চেঙ্গিস খানের মৃত্যুরহস্য নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন
আর্টিকেলটি পড়ুন
মৃত্যুশয্যায় চেঙ্গিস খান; বয়স হয়ে গেছে ৬৫, ক্ষেত্রবিশেষে যা ৭২ বলেও দাবি করা হয়। আশেপাশে জড়ো হয়েছে পরিবার-পরিজন আর এতদিনের সাম্রাজ্য গড়ার কারিগররা। তারাও বুঝতে পারছে, শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে প্রিয় নেতার; যাকে তারা হিরোর চোখে দেখলেও তৎকালীন দুনিয়া তো বটেই, পরবর্তীকালের মানবজাতিও তাকে মনে রাখবে রক্তলোলুপ এক শাসক হিসেবেই।
মরবার আগেও দ্য গ্রেট খানের এই রক্তপ্রিয় স্বভাব গেল না। অনেকের মতেই, যখন তিনি মারা যান, তখন জি জিয়া রাজ্যে এক বিদ্রোহ দমনের মিশনে ছিলেন তিনি। যখন বুঝতে পারলেন যে জীবদ্দশায় এই বিদ্রোহের সমাপ্তি আর দেখে যাওয়া সম্ভব না, তখন তিনি অধীনস্থদের আদেশ দিয়ে গেলেন, জি জিয়ার নাম-নিশানাও যেন পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যায়। তার উত্তরসূরীরা সেই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল, ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয় জি জিয়া, চেঙ্গিস খানের নির্দেশে শেষবারের মতো রক্তে রঞ্জিত হয় কোনো জনপদ, ক্রীতদাসে পরিণত হয় অগণিত মানুষ।
কিন্তু শুরুতেই যে বলা হলো চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর কথা, তিনি আসলে কীভাবে মারা গেলেন? এ এক রহস্য, প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো এক রহস্য। মানবজাতির ইতিহাসে অমীমাংসিত কিছু রহস্যের যদি তালিকা করা হয়, তাহলে চেঙ্গিস খানের মৃত্যুরহস্য থাকবে উপরের দিকেই। আর আজ আমরা জানব এ সম্পর্কেই।
কীভাবে মারা গেলেন
তেমুজিন ওরফে
চেঙ্গিস খান ওরফে
দ্য ফার্স্ট গ্রেট খান?
১) খোজাকরণের ফলে মৃত্যু
জ্বি, আপনি ঠিকই পড়লেন। তবে এটা খোঁজ দ্য সার্চের খোঁজা না, বরং এর ইংরেজি কিন্তু Castration!
চেঙ্গিস খান যে জি জিয়া রাজ্যে এক বিদ্রোহ দমনে গিয়েছিলেন, তা তো একটু আগেই বলেছি। কথিত আছে, এই রাজ্যের সাথে সর্বশেষ এবং অবশ্যই সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধে জড়ানোর আগের রাতে চেঙ্গিস খান স্বপ্নে তুষারের উপর ছোপ ছোপ লাল রক্ত দেখতে পেলেন। বিচিত্র এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে তিনি রাজজ্যোতিষীর শরণাপন্ন হন। জ্যোতিষী তাকে জানান, রক্ত এই রাজ্যেরই রাজপুত্রের, যার মানে যুদ্ধে তিনি নিহত হবেন, পতন ঘটবে জি জিয়ার। ওদিকে ঐ তুষার আসলে নিহত সেই রাজপুত্রেরই অনিন্দ্যসুন্দরী কন্যার, যাকে বিয়ে করার জন্য অনেকেই প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেই মেয়ে সবাইকেই ফিরিয়ে দেয়।
যা-ই হোক, পরদিন যুদ্ধে জয় হয় মোঙ্গলদেরই, চেঙ্গিস খানও দেখা পান সেই মেয়ের। তাকে বন্দী করে নিয়ে আসা হয় খানের খাস কামরায়। চেঙ্গিস খান ধীরে ধীরে এগিয়ে যান তার সম্ভ্রমহানির উদ্দেশ্যে। মেয়েটিও মনে মনে এমন পরিণতির জন্য প্রস্তুত ছিল। তাই তো খোঁপার আড়ালে ছোট্ট এক ছোরা লুকিয়ে রেখেছিল সে। খান কাছে আসতেই খানের জননাঙ্গে ছুরি চালিয়ে দেয় মেয়েটি। ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু ঘটে চেঙ্গিস খানের।
