পিরামিড তৈরির ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
‘পিরামিড’ শব্দটি শুনলেই চোখে ভাসে মাটি থেকে ক্রমশ সরু হয়ে উঠে যাওয়া ত্রিভুজাকার স্থাপত্যের ছবি। প্রাচীন মিশরীয় সম্রাটরা তাদের সমাধি হিসেবে তৈরি করতো সুবিশাল এই সৌধ। কর্মযজ্ঞ আরম্ভ হতো তার জীবদ্দশাতেই, যাতে মৃত্যুর পর দেবতাদের পাশে আসীন হতে দেরি না হয়। মিশরীয়রা ছাড়াও ওলমেক, মায়া, ইনকা, অ্যাজটেক ইত্যাদি সভ্যতাও পিরামিড বানিয়েছে, তবে রহস্য-রোমাঞ্চে মিশরীয় পিরামিডকে বোধহয় আর কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।
মিশরীয় পিরামিড নির্মাণকৌশল নিয়ে সাধারণভাবে প্রচুর ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া প্রাচীন সেই সভ্যতা প্রায় আড়াই টন ওজনের হাজার হাজার পাথরখন্ড মরুভূমি দিয়ে টেনে নিয়ে গেল কেমন করে? কীভাবেই বা স্তরে স্তরে সাজিয়ে আকার দিল আমাদের জানা পিরামিডের? ট্রু নর্থের দিকে মুখ করে পিরামিডগুলোকে বিন্যাসই বা করলো কী করে? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ট্রু নর্থ বা প্রকৃত উত্তর দিক কম্পাসের উত্তরদিক থেকে ভিন্ন। পৃথিবীর ঘুর্ণনের উত্তর অক্ষাংশের সাথে সম্পর্কিত এই উত্তর দিক।
খুব জনপ্রিয় একটি তত্ত্ব হচ্ছে- পিরামিড বানাতে সাহায্য করেছে ভিনগ্রহীরা। ২০২০ সালে এলন মাস্কও টুইটারে এই তত্ত্বের প্রতি সমর্থন জানান। প্রায় সাথে সাথেই মিশরীয় মন্ত্রী রানিয়া আল মাশাত (Rania al-Mashat) এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ জাহি হাওয়াস (Zahi Hawass) পাল্টা টুইটে তার জবাব দেন। তাদের মতে, আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে পিরামিড নির্মাণ করতে যে দক্ষতা ও জ্ঞানের দরকার, সেটা প্রাচীন মিশরীয়দের ছিল। পিরামিড বানাতে কী প্রক্রিয়ায় পাথর এনে সেটা ব্যবহার করা হয়েছিল- তার বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা বর্তমান বিজ্ঞান দিয়েছে।
একটা কথা পরিষ্কার করে নেয়া উচিত। মিশরীয়রা প্রথম যখন পিরামিড তৈরি শুরু করে- সেটা দেখতে কিন্তু ভিন্ন ছিল। প্রাথমিক যুগের এই পিরামিডগুলোকে বলে স্টেপ (Step) বা ধাপ পিরামিড। এর আগে মিশরীয় সম্রাটদের ঠাঁই হতো মাটির ইট দিয়ে তৈরি করা আয়তাকার সাদাসিধে সমাধিতে, যাকে বলা হয় মাস্টাবা (mastaba)। প্রায় ৬,৭২৩ বছর আগে ফেরাউন জোসের তার জন্য তৈরি করেন ধাপ পিরামিড, যে কাজের কৃতিত্ব দেয়া হয় তার প্রধান উজির ইমহোটেপকে।
ধাপ পিরামিড মসৃণভাবে নয়, বরং সিঁড়ির ধাপের মতো স্তরে স্তরে উপরে উঠে গেছে। এর চূড়া সরু নয়, সমতল। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, ইমহোটেপ জোসেরের জন্য প্রথমে মাস্টাবারই পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে এরপর তিনি ঠিক করলেন- একে আরো উঁচু করবেন। ফলে ধাপে ধাপে চুনাপাথর দিয়ে একটার উপর আরেকটা মাস্টাবা তৈরি করতে থাকেন তিনি।
