ক্যামেরা আবিষ্কারের ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
মোবাইল ফোনের সাথে ক্যামেরা সংযুক্ত হয়েছে অনেক আগেই। দিন দিন আরো উন্নত হচ্ছে সেটা। কিন্তু তাই বলে আসল ক্যামেরার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি আজও। পেশাদার ফটোগ্রাফার এবং ফটোগ্রাফি ভক্তরা এই ক্যামেরা ব্যবহার করেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক ছবি তোলার জন্য এর বিকল্প নেই। কিন্তু কেমন ছিল এই ক্যামেরার শুরুটা? বলে রাখা ভালো- আমাদের কথাবার্তা সীমিত থাকবে স্থিরচিত্রের ক্যামেরাতে, ভিডিও ক্যামেরার গল্প হবে অন্য কোনোদিন।
প্রথম ক্যামেরা খুঁজতে যেতে হবে চীনে, সেই ২,৭০০ বছর আগে। পুরাতন চীনা নথিপত্র ঘেঁটে পাওয়া যায় ক্যামেরা অবসকিউরার (camera obscura) নাম। পরবর্তীতে গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের লেখাতেও পাওয়া যায় এই নাম। প্রায় ১,০০০ বছর আগে আরব গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিদ হাসান ইবনে আল-হাইসাম (Ibn Al-Haytham) এর বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন। আলোকবিদ্যায় অবদানের জন্য ইতিহাসের পাতায় তিনি ‘ফাদার অব মডার্ন অপটিক্স’ বা ‘আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক’ হিসেবে খ্যাত।
ক্যামেরার আদিপুরুষ বলা যায় ক্যামেরা অবসকিউরাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ক্যামেরা ছবি তোলার জন্য নয়, বরং অতিক্ষুদ্র এক ছিদ্রের মধ্য দিয়ে আলোকে কেন্দ্রীভূত করে পর্দায় ফেলা হতো। একটি বাক্সের একপ্রান্তে ছিদ্র করে যদি সেদিক দিয়ে আলো ফেলা হয়, তাহলে আলোকরশ্মি ফোকাস হবে অন্যপ্রান্তে রাখা কাগজে। সেখানে ফুটে উঠবে বাইরের জগতের একটি চিত্র।
এবার চলে আসা যাক ১৬৮৫ সালে, জার্মানিতে। জোনাথন য্যান (Johann Zahn) নামে এক লোকের মাথায় উঁকি দিলো নতুন আইডিয়া। সেই মতো ছবি এঁকে ফেললেন তিনি, নাম দিলেন বহনযোগ্য রিফ্লেক্স ক্যামেরা (handheld reflex camera)। তবে উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবে আরো শ’খানেক বছর লেগে যায় য্যানের ক্যামেরার বাস্তব রূপ পেতে। এই অসাধ্য সাধন করেন ফরাসী আবিষ্কারক জোসেফ নিসফোর নিপ্স (Joseph Nicéphore Niépce)। তার তৈরিকৃত ক্যামেরা জনসমক্ষে আসে ১৮১৬ সালে। একেই প্রথম ফটোগ্রাফিক ক্যামেরার স্বীকৃতি দেয়া হয়।
জোসেফ ক্যামেরার কাজ আরম্ভ করেন কয়েক দশক আগেই। নিস শহরের প্রশাসক ছিলেন তিনি। কিন্তু বিজ্ঞানের ঝোঁকে ১৭৯৫ সালে অবসর নেন। এরপর বাড়ি ফিরে ভাই ক্লডের সাথে মিলে চালাতে থাকেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা। ক্যামেরা অবসকিউরার গল্প তার অজানা ছিল না। তৎকালীন প্রযুক্তির বদৌলতে এটাও জানা ছিল যে আলোর সংস্পর্শে সিলভার সল্ট কালো হয়ে যায়। এই জ্ঞান ব্যবহার করে তিনি সচেষ্ট হলেন ক্যামেরার ফিল্ম বানাতে।
