পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
পলাশি নিয়ে ইতিহাসের পাতায় কিংবা লোকমুখে প্রচলিত কথকতায় কী পাওয়া যায় কিংবা না যায় তাতে যায়-আসে না। তবে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাঁকবদলের গল্প লেখা হয়েছিল এই স্থানকে ঘিরেই।
ইংরেজদের বাংলা জয় মূলত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করে। তারা বাংলা থেকেই তাদের তাণ্ডব শুরু করে। মূলত বাংলার সমৃদ্ধ অর্থভাণ্ডার তারা সামরিক শক্তি সুদৃঢ় করতে কাজে লাগায়। তারপর ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। তারা ধীরে ধীরে যে বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল তার কেন্দ্রভাগে বাংলার নাম নিতে হয় সবার আগে। আর এজন্যই ইংরেজদের সঙ্গে মিলে এদেশীয় ঘাতকদের ষড়যন্ত্র এই অঞ্চলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভয়ানক সূচনা কীভাবে করেছিল তার আলোচনা করা প্রয়োজন।
ভারতীয় তথা বাংলার মানুষের আবেগ আর ইংরেজদের ঘৃণা-বিদ্বেষে ভরপুর মিথ্যাচার- এই দুয়ের মধ্যে খাবি খাচ্ছে পলাশীর ইতিহাস। স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে শিখে আসা একতরফা বিবরণ ইতিহাসের বাস্তবতা থেকে আমাদের ঠেলে দিয়েছে যোজন যোজন দূরে। অন্যদিকে, আমাদের মনোজাগতিক পরিসরে পলাশীর ইতিহাস শিরোনামে যে প্রতিবিম্ব দেখা যায়, তার বিপরীতে নতুন ডিসকোর্স দাঁড় করানো বেশ কঠিন।
প্রাথমিক সূত্র থেকে গবেষণা করতে গেলে পলাশীর ইতিহাসের কিছু মিথ্যাচারের মুখোমুখি হতে হয়। পশ্চিমা গবেষক কিংবা তারও পরে সেকেন্ডারি সূত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন যে সকল গবেষক, তাঁদের কথা বাদ দেওয়া যাক। সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতবায়ি সিয়ার উল মুতাখখিরিন নামে সহস্রাধিক পাতার যে ঢাউস বই লিখেছেন, তাকে আর যা-ই হোক ইতিহাস বলা কঠিন। এটা অনেকটা অর্থের বিনিময়ে ইংরেজদের উদ্দেশ্যে লেখা একটা স্তুতিপত্র বলা যেতে পারে।
পলাশীর ইতিহাসের সূত্র হিসেবে করম আলির মুজাফ্ফরনামা কিংবা ইউসুফ আলির লেখা তারিখ-ই-বঙ্গালা-ই মহবত জঙ্গি পড়তে গেলেও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ওদিকে ফার্বার এবং গ্লেমানের (H Furber, K Glamann) লেখা Plassey: A New Account from the Danish Archives শীর্ষক গ্রন্থ থেকেও এই ব্যাপারে একটু ব্যতিক্রমী তথ্য পাওয়া যায়।
পলাশী নিয়ে বিস্তৃত পরিসরের গ্রহণযোগ্য কাজ করেছেন সুশীল চৌধুরী। তাঁর The Prelude to Empire: Plassey Revolution of 1757 শীর্ষক গ্রন্থে অনেকগুলা গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। তাঁর প্রায় প্রতিটি লেখাতেই তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন কিভাবে পলাশীর ইতিহাসে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মিথ্যাচার আর অতিকথনের বিষবৃক্ষ। তবে এর থেকে ইতিহাস বের করে আনার কাজটা অবশ্যই সহজ নয়।
স্যামুয়েল চার্লস হিল তাঁর (Bengal in 1756-57, a Selection of Public and Private Papers Dealing With the Affairs of the British in Bengal During the Reign of Siraj-Uddaula; With Notes and an Historical Introduction) শীর্ষক গ্রন্থে পলাশির ইতিহাস নিয়ে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এখনকার অনেক ইতিহাসবিদ রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে তার বেশিরভাগ তথ্য ও উপাত্ত গ্রহণ করা হয়েছিল শুধুই ইংরেজদের থেকে। ফলে তার বর্ণনা নিঃসন্দেহে একপেশে এবং স্থানীয়দের বিরুদ্ধে যায়।
