদর্শন বলে মনে করা হতো।
মক্কার গভর্নর খায়ের বেগের ভূত কিছুটা তাড়া করেছিল প্রুশিয়ার গভর্নর ফ্রেডরিখকেও। তিনি ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে তার এলাকায় কফি নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্ত শেষ অবধি জার্মানির ঐ এলাকার তীব্র শীত আর জনমতকে উপেক্ষা করার সাধ্য হয়নি তার।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে কফিকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার সব আয়োজন শেষ হয়। হিল ব্রাদার্সের চেষ্টায় খাওয়ার উপযোগী কফি বীজগুলো যখন টিনের কৌটায় ভরা হচ্ছে, ঠিক তার বছরখানেকের মধ্যে জাপানিরা গরম পানিতে গুলিয়ে পানের মতো কফি তৈরি করে। জাপানি-আমেরিকান সাতোরি কাতো (Satori Kato) শিকাগোতে বসে এই কাজ আরও ভালভাবে করতে পেরেছিলেন বলে জাপানিদেরও আগে নাম আসে তার।
কফি থেকে ক্যাফেইন আলাদা করার প্রযুক্তি নিয়ে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে হাজির হয় ‘সানকা (Sanka)। এই ধারণার প্রবর্তক ছিলেন জার্মান কফি আমদানিকারক লুডউইগ রোজেলিয়াস (Ludwig Roselius)। এর বছর তিনেকের মধ্যেই গুয়াতেমালার রসায়নবিদ জি. সি. ওয়াশিংটন (George Constant Washington) সবার জন্য সহজে পানযোগ্য বিশেষ ধরনের ইনস্ট্যান্ট কফি আবিষ্কার করেন।
ভারতবর্ষের মতো আমেরিকা অঞ্চলেও উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম তুঙ্গে ওঠে। বি-উপনিবেশায়নের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে চা বর্জন শুরু হয়। আর ঠিক তখনই সেই শূন্যস্থান দখল করতে থাকে কফি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের দিকে আমেরিকায় কফির বাজার অন্য উচ্চতায় পৌঁছায়। এরই সূত্র ধরে নেসলে কোম্পানি ব্রাজিল থেকে শুকনা কফির গুঁড়া আমদানি শুরু করে। তাদের কফি বিক্রির চূড়ান্ত রূপই আজকের নেসলে।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বিশ্বের ৭০ শতাংশ কফির ভোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আমেরিকা। তারা এর অনেকটাই তখন আমদানি করতো। এমনকি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মার্কিন সৈনিকরা তাদের দৈনিক ভাতা এবং রেশনের অংশ হিসেবে ম্যাক্সওয়েল হাউজের কফি পেতো।
দীর্ঘদিন ধরে কফি মানুষের খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিলেও তার পরিবেশনে অনেক ভিন্নতা ছিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৪৬ সালে জনপ্রিয় এই পানীয় তৈরির উদ্দেশ্যে এস্প্রেসো মেশিনকে পূর্ণতা দান করেন গ্যাগিয়া (Giovanni Achille Gaggia)। ঠিক তারও অনেক পরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বছরে প্রথমবারের মতো স্টারবাকস তাদের কফি বাজারজাতকরণ শুরু করে।