নানারকম উপকরণ বাছবিচার করে বেছে নেয়া হলো বিটুমিন অব জুডিয়া (Bitumen of Judea)। অনেকটা আলকাতরার মতো দেখতে এই বস্তু দিয়েই জোসেফ যুগান্তকারী কান্ড ঘটিয়ে বসলেন। ক্যামেরা অবসকিউরার আলো বিটুমিন মাখা কাগযে প্রতিস্থাপন করে পেলেন ঝাপসা ছবি। এই পদ্ধতির একটা গালভরা নামও দিলেন তিনি- হেলিওগ্রাফি (heliography)। ১৮২৬ সালে তিনি সফল হন পৃথিবীর প্রথম ফটোগ্রাফ তুলতে। তার বাড়ির জানালার বাইরের দৃশ্য ছিল এর উপজীব্য।
জোসেফের ক্যামেরার ছবিকে বলা হয় নেগেটিভ। প্রায় আট ঘন্টা লেগেছিল এই ছবি ডেভেলপ করতে। মূল সমস্যা ছিল লম্বা সময়ের শাটার বা এক্সপোজার টাইম। এর প্রতিকারে জোসেফ প্যারিসের এক চিত্রশিল্পী লুই জ্যাকুইস ম্যান্ডে ডেগুয়ের সাথে পার্টনারশিপে যান, মনোযোগ দেন কীভাবে এক্সপোজার টাইম কমিয়ে আনা যায়।
দ্বিতীয় ধাপে জোসেফ এক্সপোজার টাইম হ্রাস করতে গবেষণায় ডুবে যান। ১৮৩৩ সালে কাজ অসমাপ্ত ফেলেই তিনি পাড়ি জমান পরপারে। তবে ডেগুয়ের চালিয়ে নিয়ে যান জোসেফের কাজ। নিজের নামের সাথে মিল রেখে আবিষ্কার করেন ক্যামেরা ডেগুরোটাইপ (daguerreotype)। প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে ডেগুরোটাইপের এক্সপোজার টাইম ছিল কম। তবে ভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, এই ক্যামেরার তোলা ছবি খুব দ্রুতই অস্পষ্ট হয়ে পড়তো। মার্কিন আবিষ্কারক অ্যালেক্সান্ডার উলকট (Alexander S. Wolcott) মিরর ক্যামেরা (mirror camera) প্রযুক্তি তৈরি করে এর সমাধান করেন।
ডেগুরোটাইপ বেশ দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফরাসি সরকার এর কপিরাইট কিনে নেয়, বিনিময়ে ডেগুয়ের আর তার ছেলের জন্য আজীবন ভাতা বরাদ্দ করা হয়। তবে ক্যামেরার কায়দাকানুন গোপন না রেখে প্রকাশ করে দেয় সরকার, ঘোষণা করে বিশ্বের জন্য এটা তাদের উপহার। ১৮৩৯ সালে আলফন্সো জিরু (Alphonse Giroux) নামে এক ভদ্রলোক উন্মুক্ত এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাধারণের ব্যবহার্য ক্যামেরা ব্যাপক আকারে বাজারজাতকরণ আরম্ভ করেন। এর দাম ছিল তৎকালীন মুদ্রায় ৪০০ ফ্রা৺, আজকের বাজারে প্রায় ৭,০০০ ডলার।