১৯৮৭ সালে পি. জে. মার্শাল তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ Bengal: The British Bridgehead প্রকাশ করেন Cambridge University Press থেকে। এখানেও যে বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে তা পক্ষপাতদুষ্টতার দোষে দুষ্ট। একইভাবে ক্রিস্টোফার বেইলির Indian Society and the Making of the British Empire, ফ্রাঁসোয়া মার্টিনের Memories de Francois Martin (1665-1696), কিংবা সি. আর উইলসনের লেখা Old Fort William, Vol. II, গ্রন্থ থেকে পলাশীর ইতিহাস নিয়ে যা পাওয়া যায় তার সবই কম-বেশি পক্ষপাতের দোষে দুষ্ট।
সুশীল চৌধুরী এই প্রসঙ্গে লিখেছেন,
উপমহাদেশে উপযুক্ত ইতিহাস লেখার সুযোগ না থাকার কারণে লাগামহীন মিথ্যাচার করা হচ্ছে বাইরের দেশগুলো থেকে। তারা প্রচার করছে পলাশীর ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের বিশেষ কোনো ভূমিকা ছিল না। তারা বলে বেড়াচ্ছে সিরাজউদ্দৌল্লা চরিত্রহীন, দুর্বিনীত ও নিষ্ঠুর ছিলেন যে তাতে রাজ্যের অমাত্যবর্গ শুধু নয়, সাধারণ মানুষও নবাবের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই তাঁকে অপসারণ করতে মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বদ্ধপরিকর হয় এবং এ কাজ সম্পন্ন করতে তারা ইংরেজদের সামরিক শক্তির সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশায় তাদের ডেকে আনে।
পলাশীর ইতিহাস নিয়ে পি. জে. মার্শাল সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার করেছেন। তার মতে, ইংরেজদের বাংলা বিজয় ‘আকস্মিক’ ঘটনা। তিনি এর পেছনে তাদের ষড়যন্ত্র ও ধিকৃত সেই পূর্বপরিকল্পনাকে লুকিয়ে ইতিহাস লিখেছেন। তার শিশুতোষ বর্ণনানুযায়ী মুর্শিদাবাদ দরবারে ষড়যন্ত্রের মেঘ যখন ঘনীভূত, তখন পরিপৃক্ত মেঘের পুরো বৃষ্টিপাতে সিক্ত হয়েছিল ইংরেজরা। তার মতে, ইংরেজরা শুধুই সিরাজকে হঠিয়ে মীরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনায় শামিল হয়েছিল। এর বাইরে তাদের কোনো দোষ নেই।
ইংরেজ ইতিহাসবিদগণ যে ইতিহাস লিখেছে তাদের মতে, সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের যে বিবাদ, এবং সংঘর্ষের পরিণতি হিসেবে তিনি যে শেষপর্যন্ত বাংলার মসনদও হারালেন, তার জন্য মূলত দায়ী তিনিই। আবার পলাশির ব্যাখ্যা হিসেবে যুক্তি দেখানো হয়ে থাকে যে, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হয়ে তাঁর আচরণ ও ব্যবহারে প্রভাবশালী অমাত্যবর্গকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলার ফলে বাংলায় যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ‘সংকট’ দেখা দেয়, তার পরিণতিই পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব।
ইংরেজদের দুগ্ধপোষ্য অনেক ইতিহাস গবেষক প্রাক-পলাশি বাংলায় রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকটকে গুলিয়ে বর্ণনার চেষ্টা করছে। তারা পলাশির প্রাক্কালে বাংলার সমাজ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে পড়ার গল্পও দাঁড় করাচ্ছেন।
তথ্য ও যুক্তিনির্ভর বর্ণনার পাশাপাশি ইতিহাসের সূক্ষ্ম এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- ওপরের একপেশে বক্তব্যগুলো সহজেই খণ্ডন করা যায়। তখন সুশীল চৌধুরির সঙ্গে সুর মিলিয়ে যে কেউ বলতে বাধ্য হবেন, “পলাশীর ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল ইংরেজরাই, ভারতীয়রা নয়। ইংরেজরা বেশ পরিকল্পিতভাবেই এ কাজ সম্পন্ন করে এবং নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তারা মুর্শিদাবাদ দরবারের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে তাদের পরিকল্পনায় শামিল করে। শুধু তা-ই নয়, পলাশীর যুদ্ধের আগপর্যন্ত তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে যাতে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজউদ্দৌল্লাকে হটিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকে।”
