বাংলাদেশের আঘাত হানা ভয়াবহ ১০টি ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
১৯৭০ | ভোলা ঘূর্ণিঝড়
আবহাওয়াবিদদের মতে, আজ অবধি যতগুলো সাইক্লোন নথিভুক্ত হয়েছে, তার মধ্যে ১৯৭০ সালের ভোলা সাইক্লোনই ছিল সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক। একে এমন ভয়াবহ মনে করার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। মূল কারণ প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি। ১৯৭০ সালে আঘাত হানা এই সাইক্লোন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল পুরো গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষও এ থেকে রক্ষা পায়নি। এত মানুষের মৃত্যুর জন্যই একে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ও ভয়াবহ বলে মনে করা হয়।
১৮৭৬ | দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন
এরপর হঠাৎ করে ইতিহাসের পাতায় অনেক পেছনে চলে যেতে হয়। প্রাণক্ষয়ের ক্ষেত্রে ভোলা সাইক্লোনের পরই আছে দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন ১৮৭৬ এর নাম। ১৮৭৬ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত চলে ভয়াবহ এই সাইক্লোন। বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে বাকেরগঞ্জ উপকূল তথা বর্তমান বরিশালের প্রায় পুরোটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। তখনকার মেঘনা নদীর মোহনায় পুরো তাণ্ডব তোলে এই সাইক্লোন । তখন এই সাইক্লোনের প্রভাবে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের এই এলাকায় প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
১৮৯৭ | চট্টগ্রাম ঘূর্ণিঝড়
ভয়াবহ সাইক্লোনের তৃতীয় ঘটনাও নথিভুক্ত করা হয়েছে আজ থেকে শতবর্ষ আগেই। ১৮৯৭ সালের দিককার চট্টগ্রাম সাইক্লোন উপকূলীয় গ্রামাঞ্চল দিয়ে বয়ে যায়। এর প্রভাবে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ মারা যান। তখন এমনিতেই পুরো দেশে কলেরা মহামারির তাণ্ডব চলছে। ঘূর্ণিঝড় চলমান সংকটকে আরও ভয়াবহ রূপ দেয়। মনে করা হয়, তখন কলেরায় প্রায় ১৮ হাজার মানুষ মারা যান। আর পর পরই আছড়ে পড়া প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়ের ফলে শতেক, হাজার দিয়ে যে মৃত্যুমিছিল শুরু হয়েছিল, সেখানে যুক্ত হয় আরও লাখো মানুষের প্রাণহানি।
১৯৯১ | বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়
১৯৯১ বাংলাদেশ সাইক্লোনকে বলা হয় সুপার সাইক্লোন। দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন এলাকা এই ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছিল ১৯৯১ সালের ৩১শে মে। ২ জুন পর্যন্ত চলা এই সাইক্লোনের প্রভাবে পুরো দক্ষিণাঞ্চল দুমড়েমুচড়ে যায়। এই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি সাগরের কোল ঘেঁষে থাকা দ্বীপগুলোকে মৃত্যুর তাণ্ডব দেখায়। এর পাশাপাশি পটুয়াখালির চরাঞ্চল, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালিতেও এর ভয়াবহতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
তখন ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২৪০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঝড়ো হাওয়া পুরো পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় উপকূলীয় এলাকা। শেষ অবধি এই ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার। সেই সময়ের হিসেবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছুঁয়েছিল দেড়শো কোটি মার্কিন ডলার!
১৯৬৫ সালের ঘূর্ণিঝড়
ভয়াবহ আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে হয় ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে। ঘন্টায় ২১৭ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা এই ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে ১৫ ডিসেম্বর। বর্তমান কক্সবাজার থেকে শুরু করে উপকূলীয় এলাকার প্রায় পুরোটায় বিস্তৃত হয় এই ঝড়। তারপর গিয়ে এ ঝড় আঘাত হানে পটুয়াখালীতে। সবমিলিয়ে এর তাণ্ডবে প্রায় ১৯,২৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা যায়।
১৯৬৩ সালের ঘূর্ণিঝড়
১৯৬৩ সালের ২৮-২৯ মে দু’দিন জুড়ে প্রচন্ড মাত্রার এক ঘূর্ণিঝড় দেখা দেয়। তখন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালি, কক্সবাজার ও সন্দ্বীপ এলাকা পুরো তছনছ হয়ে যায়। এর বাইরে কুতুবদিয়া, মহেশখালীর মতো সাগরের কোল ঘেঁষে থাকা দ্বীপগুলো গুঁড়িয়ে দেয় এই সাইক্লোন। এর গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ২২৩ কি.মি.। অগণিত মানুষের প্রাণহানী, গাছপালা ভেঙে পড়ার পাশাপাশি সম্পদেরও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয় তখন। বিভিন্ন হিসেবে এই ঘূর্ণিঝড়ে ১১,৫২০ জনের মতো মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
১৯৬১ সালের ঘূর্ণিঝড়
এর ঠিক দুই বছর আগেই ১৯৬১ সালে আঘাত হানে আরেকটি সাইক্লোন। ভোলা সাইক্লোন, বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন, চট্টগ্রাম সাইক্লোন কিংবা ১৯৬৩ সালের মতো ভয়াবহ না হলেও এর ক্ষয়ক্ষতি কম ছিল না। ঘন্টায় ১৬১ কি.মি. গতিতে এই সাইক্লোন ১৯৬১ সালের ৯ মে বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে আঘাত হানে, যার প্রভাবে সৃষ্টি হয় আড়াই থেকে তিন মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের। বিভিন্ন ধরনের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি এতে ১১,৪৬৮ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে।
১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড়
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সালের মাঝে দুটি ভয়াবহ সাইক্লোনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। প্রথমত, ১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড় ২৪-২৫ মে তাণ্ডব চালায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে। ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১৫৪ কি.মি. বেগে আঘাত হানা এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় হিসেবে প্রায় ১১,০০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়
মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ১৯৮৮ সালে আঘাত হানে সাইক্লোন 04B। ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘন্টায় ২০০ কি.মি. বেগে ধেয়ে এসেছিল। সৃষ্টি হয় ৪.৫ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। ভয়ানক এই ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছাসের ফলে বাংলাদেশে ৫,৭০৮ জন মানুষ মারা যান। অধিকাংশ মৃত্যু ঘটে প্রচণ্ড ঝড়, বাড়ি ভাঙা এবং বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে তড়িতাহত হবার ফলে। প্রচুর অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় বাংলাদেশ, নষ্ট হয় প্রায় ২,২০,০০০ টন ফসল।
১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড়
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় বছর দশেক আগে ১৯৬০ সালের দিকে আরেকটি সাইক্লোন ঘন্টায় প্রায় ২১০ কি.মি. বেগে আঘাত হানে দক্ষিণ উপকূলে। এর ফলে দেশে প্রায় ৫,১৪৯ জনের মৃত্যু ঘটে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন অবধি যতগুলো সাইক্লোন নথিভুক্ত হয়েছে, সেসবের মাঝে ১৯৭০ সালের ভোলার ঘূর্ণিঝড়ই সর্বোচ্চ মাত্রার ধ্বংসাত্মক। এই শতকে আমরা যেসব ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হয়েছি সেসবের মাঝে আছে সিডর, আইলা, মহাসেন, রোয়ানু, ফণী, বুলবুল, আম্পান, কিংবা অনাগত মোখার মতো সাইক্লোনগুলোকে। এসব সাইক্লোনেও বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।