১৮৩৯ সালে রয়াল ইন্সটিটিউটের সামনে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি ফক্স ট্যালবট (Henry Fox Talbot) উপস্থাপন করেন তার ক্যামেরা প্রযুক্তি, ক্যালোটাইপ (Calotype)। এই জিনিস তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন আরো নয় বছর আগেই, যেখানে মোম ব্যবহার করে ছবি দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল। পরবর্তী কয়েক দশকে ধাপে ধাপে ছবি তোলার কলাকৌশল আরো বিকশিত হয়। ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার রিচার্ড লিচ ম্যাডোক্স (Richard Leach Maddox) একধরনের ফিল্ম তৈরি করেন। তার আবিষ্কার তাৎক্ষণিক ছবি প্রিন্ট করার ক্ষমতা সম্বলিত পোলারয়েড ক্যামেরার আগমন ত্বরান্বিত করেছিল।
মার্কিন উদ্যোক্তা জর্জ ইস্টম্যান ১৮৮৮ সালে সর্বপ্রথম ক্যামেরায় কাগজের তৈরি ফিল্মের রোল ব্যবহার করেন। এরপর তিনি শুরু করেন সেলুলয়েডের ফিল্মের প্রচলন। সেই বছরই ১০০ ফিল্মের সেলুলয়েডের রোলসহ বক্স ক্যামেরা বাজারে আনেন তিনি, নাম দেন কোডাক (Kodak)।
মাত্র ২৫ ডলার দামের এই ক্যামেরা ছিল অধিকাংশের হাতের নাগালে। একে জনপ্রিয় করতে আকর্ষণীয় কিছু বিজ্ঞাপনও প্রচারিত হয়, যার মূল কথা ছিল, “আপনি শুধু বোতাম টিপবেন, বাকি কাজ আমাদের!” ১৯০১ সালে কোডাকের ক্যামেরার আরো সুলভ মূল্যের সংস্করণ বাজারে আসে। তবে তখকনকার ক্যামেরার ছবি ডেভেলপ করতে পাঠাতে হতো নিউ ইয়র্কে কোডাকের ফ্যাক্টরিতে।
যদিও ফিল্ম ক্যামেরার ইতিহাস এখানে উদ্দেশ্য নয়, তবে বলে রাখা ভালো- কোডাক সেই বাজারেও ভাগ বসাচ্ছিল। জার্মান আবিষ্কারক বার্নাক (Oskar Barnack) লেইটয কর্পোরেশনের (Leitz corporation) জন্য ৩৫ মি.মি. ফিল্ম ক্যামেরা প্রযুক্তি তৈরি করেছিলেন, যা ব্যবহার করে তৈরি হয় লাইকা ক্যামেরা (Leica)। ১৯৩০ সালে বাজারে আসা লাইকা ছয় বছরের মাথায় প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয় জাপানি কোম্পানি ক্যাননের। এরপর কোডাক আর ফুজিফিল্ম ৩৫ মি.মি. ফিল্ম তৈরিতে দাপট দেখাতে শুরু করে।
১৮৬১ সালে থমাস সাটন (Thomas Sutton) বলে এক ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার এসএলআর (single-lens reflex (SLR) technology) টেকনোলজির উন্নয়ন করেন। এই পদ্ধতিতে যে লেন্স দিয়ে আলো আসতো সেখানে চোখ রেখেই ছবি দেখা যেত। ক্যামেরা অবসকিউরা কিন্তু এই প্রযুক্তিই ব্যবহার করত। মানে ভালো হলেও এসএলআর ব্যবহার করলে ক্যামেরার দাম বেড়ে যেত। তাই প্রচলিত টুইন লেন্স রিফ্লেক্স (Twin-lens reflex cameras; আলো আসা এবং ছবি দেখার জন্য ভিন্ন লেন্স, ফলে প্রকৃত ছবি আর ডেভেলপ করা ছবির মধ্যে সামান্য পার্থক্য থাকতে পারত) প্রযুক্তির ক্যামেরাই প্রাথমিকভাবে বাজার দখল করে রাখে।
তবে উন্নতমানের ছবি তুলতে পারে বলে পেশাদার চিত্রগ্রাহক এবং ক্যামেরাপ্রেমিদের কাছে এসএলআর প্রযুক্তি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইতালিয়ান রেক্টাফ্লেক্স (Rectaflex) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগঅবধি ছিল অত্যন্ত নামকরা এসএলআর ব্র্যান্ড। ১৯৩১ সালে সোভিয়েতরা বাজারে আনে ৩৫ মিমি এসএলআর, নাম দেয় ফিল্মাঙ্কা (Filmanka)।