ঐ রাজকন্যার কী হলো? রাজ্যের পতনের পর তার কপাল তো এমনিই পুড়েছিল, এরপর সে হত্যা করে ফেলেছে খোদ চেঙ্গিস খানকেই, যার পরিণতি নিশ্চিত মৃত্যু। এর আগে যেন আর কারও হাতে নতুন করে অপদস্থ হতে না হয়, সেজন্য সে নিজেই ঝাপ দেয় নদীতে।
এই তত্ত্বে সহজ কথায় চেঙ্গিস খানকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে ইতিহাসবিদগণ এই দাবির ব্যাপারে বেশ সন্দিহান। তাদের মতে, এটা পুরোপুরিই বানোয়াট এক কাহিনি, যার পেছনে চীনাদের কিংবা পশ্চিম মঙ্গোলিয়ার ঐরাত গোত্রের হাত থাকতে পারে। এই গোত্রের সাথে পূর্ব মঙ্গোলিয়ার শত্রুতা ছিল, তারা হাত মিলিয়েছিল খানের শত্রুপক্ষের সাথে, এমনকি খানের মৃত্যুর পর মঙ্গোল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছিল, তাদের সাথেও জড়িত ছিল এই গোত্র।
ফলে গোত্র গোত্রে দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম এই তত্ত্বের- এমনটাই বিশ্বাস অধিকাংশ ইতিহাসবিদের।
২) যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু
যুদ্ধ, ধ্বংসের মতো বিষয়গুলো চেঙ্গিস খানের নামের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে যুদ্ধক্ষেত্রে তার মৃত্যুই যেন বেশি স্বাভাবিক হবার কথা। আর তেমনই এক তত্ত্বের ব্যাপারে জানা যায় ১৪২৫ সালে রচিত হাইপেশিয়ান কোডেক্স থেকে। বর্তমানে এটি সেইন্ট পিটার্সবার্গের রাশান ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে।
এই কোডেক্সেরই এক অংশে Galician-Volhynian Chronicle এর একটি অরিজিনাল কপি রয়েছে, যেখানে ১২০১ থেকে ১২৯২ সালের মধ্যবর্তী ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেখানেই মূলত ১২২৭ সালে জি জিয়ার বিদ্রোহ দমনকালে যুদ্ধক্ষেত্রে বিষাক্ত তীর বিদ্ধ হয়ে চেঙ্গিস খানের মৃত্যু হয় বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এই বর্ণনাটি চেঙ্গিস খানের মৃত্যুরও আনুমানিক ৭০ বছর পর লেখা, যার মানে কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্রে এটি বর্ণনা করা হয়নি। ফলে এই দাবির সত্যতা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হবার অবকাশও রইল না।
৩) ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু
চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর এই বর্ণনা জানা যায় মঙ্গোলীয় ভাষায় রচিত প্রায় ৮০০ বছরের পুরাতন সাহিত্যকর্ম ‘দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অভ দ্য মঙ্গোলস’ থেকে। ১২২৭ সালে চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর বছরখানেকের মাঝেই এটি লেখা শুরু হয়। তবে মূল বইটি যে কে লিখেছিলেন তা জানা যায় না। এমনকি মূল সাহিত্যকর্মটি মঙ্গোলীয় ভাষায় রচিত বলে ধারণা করা হলেও এই ভাষায় এটি পাওয়া যায়নি, পাওয়া গিয়েছে চীনা ভাষায় অনূদিত অবস্থায়। অবশেষে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রাশান সন্ন্যাসী পিওতর কাফারভের উদ্যোগে এটি প্রকাশিত হয়।