মিশর বিশেষজ্ঞ মিরোস্লাভ ভার্নারের (Miroslav Verner) মতে, মিশরীয়রা পাথর বসাচ্ছিল পিরামিডের কেন্দ্রের দিকে হেলিয়ে। এ কারণে স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। কাজ শেষ হলে দেখা গেল- ছয় স্তরে প্রায় ২০০ ফুট উঁচু হয়েছে সমাধি। পিরামিডের তলে খনন করা হয়েছিল প্রায় ছয় কিলোমিটার টানেল, এর বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। ইমহোটেপ জোসেরের পিরামিডের ওপর চুনার যে প্রলেপ দিয়েছিলেন, তা-ও নষ্ট হয়ে গেছে বহু আগেই।
আমরা এখন পিরামিড বলতে যা বুঝি, সেটা তৈরি হতে থাকে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। ফেরাউন স্নেফ্রুর (Snefru) সময় পিরামিডের নির্মাণকাজে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসতে থাকে। স্নেফ্রু তিনটি পিরামিড বানিয়েছিলেন। প্রথম পিরামিড বানাতে গিয়ে নকশায় ভুল করে ফেলেন স্থপতিরা, ফলে কিছুটা বেঁকে গিয়েছিলো সেটা। এর নাম হয়ে যায় বাঁকা পিরামিড (bent pyramid)। বাকি দুটোর ক্ষেত্রে শুধরে নেয়া হয় সেই ভুল।
সব মিলিয়ে শ’খানেক পিরামিড টিকে আছে আজ পৃথিবীতে। সবচেয়ে বড়টাকে বলা হয় গিজার পিরামিড। ফেরাউন খুফু (Khufu) প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে তৈরি করেন এটি। আইফেল টাওয়ার বানানোর আগপর্যন্ত খুফুর পিরামিডই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপত্য।
খুফুর কাজ শেষ করতে সময় লেগেছিল ২০ বছর। ২০১০ সালে লোহিত সাগরের তীরবর্তী এলাকা থেকে প্রাপ্ত এক প্যাপিরাসে এই সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পান গবেষকেরা। সেখানে বলা আছে- ফেরাউনের সৎ ভাই আন্খাফ (Ankhaf) কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। তার নির্দেশে শ্রমিকদের ভাগ করা হয় চল্লিশজনের ছোট ছোট দলে। প্রত্যেক দলের জন্য কাজ নির্ধারিত ছিল। কেউ পাথর টেনে আনত, আর কেউ সেটা বসাত।
এই যে এত বড় বড় পাথরখন্ড, সেটা আসতো কোথা থেকে? প্রমাণ পাওয়া গেছে- পিরামিড যেখানে নির্মিত হতো, তার কাছাকাছি কোনো খনি থেকেই আহরিত হতো সেই চুনাপাথর। খনি থেকে নির্মাণের জায়গা পর্যন্ত মরুভূমির মধ্যে কাটা হতো খাল। এরপর নৌকায় উঠিয়ে খাল দিয়ে নিয়ে আসা হতো বড় বড় পাথর। পিরামিড যেখানে হবে, ঠিক তার পাশে ভিড়ত নৌকা। কাজ শেষ হলে খাল ভরাট করে দেয়া হতো আবার।
গিজার পিরামিডের সাথে জড়িত এক মিশরীয় কর্মকর্তা মেরের-এর (merer) ডায়েরি উদ্ধার করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। সেখানে বিশদভাবে বর্ণনা করা আছে এসব খালের কথা। তার বর্ণনানুযায়ী, নীলনদের বন্যা এলে বড় বড় বাঁধ দিয়ে পানির গতিপথ পরিবর্তন করে দিত মিশরীয়রা। সেই পানি গিয়ে জমা হতো সদ্য কাটা খালে। ফলে পিরামিড পর্যন্ত তৈরি হয়ে যেত জলপথ। এরপরের কাজ তো সহজ। নৌকায় করে পাথর টেনে আনা। একবারে ১৫ টনের বেশি পাথর নিয়ে আসা যেতো।
আনা তো গেলো, কিন্তু এই পাথর তুলে স্তরে স্তরে বসানোটা হতো কীভাবে? একদিক থেকে কাজটা অবশ্য সহজ হয়ে যেত এজন্য যে প্রায় ৮০% পাথর ব্যবহৃত হতো ভিত্তি তৈরিতে, উপরে যাওয়ার সাথে সাথে কমতে থাকতো পাথরের পরিমাণ। কিন্তু এত ভারি পাথর উপরে তোলার কৌশল কী ছিল?