ডিজিটাল ক্যামেরার ঘটনাটা কী? এর কাজ আরম্ভ করেন কোডাকের প্রকৌশলী, স্টিভেন স্যাসোন (Steven Sasson)। ১৯৭৫ সালে যে যন্ত্র তিনি বানান তার ওজন ছিল চার কেজি, কেবল সাদা-কালো ছবি আসতো তাতে। এই ছবি রেকর্ড হতো ক্যাসেট টেপে। কারো যদি জানা না থাকে ক্যাসেট টেপ কী, তাহলে গুগল সার্চ করে দেখতে পারেন! এই ছবি দেখতে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত স্ক্রিন দরকার ছিল, এবং ছবি প্রিন্ট করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
১৯৯০ সালে লজিটেক বাজারে আনে ডিজিটাল টেকনোলজির ক্যামেরা, নাম ডাইক্যাম ১.০ (Dycam)। নয় বছর পর আবির্ভাব হয় তুমুল জনপ্রিয় ডিএসএলআর টেকনোলজির। এর মাঝেই ২০০৪ সালে এপসন মিররলেস ক্যামেরা নিয়ে আসে। তবে এসআলআর হারিয়ে যায় প্রধানত ডিএসএলআর-এর দাপটেই।
প্রাথমিক যুগের সব ক্যামেরাই সাদা-কালো ছবি তুলতো। এজন্য পোট্রেট ছবি যারা তুলতেন তাদের অনেকেই চিত্রশিল্পীদের দিয়ে ছবিতে রঙ করে নিতেন। জাপানে ১৮৭০ সালে থেকে হাতে রঙ করা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ফটোগ্রাফ বাজারে বিক্রি হতো।
প্রথম রঙিন ছবি বললে চলে আসবে গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের নাম। ১৮৬১ সালে রয়াল ইন্সটিটিউটে লেকচার দিতে যান তিনি, বিষয়বস্তু রঙ নিয়ে তত্ত্বকথা। এসএলআর-এর উদ্ভাবক থমাস সাটন তার জন্য তুলে দেন একটি ফিতার ছবি, যেখানে একটি ফিতার বেশ কিছু রঙ প্রকাশ পায়। এটিই সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম রঙিন ছবি।
১৮৯০ সালে মার্কিন ফটোগ্রাফার ফ্রেডেরিক ইভস (Frederic Ives) রঙিন ছবির জন্য তৈরি করেন ক্রমস্কোপ (Kromskop)। এই প্রযুক্তি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই ডাবলিনের ড. জন জলি চার বছরের মাথায় সুলভ মূল্যের একটি ভার্সন তৈরি করলেন। এক বছর পর কিছু ক্যামেরায় যুক্ত করা হয় এটি, তবে মুনাফার অভাবে উঠেও যায় দ্রুত। তখন আসলে রঙিন ছবির তেমন চল ছিল না।
তবে ১৯৩০ সালের পর থেকে এরকম ছবির চাহিদা বাড়তে থাকলে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসতে থাকে। এরকম একটি প্রযুক্তির আবিষ্কারক ছিলেন ড. ডগলাস স্পেন্সার। তিনি পরে হয়েছিলেন কোডাকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ১৯৩৫ সাল থেকে রঙিন ছবির দুনিয়ায় পা রাখে কোডাক, যার পেছনে ছিলেন ম্যানেস আর গোদোস্কি (Leopold Mannes and Leopold Godowsky) নামে দুই ব্যক্তি। এরপর রঙিন ছবি ধীরে ধীরে হটিয়ে দেয় সাদা-কালো ছবিকে।