‘দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অভ দ্য মঙ্গোলস’ অনুযায়ী, চেঙ্গিস খান জি জিয়ায় আক্রমণের নির্দেশ দেবার পর প্রস্তুতির জন্য দক্ষিণ মঙ্গোলিয়ায় অবস্থান করছিলেন। তখন ছিল শীতকাল। তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতির পাশাপাশি অবসর সময়টা শিকার করে কাটাচ্ছিলেন। এমনই একদিন তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে বেশ ব্যথা পান। এই ব্যথা থেকে সেই রাতে বেশ জ্বর আসে তার। এই যে ব্যথা ও জ্বর থেকে সৃষ্ট দুর্বলতা, তা-ই তাকে কালক্রমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে এর সাথে শীতে ঠাণ্ডা থেকে তিনি নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলেও উল্লেখ পাওয়া যায়।
৪) ব্যুবোনিক প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু
চেঙ্গিস খানের মৃত্যু নিয়ে সর্বশেষ তত্ত্ব এটাই যে তিনি ব্যুবোনিক প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই তত্ত্বটি উঠে এসেছে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে International Journal of Infectious Diseases-এ প্রকাশিত ‘Genghis Khan’s death (AD 1227): An unsolvable riddle or simply a pandemic disease?’ গবেষণাপত্রে।
চীনের মিং রাজবংশের শাসনামলে রচিত ইতিহাস বিষয়ক এক নিবন্ধ ‘The History of Yuan’। একটু আগেই যে গবেষণাপত্রের কথা বলা হলো, তার গবেষকদল এর সাহায্য নিয়েই দেখিয়েছেন যে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্টের দিকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন চেঙ্গিস খান। এ সময় তার জ্বর হয়েছিল। আটদিন পর এই জ্বর থেকেই মৃত্যু হয় তার।
আপনি বলতেই পারেন যে, কেবলমাত্র একটি সূত্রের সাহায্য নিয়েই এই গবেষণাপত্রের লেখকেরা এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল? না; এজন্য তারা বিস্তারিত গবেষণাই করেছেন। এই সিদ্ধান্তে আসার সময় তারা যেমন চেঙ্গিস খানের রোগের উপসর্গের কথা আমলে নিয়েছেন, তেমনই সেসময় মঙ্গোল বাহিনী ও তার শত্রুপক্ষের মাঝেও ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া এক সংক্রামক রোগের তথ্যও আমলে নিয়েছেন। পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন সংক্রামক রোগের যে ডাটাবেস তৈরি করেছে, তার সাহায্য তো ছিলই। সব মিলিয়ে তারা শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন যে, চেঙ্গিস খান যে সময়টায় জি জিয়ায় অভিযান চালাচ্ছিলেন, সেসময় সেখানে ব্যুবোনিক প্লেগের বিস্তার ঘটেছিল। ফলে তিনিও এতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার সম্ভাবনাই সর্বাধিক।
অর্থাৎ, এখানে বলা হচ্ছে যে ব্যুবোনিক প্লেগই দ্য ফার্স্ট গ্রেট খানের মৃত্যুর পেছনে সর্বাধিক দায়ী হতে পারে। কিন্তু দেখুন, এই দায়টা কিন্তু প্লেগের উপর শতভাগ চাপানো হয়নি। কেন জানেন? কারণ গবেষকদল কিন্তু চেঙ্গিস খানের মৃতদেহ খুঁজে সেই দেহাবশেষের উপর গবেষণা চালাতে পারেনি, গবেষণা করেছেন সেসময়ের ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের উপর ভিত্তি করেই। কিন্তু কেন তারা চেঙ্গিস খানের দেহাবশেষ পরীক্ষা করলেন না? এ আরেক বিরাট ইতিহাস, আরেক অমীমাংসিত রহস্য, কেননা চেঙ্গিস খানের মৃতদেহ যে আজ পর্যন্ত খুঁজেই পাওয়া যায়নি!