পলাশীর ষড়যন্ত্রের দেশীয় কুচক্রীদের পাপ স্খালনের সুযোগও বেশ কম। ক্ষমতার লোভে নবাবের দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একাংশ সিরাজউদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। তবে ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশীর সেই ঘৃণ্য চক্রান্ত সফলতার মুখ দেখে। ইংরেজদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই চক্রান্ত পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে সফলতা হিসেবে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না।
পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে কয়েকটি বিষয় খেয়াল করা যাক:
- পলাশীর যুদ্ধে ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র কতটুকু আর সেখানে ইংরেজদের পূর্ব-পরিকল্পনা কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল?
- পলাশীর ষড়যন্ত্রের জন্য বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর কী ভূমিকা রেখেছিল?
- স্বার্থসিদ্ধির জন্য সিরাজউদ্দৌল্লাকে হটিয়ে বাংলার মসনদ অধিকার করার মতলবে স্থানীয় ধনকুবের ও দরবারের আত্মীয়দের ভূমিকা কী ছিল?
- প্রাক-পলাশী বাংলায় অভ্যন্তরীণ নানা সংকট শুধুই কি রাজনৈতিক ‘সংকট’ ছিল?
- অর্থনৈতিক ‘সংকট’ হিসেবে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার বাণিজ্যিক-ব্যাংকার শ্রেণি, জমিদার ও অভিজাতবর্গের সঙ্গে নবাবের শ্রেণিগত জোটবদ্ধতার প্রভাব কেমন ছিল?
- মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে আলিবর্দি খান পর্যন্ত চলমান বাংলার নিজামত সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর কীভাবে ভেঙে পড়েছিল?
- অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, শিল্পবাণিজ্যের অধোগতি, ব্যবসায়ী/মহাজন শ্রেণির আর্থিক দুরবস্থা, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম এবং ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণে ঘাটতি এই সময় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করেছিল?
- অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত যে হিন্দু-জৈন মহাজন-ব্যাংকিং ও ব্যবসায়ী শ্রেণির মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তার প্রভাব কেমন ছিল?
- পিটার মার্শাল, ক্রিস বেইলিরা মনে করেন, ‘ইউরোপীয়দের সঙ্গে বাংলার হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সূত্রে উভয়ের স্বার্থ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সে কারণেই হিন্দু-জৈন মহাজন-ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পলাশীর ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল’। এটা কি সঠিক?
- প্রাক-পলাশী বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্তি পলাশীর যুদ্ধে কী ভূমিকা রেখেছিল?
- নবাব সিরাজকে যে অপবাদ দেওয়া হয় এটা কি শুধুই তার পলাশীর পরাজয়ের অর্জন?
- ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্টনের (Luke Scrafton) বর্ণনায় সিরাজের যে চরিত্র ফুটে উঠেছিল, তা কি পুরোপুরি নির্জলা মিথ্যাচার?