সিংহভাগ মিশর বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এজন্য তৈরি করা হতো র্যাম্প (ramp)। র্যাম্প হলো ঢালু একরকমের পথ। হাসপাতালে সিঁড়ির পাশে হুইলচেয়ার চলাচলের জন্য এমন ঢালু রাস্তা দেখা যায়। পিরামিডের গা বেয়ে তৈরি করা হতো এই ঢালু রাস্তা, এবং পিরামড যত উপরের দিকে উঠত, ততই বৃদ্ধি পেত এর দৈর্ঘ্য। র্যাম্প পানি দিয়ে ভিজিয়ে এরপর টেনে নেয়া হতো পাথরের বড় বড় চাঁই।
পানি দেয়ার ফলে ঘর্ষণ বা ফ্রিকশন কমে যেতো, ফলে দশ-বারোজন লোক মিলেই ঠেলে ঠেলে ওঠাতে পারতো পাথর। এজন্য দড়ি বা রথও ব্যবহার করা হতো বলে মনে করা হয়। জায়গামতো নিয়ে কাঠের লিভার দিয়ে বসিয়ে দেয়া হতো পাথরখন্ড। সব কাজ হয়ে গেলে ধ্বংস করে ফেলা হতো র্যাম্প, ফলে আজকের দিনে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
অনেক গবেষকের মতে, র্যাম্পে পুলির সিস্টেম রাখতো মিশরীয়রা। মজার ব্যাপার হচ্ছে- এই ধারণার উৎপত্তি মিশরের মরুভূমিতে খুঁজে পাওয়া চুনাপাথরের এক খনিতে। সেখানে ফরাসি বৈজ্ঞানিকেরা সন্ধান পেয়েছেন সিঁড়ির ধাপের, যার দু’পাশে ঢালু র্যাম্প আছে। র্যাম্পের মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্বে দেখা গেছে খুঁটির চিহ্ন।
গবেষক রোলান্ড এন্মার্খ মনে করেন (Roland Enmarch), খুঁটিতে দড়ি বেঁধে পুলি বানিয়ে খনি থেকে পাথর তোলা হতো, তারপর নিয়ে যাওয়া হতো পিরামিড বানাতে। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে- এই সিস্টেম ব্যবহৃত হচ্ছিলো সাড়ে চার হাজার বছর আগে থেকেই। সুতরাং পিরামিড তৈরিতেও এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হতে পারে বলে জানান ফরাসি দলের প্রধান, ইয়ানিস গর্ডন (Yannis Gourdon)।
পিরামিডের সাথে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের সংযোগ নিয়েও অনেক মিথ আছে। খুফুর পিরামিড কালপুরুষ (orion) বেল্টের তিনটে তারার অবস্থান নির্দেশ করে বলা মনে করা হয়। জ্যোতির্বিদ্যায় প্রাচীন মিশরীয়দের অগ্রগতি ছিল বেশ ভালো, কাজেই তাদের পক্ষে কঠিন হলেও অসম্ভব নয় এমন কাজ।
ট্রু নর্থ বরাবর পিরামিডগুলো বিন্যাস করাটা অবশ্য বিজ্ঞানীদের বহু বছর হতভম্ব করে রেখেছিলো। মিশরীয়রা মনে করতো- তাদের রাজারা মৃত্যুর পর তারা হয়ে উত্তর আকাশে অবস্থান নেন, তাই এমন করতো তারা। এজন্য উত্তর মেরুর অবস্থান জানা দরকার। আজকের মতো প্রাচীন মিশরের সময় কোনো তারা ঠিক উত্তর মেরুর উপর অবস্থান করছিল না। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. কেট স্পেন্স (Kate Spence) অধুনা এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
ড. স্পেন্স দেখিয়েছেন যে, তখনকার দিনে মিশরের আকাশে দুটো তারা ব্যবহার করে ট্রু নর্থ নির্ণয় করা সম্ভব ছিল। যখন তারা দুটো একে অপরের উপর চলে আসতো, তখন একজন মিশরীয় জ্যোতির্বিদ বিশেষ প্রক্রিয়ায় ট্রু নর্থ বের করতে পারতেন। তবে হিসেবে কিছুটা ভুলচুক হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। খুফুর পিরামিড প্রকৃত উত্তর বরাবর হলেও বাকিগুলো কিছুটা সরে গেছে।
শেষ কথায় আসা যাক। এই যে পিরামিড, কারা ছিলো এর শ্রমিক? বহু বছর এমন একটা ধারণা বিদ্যমান ছিল যে- এ কাজে দাসদের খাটিয়ে নিত মিশরীয় সম্রাটরা। তবে এটা ভুল। প্রত্নতাত্ত্বিক মার্ক লেহ্নার (Mark Lehner) গিজার কাছে খুঁজে পেয়েছেন শ্রমিকদের শহর। প্রমাণ মিলেছে যে তাদের যথেষ্ট ভালো খাবার-দাবার দেয়া হতো। বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, কেবল খুফুর পিরামিড তৈরির সময়েই দৈনিক প্রায় দু’হাজার কেজি মাংস শ্রমিকদের জন্য যোগান দেয়া লাগতো। মনে করা হয়, এই শ্রমিকেরা মূলত মিশরীয় কৃষক। পিরামিড নির্মাণকে সম্মানের কাজ মনে করতো তারা। পাশাপাশি, এজন্য পারিশ্রামিকের হাতছানিও উড়িয়ে দেয়া যায় না।