উপরের সব প্রশ্নের উত্তরে পানি ঢেলে দিতে একটা বিষয়ই যথেষ্ঠ। তা হচ্ছে- ইংরেজদের সঙ্গে বিদ্যমান বিভেদ মেটাতে সিরাজউদ্দৌল্লা প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবেই বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করেছেন। তারপর দূত বিনিময় করে আর অস্ত্রধারণ করে হয় এসপার নয় ওসপার করতে চেয়েছিলেন। সবে ২১-২২ বছরে পা রাখা এক তরুণের কাছে এর থেকে বেশি কী আশা করা যায়? আর সেই হিসেবে সিরাজ-ইংরেজ বিরোধ বিশেষ কিছু ঘটনা বা নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল। পরে যা থেকে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
আলিবর্দি খানের মৃত্যুর আগেও সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজ কোম্পানির বেশ কিছু কুকর্মের প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে ইংরেজরা ইচ্ছে করেই এমন কিছু ঘটাচ্ছে যার মাধ্যমে নবাবের সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো হচ্ছে। তাই তিনি প্রথম থেকেই ইংরেজদের সন্দেহ করেছিলেন। ইংরেজরা তাঁর সিংহাসনপ্রাপ্তির বিরোধিতার পাশাপাশি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মদত দিতে পারে এই সন্দেহ পুরোপুরি সিরাজের মনে কাঁটা দিয়েছিল। এর বিপরীতে ইংরেজরা প্রথম থেকে প্রায় ধরেই নিয়েছিল যে সিরাজের পক্ষে আর যা-ই হোক নবাব হওয়া সম্ভব হবে না।
নবাব সিরাজের শত্রু ছিল ফরাসিরাও। ইংরেজদের মতো ফরাসিরাও নবাব আলিবর্দি খানের রাজত্বের শেষদিকে তাদের দুর্গগুলো সুরক্ষিত করে। তারা নতুন যে নির্মাণকার্য করেছিল তার সব ভেঙে দিতে নির্দেশ দেন নবাব সিরাজ। অন্যদিকে, দস্তকের বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ ও বে-আইনি ব্যবহার করছিল ব্রিটিশরা। পাশাপাশি, নবাবের অপরাধী প্রজাদের আশ্রয়দান ইংরেজদের পক্ষ থেকে বড় অন্যায় ছিল। বিশেষত, রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস সপরিবারে ৫৩ লক্ষ টাকার ধনরত্ন নিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেয় আলিবর্দি খানের মৃত্যুর কয়েকদিন আগে।
ইংরেজ কর্মকর্তা ওয়াটস বুঝতে পারেন যে সিরাজউদ্দৌল্লার নবাব হওয়া সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তিনি ড্রেককে জানিয়েছিলেন, কৃষ্ণদাসকে এ অবস্থায় কলকাতায় রাখা মোটেই সমীচীন নয়। তবে তার কথায় ড্রেক কর্ণপাতও করেননি। কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজরা শুধু নবাবের কর্তৃত্বকেই অমান্য ও খাটো করেনি, মসনদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সিরাজের যে বিরোধী দল তার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল। এটাই পলাশী যুদ্ধের মূল বাস্তবতা।
সিরাজ কূটনৈতিকভাবে একটা আপস মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর পাঠানো দূত নারায়ণ সিং ও খোজা ওয়াজিদ ব্যর্থ হয় মূলত গভর্নর ড্রেকের ‘যুদ্ধংদেহী’ মনোভাবের জন্য। তখন ইংরেজদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য সিরাজ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি অবরোধ করেন। এ সময় ইংরেজরা আত্মসমর্পণ করার পর নবাব কলকাতা আক্রমণ ও দখল করেন।
প্রাক-পলাশি বাঙালি সমাজে দ্বিধাবিভক্তির যে গল্প শোনানো হয় তা অনেকাংশেই মিথ্যা। কারণ নবাব আলীবর্দী খান তথা সিরাজদ্দৌল্লার সময় অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার ছিলেন হিন্দু। লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও হল্যান্ডের হেগ শহরের রাজকীয় মহাফেজখানায় পলাশীর আগে বাংলার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের দুটি তালিকা থেকে এই বর্ণনা দিয়েছেন সুশীল চৌধুরী। তার হিসেবে নবাব আলিবর্দির সময় (১৭৫৪-তে) দেওয়ান, ‘তান-দেওয়ান’, ‘সাব দেওয়ান’, বক্সি প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ছিল। এর বিপরীতে একমাত্র মুসলমান বক্সি ছিল মীরজাফর। তখনকার ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই ছিলেন হিন্দু, যা দ্বিধাবিভক্তির গল্পকে পুরো নাকচ করে দেয়।
যদি প্রশ্ন করা হয়- পলাশী কার চক্রান্ত? সেখানে শুধু এক মীরজাফরের নাম নেওয়া ইতিহাসের খণ্ডিত চিত্র উপস্থাপন করে। কারণ, পলাশীর ষড়যন্ত্রে মুর্শিদাবাদ দরবারের অভিজাতবর্গের মধ্যে মীরজাফর ও জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ এতে জড়িত ছিলেন। এজন্য মীরজাফরই একমাত্র ‘বিশ্বাসঘাতক’, এটা সত্য নয়, উপরন্তু জগৎশেঠের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
২১ জুন লর্ড ক্লাইভ তার যুদ্ধবিষয়ক কমিটির সভা শেষ করেন। তারপর ২২ জুন ভোরবেলা ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজবাহিনী পলাশী অভিমুখে অভিযান শুরু করল। জয়-পরাজয়ের হিসেব পরে। সবচেয়ে বড় বিষয়- যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা। প্রাপ্ত সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করে জানা গিয়েছে- পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর, রায় দুর্লভরাম ও ইয়ার লতিফ খানের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ পুরো নিষ্ক্রিয় ছিল। গোলাম হোসাইন খান তবাতবায়ি তার সিয়ার উল মুতাখখিরিনে লিখেছেন,
মীরজাফর তার সেনাদল নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, নিতান্ত দর্শক হিসেবে। তার ভাব দেখে মনে হয়েছিল সে মজা দেখতে যুদ্ধক্ষেত্রে পা রেখেছে।
অন্যদিকে রিয়াজ উস সালাতিনের বর্ণনা অনুযায়ী,
মীরজাফর তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে নবাবের মূল বাহিনীর বাম দিকে বেশ খানিকটা দূরত্বে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন; নবাব তাকে বার বার তাঁর দিকে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তারপরেও তিনি একবিন্দু তার স্থান থেকে সরে দাঁড়াননি।
সুশীল চৌধুরী লিখেছেন,
২৩ জুন সকালে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁবু থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাঠে দাঁড়াল তা দেখে স্ক্র্যাফ্টন হতবাক—’they made a most pompous and favourable appearance…. their disposition, as well as their regular manner in which they formed, seemed to speak greater skill in war than we expected from them.
নবাব সিরাজের হান্টিং লজে আশ্রয় নিয়েছিল ইংরেজরা। লজের ছাদ থেকে ক্লাইভ যুদ্ধের বাস্তবতা পযর্বেক্ষণ করতে থাকেন। সকাল ৮টার দিকে যুদ্ধ শুরু হয়। নবাবের সৈন্যবাহিনী নানা ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে তাঁর অনুগত ও দক্ষ সেনাপতিদের নেতৃত্বে লড়াইয়ের ময়দান সরগরম করে তোলে। কুশলী যোদ্ধা মোহনলাল, মীরমর্দান, খাজা আবদুল হাদি খান এবং নবসিং হাজারি তাদের নামের প্রতি সুবিচার করলে ইংরেজদের পক্ষে লড়াইয়ের ময়দানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়।
ফরাসি সেনানায়ক সিনফ্রে তথা সাঁ ফ্রে তার সৈন্যদল সঙ্গে নিয়ে নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা ইংরেজদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করে পুরো পুরিস্থিতি ইংরেজদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে নিয়ে যাচ্ছিল। তাই পুরো যুদ্ধ শেষে জয়ের ব্যাপারে সিকিভাগ আশার আলো দেখতে পাননি রবার্ট ক্লাইভ। পলাশির যুদ্ধে অংশ নেওয়া জনৈক সৈনিক জন উডের ভাষ্যে সুশীল চৌধূরী লিখেছেন, “সেদিন সারা সকাল ইংরেজদের অবস্থা ছিল হতাশাজনক এবং রাত হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করছিল যাতে অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওয়া যায়।”
নানা সংকট ও ষড়যন্ত্রের পরেও ইংরেজদের অবস্থা অত্যন্ত বিপজ্জনক ও বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। ওয়াটস নিজেই লিখে গিয়েছেন,
নবাব বা তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে কেউ যদি ইংরেজদের অবস্থাটা ভাল করে অনুধাবন করতে পারত তা হলে তারা নিশ্চিতভাবে ইংরেজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং ইংরেজ ফৌজকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করতে পারত। যদি তা-ই হতো, তাহলে ক্লাইভকে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার জন্য রাতের অন্ধকার নামা অবধি অপেক্ষা করতে হত। বাস্তবে মনে মনে পরাজয় মেনে নিয়ে ক্লাইভ শুরুতে তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন।
পলাশীর ময়দানে যুদ্ধ এগিয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে ইংরেজদের পরাজয় অনেকটা সুনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই বিধি বাম। বেলা তিনটার দিকে যখন নবাব নিশ্চিত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তখন দুর্ভাগ্যবশত হঠাৎ একটি গোলার আঘাতে মীর মদন গুরুতর আহত হন। তাঁকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসার অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। মূলত এতেই যুদ্ধের মোড় পুরোপুরি ঘুরে যায়।
স্ক্র্যাফ্টনের মতে, ইংরেজদের বিজয়ের বড় একটি কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে মীর মদনের মৃত্যু। মূলত, মীর মদনের আকস্মিক মৃত্যু নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হতাশ করে। তিনি বাধ্য হয়েই বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি নবাব তাঁর রাজকীয় মুকুট মীরজাফরের পায়ের কাছে রেখে নিজের প্রাণ ও সম্মান বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল আকুতি জানান। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর নবাবকে সেদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দেন। শুধু তা-ই না, যুদ্ধ বন্ধের এই খবর তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকেও জানিয়ে দেন। এই সময় হতাশ সিরাজদ্দৌল্লা রায়দুর্লভকে ডেকে পাঠালে তিনিও অভিন্ন পরামর্শ দেন।
নবাব মোহনলাল এবং অন্য অনুগত সেনাপতিদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়ার মুহুর্তেও বুঝতে পারেননি কত বড় সর্বনাশ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। মীরমর্দানের মৃত্যুর পর মোহনলাল মূল সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেনাপতিদের সকলে নবাবের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেন প্রথমে। তারা জানতেন- ওই সময় পিছু হঠে আসা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে। কিন্ত অনুগত সেনাপতি মোহনলাল সিরাজের বার বার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি। শেষ অবধি তিনি ও তার সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হওয়ার পাশাপাশি নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত করেন।
তারিখ-ই-বাঙ্গালা-ই-মহবৎজঙ্গী, সিয়ার উল মুতখখিরিন, রিয়াজ উস সালাতিনসহ মুজাফ্ফরনামার বর্ণনাতে ঠিক এই তথ্যগুলোই জানা গিয়েছে। আমরা ইউসুফ আলির বর্ণনা থেকে পাই,
ওই সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হঠার নির্দেশ দেওয়ার জন্য নবাবের অন্যতম সেনাপতি মীর মহম্মদ কাজিম বেশ বাজে ভাষায় নবাবকে ধিক্কার দিতেও দ্বিধা করেননি। কিন্ত তখনকার হিসেবে অনুযায়ী নবাবের নির্দেশ অমান্য করার সুযোগ ছিল না।
মীর জাফরের কুপরামর্শ মেনে নবাবের সৈন্যরা পিছু হটার জন্য পেছন ফিরতেই ইংরেজরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণে অল্প সময়ের ব্যবধানে নিশ্চিত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকা নবাবের সৈন্যবাহিনী পুরোপুরি বিশৃঙ্খল ও ছত্রখান হয়ে যায়। মাত্র দুই ঘণ্টা ব্যবধানে নিশ্চিত বিজয় থেকে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিকেল পাঁচটার দিকে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়।
ভারতীয় ইতিহাসবিদদের লেখা বিভিন্ন গ্রন্থে বেশিরভাগ ইংরেজ লেখকের বর্ণনা থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা সহজেই প্রমাণ করে যে পলাশীর যুদ্ধে নিশ্চিত বিজয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল নবাবের বাহিনী। মীর মদনের নিহত হওয়ার সুযোগ নিয়ে মীর জাফর নবাবের সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে বলে। আর এসময় পেছন থেকে আক্রান্ত হওয়াই নবাবের পরাজয়ের মূল কারণ। কোনো রকমের মুখোমুখি যুদ্ধ বাদে সুযোগসন্ধানী একটি আক্রমণ এমন একটি যুদ্ধের নিষ্পত্তি ঘটায়, যা এক অর্থে শুধু বাংলা নয়, পুরো ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিরাট বাঁকবদলের কারণ হয়েছিল।
যুদ্ধের নাটকীয় মোড় বেলা তিনটা থেকে দুই ঘণ্টা ব্যবধানে নবাবের বাহিনীকে পরাজিত করার পাশাপাশি ইংরেজদের বিজয়ী করে। এর ঠিক ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ক্লাইভ তার মূল সাহায্যকারী বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের কাছ থেকে অভিনন্দনসূচক বার্তা পান, “আপনাদের পরিকল্পনা সফল হওয়ায় আন্তরিক অভিনন্দন।”
অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই অভিনন্দনবার্তাতেও লুকিয়ে আছে ষড়যন্ত্রের বাস্তবতা। পলাশী যুদ্ধের পরদিন অর্থাৎ ২৪ জুন স্ক্র্যাফ্টনকে দিয়ে দাউদপুর থেকে মীরজাফরকে চিঠি পাঠান ক্লাইভ। এখানেও বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরকে সম্মানিত করে ক্লাইভ লিখেছিলেন, “এ যুদ্ধজয় আপনার কৃতিত্ব, আমার একার নয়। দ্রুত আমার সঙ্গে দেখা করলে খুশি হব। আমি আপনাকে নিয়ে কালই মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা করব। আশা করি আপনাকে নবাব হিসেবে অভিষিক্ত করার সুযোগ আমি পাচ্ছি।” তারপর রবার্ট ক্লাইভ স্বয়ং মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে মীরজাফরকে নবাব হিসেবে বসিয়ে বিশ্বাসঘাতকতার পুরষ্কার হিসেবে তার মাথায় মুকুট পরিয়ে দেন।
পলাশীর যুদ্ধের বর্ণিল প্রেক্ষাপট ও থ্রিলার মুভির আদলে এগিয়ে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ থেকেও ভয়াবহ ছিল এর ফলাফল। মূলত, পুরো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ইংরেজদের পদানত হওয়ার সূত্রপাত ঘটে এই পলাশী থেকেই। প্রথমত, বাংলাজুড়ে ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক ফলাফল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। অন্যদিকে, বাংলা বা ভারতবর্ষ নয়, বরং পুরো পৃথিবীর ইতিহাসকেও এই যুদ্ধ প্রভাবিত করে। যুদ্ধের আগে লর্ড ক্লাইভ কিংবা ঘাতক মীরজাফরও হয়তো ভাবতে পারেনি পলাশীর যুদ্ধের ফলে বাংলায় তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি, ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক প্রেক্ষাপটও তৈরি করে দেবে এই যুদ্ধ।
প্রাথমিকভাবে বলতে গেলে- পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের ফলে ১৭৫৭ সালে বাংলায় ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পূর্বে ভারতবর্ষ পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতে ২৫ শতাংশ অবদান রাখত। ভারতের এই অবদানের অর্ধেক আসত বাংলা থেকে। অন্যদিকে ব্রিটিশরা বিশ্ব অর্থনীতির মাত্র ২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেত। এর বিপরীতে ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে যায়, তখন ভারতীয় অর্থনীতির আকৃতি হ্রাস পেয়ে হয়েছিল মাত্র ২ শতাংশ। এর বিপরীতে ব্রিটিশরা বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ বলে বিবেচিত হয়। বিপুল পরিমাণ সম্পদ বাংলা ও ভারতবর্ষ থেকে লুট করার মাধ্যমেই এটা সম্ভব হয়েছিল।
পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ের পর লর্ড ক্লাইভের বাহিনী বাংলার বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাচার করে। এই সময় এত সম্পদ ব্রিটেনে পাচার হয় যে শুধু চট্টগ্রাম বন্দরে ৪ মাসের জাহাজ-জট সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যদিকে, পুরো ভারতের সম্পদ কীভাবে লুট করা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। মনে করা হয়, ব্রিটিশরা আমেরিকাতে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করার পর সেখানে যে শক্তিশালী প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, সেখানেও ভারতের এই লুণ্ঠিত সম্পদের প্রভাব ছিল। ব্রিটিশরা করের বোঝা বাড়িয়ে দিলে আমেরিকা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীনতা লাভ করলেও ভারতের স্বাধীন হতে অনেক সময় লেগে যায়।
১৭৭০ সালে বাংলায় যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল, তা ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে কুখ্যাত। বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ হত্যাকারী এই দুর্ভিক্ষ বাংলার জনসংখ্যা ৩ কোটি থেকে কমিয়ে ২ কোটিতে নিয়ে গিয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষও পলাশী যুদ্ধের পরোক্ষ ফল।
ইতিহাসে কোনো যুদ্ধ কিংবা ঘটনার ফলাফল ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই দিক থেকে হিসেব করতে হয়। অনেক পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস লেখক তাদের একপেশে বর্ণনায় স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এসব প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব প্রদানের মাধ্যমে ইংরেজ শাসনকে মহান করে দেখাতে চায়। কিন্ত আদতে কোনো গৃহস্থের গরুকে পিটিয়ে মেরে ফেলার পর তাকে যদি এক জোড়া নতুন জুতা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়, সেটা নিঃসন্দেহে তার প্রতি উপহাস।
স্কুল, কলেজ কিংবা নানাবিধ ভবন স্থাপনের জন্য ইংরেজ শাসক কিংবা তাদের মোসাহেব রক্তচোষা জমিদারদের কোনো কৃতিত্ব দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ পলাশীর যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তা নিয়ে ভাগ্যগুণে ইংরেজদের জিতে যাওয়ার আগেও ভারতবর্ষের নানা স্থানে, এমনকি বাংলাতেও উন্নতমানের নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এখানকার চিকিৎসাব্যবস্থাসহ যাতায়াত ও পরিবহনেও ইংরেজদের থেকে এগিয়ে ছিল। তাই পলাশীর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফলকে এক লাইনে লিখলে সেটা পুরোপুরি নেতিবাচকতার বাইরে আর কিছু নয়। সেই সাথে অবশ্যই তা সীমাহীন লুণ্ঠন, স্থানীয় অধিবাসীদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন আর মানবাধিকার হরণের ইতিবৃত্ত।